রাইস ব্র্যান তেল, যা চালের কুড়ার তেল নামেও পরিচিত, সম্প্রতি স্বাস্থ্যসচেতন মানুষের মধ্যে ব্যাপক জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এই তেলটি চালের বাইরের স্তর বা কুড়া থেকে নিষ্কাশন করা হয়, যা পুষ্টিতে ভরপুর। রাইস ব্র্যান তেলে ওরিজানল, ভিটামিন ই এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের মতো উপাদান রয়েছে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়ক। বুঝতেই পারছেন রাইস ব্র্যান তেল কেন খাবেন।
এছাড়া, এর উচ্চ ধূমায়িত তাপমাত্রার কারণে এটি রান্নার জন্য আদর্শ, বিশেষত ভাজার জন্য। আমাদের আজকের এই আর্টিকেলে আমরা রাইস ব্র্যান তেলের স্বাস্থ্য উপকারিতা এবং এটি কীভাবে তৈরি হয় তা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করব, যা আমাদের দৈনন্দিন খাদ্যাভ্যাসে এ তেল ব্যবহারের যৌক্তিকতা তুলে ধরবে। এ সম্পর্কে আর জানতে হলে আজকের লেখাটি সম্পূর্ণ পড়ুন।
রাইস ব্র্যান তেল কি?
রাইস ব্র্যান তেল কেন খাবেন সে সম্পর্কে আলোচনা করার আগে চলুন জেনে নেই- রাইস ব্র্যান তেল মূলত কি এবং কিভাবেই বা এটি প্রস্তুত করা হয়। রাইস ব্র্যান তেল চালের বাইরের স্তর, অর্থাৎ কুঁড়া থেকে নিষ্কাশিত একটি পুষ্টিকর উদ্ভিজ্জ তেল। চালের এই বাইরের স্তরে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই, ফাইটোনিউট্রিয়েন্টস, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাটি অ্যাসিড থাকে, যা শরীরের বিভিন্ন অংশের জন্য উপকারী।
এই তেলটি মূলত রান্নার তেল হিসেবে ব্যবহৃত হলেও এর পুষ্টি উপাদান হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো, রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানো এবং ত্বক ও চুলের যত্নে ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও, এতে থাকা অ্যান্টি-ইনফ্লেমেটরি এবং অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট উপাদান শরীরের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে।
রাইস ব্র্যান তেল কিভাবে প্রস্তুত করা হয়?
রাইস ব্র্যান তেল তৈরি প্রক্রিয়া বেশ কয়েকটি ধাপে সম্পন্ন হয়। নিচে এ প্রক্রিয়াটি বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:
চালের কুঁড়া সংগ্রহ
রাইস ব্র্যান তেল তৈরির প্রথম ধাপ হলো চালের কুঁড়া সংগ্রহ করা। ধান থেকে চাল উৎপাদনের প্রক্রিয়ায় চালের বাইরের স্তর বা কুঁড়া মিলিংয়ের সময় আলাদা হয়ে যায়। এই স্তরেই তেলের প্রধান উৎস থাকে। চালের কুঁড়ায় অনেক পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান থাকে যা সাধারণ চালের তুলনায় অনেক বেশি কার্যকর।
তেল নিষ্কাশন
তেল নিষ্কাশনের জন্য দুটি প্রধান পদ্ধতি রয়েছে: সলভেন্ট এক্সট্রাকশন এবং কোল্ড প্রেসিং।
- সলভেন্ট এক্সট্রাকশন পদ্ধতি: এই প্রক্রিয়ায় হেক্সেন নামক একটি দ্রাবক ব্যবহার করা হয়, যা চালের কুঁড়া থেকে তেল নিষ্কাশনে সাহায্য করে। কুঁড়া হেক্সেনের সঙ্গে মিশ্রিত করা হয় এবং এটির মাধ্যমে তেল কুঁড়া থেকে আলাদা হয়ে যায়। পরে, দ্রাবকটি পুনরুদ্ধার করা হয় এবং নিষ্কাশিত তেল থেকে হেক্সেন পুরোপুরি সরিয়ে ফেলা হয়।
- কোল্ড প্রেসিং পদ্ধতি: এটি একটি আরও স্বাস্থ্যকর পদ্ধতি যেখানে কুঁড়া থেকে তেল নিষ্কাশনের সময় কোন ধরনের উচ্চ তাপমাত্রা বা রাসায়নিক দ্রাবক ব্যবহার করা হয় না। এ পদ্ধতিতে কুঁড়া চাপ দিয়ে চেপে তেল বের করা হয়। শীতল চাপে তৈরি তেল অধিক পুষ্টিগুণ অক্ষত রাখে এবং এটি বাজারে “এক্সট্রা ভার্জিন রাইস ব্র্যান তেল” নামে পরিচিত।
সয়াবিন নাকি সরিয়ার তেল কোনটি ভালো?
তেল পরিশোধন
তেল নিষ্কাশনের পর এটি পরিশোধনের মাধ্যমে বিশুদ্ধ করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় তেল থেকে অবাঞ্ছিত উপাদান যেমন- মোম, ফসফোলিপিড এবং অন্যান্য অবশিষ্ট দ্রব্য সরানো হয়। পরিশোধনের প্রক্রিয়ায় তেল থেকে দুর্গন্ধ দূর করা হয় এবং এর স্বচ্ছতা ও মান উন্নত করা হয়।
- ডেগামিং: এই পর্যায়ে তেল থেকে ফসফ্যাট এবং মেটাল কমপ্লেক্স অপসারণ করা হয়।
- ডিওডোরাইজেশন: একটি উচ্চ তাপমাত্রার ভ্যাকুয়াম চেম্বারে তেল রেখে এর গন্ধ কমানো হয়।
- ডেভ্যাক্সিং: তেল শীতল তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করে মোমের মতো উপাদানগুলো আলাদা করা হয়।
প্যাকেজিং ও বিতরণ
তেল পরিশোধনের পর সেটি বোতলজাত করে বাজারে সরবরাহ করা হয়। বিভিন্ন ব্র্যান্ড এ তেলটি বিক্রি করে এবং এটির গুণাগুণ ও বিশুদ্ধতা নিশ্চিত করার জন্য যথাযথ পরীক্ষা করা হয়। রাইস ব্র্যান তেল সাধারণত উচ্চ ধূমায়িত তাপমাত্রার জন্য রান্নায় নিরাপদ এবং বিভিন্ন ধরনের রেসিপিতে এটি ব্যবহার করা হয়।
রাইস ব্র্যান তেল কেন খাবেন?
রাইস ব্র্যান তেল হলো স্বাস্থ্যকর ফ্যাটের একটি সমৃদ্ধ উৎস, যা হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস, কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ এবং বিভিন্ন শারীরিক সমস্যার সমাধানে বিশেষ ভূমিকা রাখে। এটি ভিটামিন ই, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের মতো উপাদানে ভরপুর, যা শরীরের বিভিন্ন কার্যক্রম সঠিকভাবে পরিচালনা করতে সহায়ক।
এর উচ্চ ধূমায়িত তাপমাত্রার কারণে, এটি রান্নার জন্য নিরাপদ এবং স্বাস্থ্যকর বিকল্প হিসেবে পরিচিত। নিচে রাইস ব্র্যান তেলের বিভিন্ন উপকারিতা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো:
হৃদরোগের ঝুঁকি হ্রাস করে
রাইস ব্র্যান তেলে ওরিজানল নামক একটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে, যা খারাপ কোলেস্টেরল (LDL) কমাতে সহায়ক এবং ভালো কোলেস্টেরল (HDL) বাড়াতে সাহায্য করে। এটি হৃদযন্ত্রকে সুরক্ষিত রাখে এবং হার্ট অ্যাটাক, স্ট্রোক এবং অন্যান্য হৃদরোগের ঝুঁকি কমায়। এই তেলটি নিয়মিত খেলে রক্তনালীর সংকোচন ও ব্লকেজের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
রাইস ব্র্যান তেল খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে, রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এতে থাকা ফাইটোস্টেরল এবং ওমেগা-৬ ও ওমেগা-৯ ফ্যাটি অ্যাসিড হৃদযন্ত্রের জন্য উপকারী এবং শরীরে কোলেস্টেরল উৎপাদন কমাতে কাজ করে। ফলস্বরূপ, এটি কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্যতম স্বাস্থ্যকর তেল হিসেবে বিবেচিত।
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ
রাইস ব্র্যান তেল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ, যা শরীরকে ফ্রি র্যাডিক্যাল থেকে রক্ষা করে। ফ্রি র্যাডিক্যাল শরীরের কোষগুলোকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে এবং বার্ধক্যের প্রক্রিয়া দ্রুততর করতে পারে। তেলে থাকা ভিটামিন ই এবং গামা-ওরিজানল অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে, যা কোষগুলোকে সুরক্ষিত রাখে এবং শরীরকে তরুণ ও সক্রিয় রাখে।
নিয়মিত ত্বকের যত্নে সূর্যমুখী তেল কীভাবে কাজ করে
ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
রাইস ব্র্যান তেল মনো-আনস্যাচুরেটেড এবং পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটে সমৃদ্ধ, যা ওজন নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। এই তেলে থাকা স্বাস্থ্যকর ফ্যাট দ্রুত পেট ভরতি রাখে, ফলে অতিরিক্ত খাওয়ার প্রবণতা কমায়। এছাড়া, এতে থাকা উপাদানগুলো বিপাক ক্রিয়াকে উন্নত করে, যা শরীরের অতিরিক্ত চর্বি পুড়িয়ে ফেলে ও ওজন কমাতে সহায়ক।
ত্বকের জন্য উপকারী
রাইস ব্র্যান তেল ত্বকের জন্যও অত্যন্ত উপকারী। এতে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ই এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা ত্বকের আর্দ্রতা বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং ত্বককে নরম ও মসৃণ রাখে। এটি সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে ত্বককে সুরক্ষিত রাখে এবং বলিরেখা ও বার্ধক্যের লক্ষণ হ্রাস করে। ত্বকের প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতা বজায় রাখতে রাইস ব্র্যান তেল নিয়মিত ব্যবহার করা যেতে পারে।
চুলের স্বাস্থ্য উন্নত করে
রাইস ব্র্যান তেল চুলের গোড়ায় পুষ্টি প্রদান করে এবং চুলকে শক্তিশালী করে তোলে। এতে থাকা ভিটামিন ই এবং ফ্যাটি অ্যাসিড চুলের শুষ্কতা দূর করে এবং চুলকে নরম ও উজ্জ্বল রাখে। নিয়মিত রাইস ব্র্যান তেল ব্যবহারে চুল পড়া কমে এবং চুলের বৃদ্ধি উন্নত হয়। এছাড়া, খুশকির সমস্যা কমাতেও এ তেল কার্যকরী।
হজম প্রক্রিয়া উন্নত করে
রাইস ব্র্যান তেল হজম প্রক্রিয়াকে উন্নত করে এবং অন্ত্রের স্বাস্থ্যের উন্নতিতে সহায়ক। এতে থাকা ফ্যাটি অ্যাসিড এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট অন্ত্রের প্রদাহ কমিয়ে হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে। এটি কোষ্ঠকাঠিন্যের সমস্যা দূর করে এবং হজম প্রক্রিয়ায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক
রাইস ব্র্যান তেলে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং ফাইটোকেমিক্যাল থাকে, যা ক্যান্সারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সহায়ক। বিশেষ করে, তেলটি স্তন ক্যান্সার ও কোলন ক্যান্সারের ঝুঁকি কমাতে পারে বলে বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে। এতে থাকা ওরিজানল এবং টোকোফেরল ক্যান্সার কোষের বৃদ্ধি প্রতিরোধে সহায়ক।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক
রাইস ব্র্যান তেল রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, ফলে ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য এটি অত্যন্ত উপকারী। এতে থাকা গামা-ওরিজানল ইনসুলিনের কার্যকারিতা বাড়ায় এবং রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখে। এ কারণে এটি ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার জন্য একটি ভালো বিকল্প।
উপসংহার
আপনি হয়তো এতক্ষণে বুঝে গেছেন যে রাইস ব্র্যান তেল কেন খাবেন। কারণ এই তেল শুধু পুষ্টিগুণেই নয়, এর বহুমুখী ব্যবহারের জন্যও বিশেষভাবে সমাদৃত। এর উচ্চ পুষ্টিমূল্য, হৃৎপিণ্ডের জন্য সুরক্ষামূলক গুণাবলি এবং ক্যান্সার প্রতিরোধ ক্ষমতা এটিকে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছে।
নিয়মিত রাইস ব্র্যান তেল গ্রহণ করলে হৃদরোগের ঝুঁকি কমে, ওজন নিয়ন্ত্রণে সাহায্য হয় এবং ত্বক ও চুলের স্বাস্থ্য উন্নত হয়। তাই এই তেলকে আমাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা আমাদের দীর্ঘমেয়াদী সুস্থতার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।