মধু হলো সৃষ্টিকর্তার পক্ষ্য থেকে আমাদের জন্য সেরা একটি খাবার। মধু কে বলা হয় প্রাকৃতিক খাবার। এটি কোনো মানবসৃষ্ট খাবার নয়। ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৌমাছিরা যেনো পরম যত্নে আমাদের জন্য এই মধু তৈরি করে। স্বাভাবিক ভাবে মধু একটি খাবার মনে হলেও আদতে এটি একটি মহাঔষুধ এমনকি সুপারফুড ও বলতে পারেন। মধুতে রয়েছে ৪৫ টির এরও অধিক পুষ্টিউপাদান যা আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারি।
নিয়মিত মধু খেলে আপনি অনেক রোগমুক্তি পাবেন। সেই প্রাচীন কাল থেকে মধুর গুনাগুন অক্ষত অবস্থায় রয়েছে। শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ যেকোনো বয়সী মানুষের শরীরের জন্যই মধু অনেক উপকারি। আজ আমরা জানবো মধু খাওয়ার উপকারিতা এবং কীভাবে মধু খেলে সবচেয়ে বেশি উপকারিতা পাবেন, এই সকল বিষয়ে বিস্তারিত।
মধু কী
আপনাকে যদি জিজ্ঞেস করা হয় মধু কী? আপনার মাথায় সর্বপ্রথম কি আসবে বলুন তো? একটা মীষ্টি তরল খাবার তাইতো! হ্যাঁ মধু হলো সেরা মিষ্টি তরল খাবার। মৌমাছি ও কিছু পতঙ্গ বিভিন্ন ফুলের নির্যাস থেকে মধু সংরহ করে থাকে। ছোটবেলায় মৌমাছির চাক নিশ্চয় দেখেছেন। খালি চোখে দেখতে গেলে কি ভয়ংকর তাইনা? অথচ এই চাক কাটলেই দেখা মেলে স্বুস্বাদু মধুর। টাটকা মধুর ঘ্রান টাও যেমন সুন্দর সেই সাথে এর স্বাদের কথা ও নতুন করে বলার কিছু নেই। মধু তে রয়েছে ৪৫ টির এর বেশী পুষ্টি উপাদান। এর মাঝে সবচেয়ে বেশি পরিমানে রয়েছে গ্লুকোজ এবং ফ্রুক্টোজ।
মধু খেলে কি হয়
মধুকে বলা হয় প্রাকৃতিক এন্টোবায়োটিক। নিয়মিত মধু খেলে এটি শরীরের জন্য অনেক উপকারি। স্বাস্থ্য উপকারিতার পাশাপাশী রূপচর্চা তে বহুল ব্যবহৃত এই মধু। মধুতে রয়েছে গ্লুকোজ, ফ্রুক্টোজ, অ্যাামাইনো এসিড, খনিজ উপাদান ইত্যাদি। চলুন জেনে নেওয়া যাক মধু খেলে কি কি উপকারিতা পাওয়া যাবে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি
মধু তে রয়েছে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট। বিশেষ করে মধুতে উপস্থিত ফেনোলিক অ্যাান্টি-অক্সিডেন্ট আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারি। এটি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে এছাড়া শরীরের ইন্সট্যান্ট এনার্জি এর যোগান দিতে ও সাহায্য করে।
হজম ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে
আমরা সারাদিনে যেই খাবার খাই সেটির সঠিক পুষ্টিগুন পাওয়ার জন্য সঠিক হজম প্রক্তিয়া খুবই গুরুত্বপূর্ন। হজমে গড়মিল হওয়া মানেই অসুস্থ্যতার সৃষ্টি। তাই দৈনিক খাবার তালিকায় আমাদের এমন কিছু খাবার রাখা উচিত যেগুলো আমাদের হজম ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। এমন একটি খাবার হলো মধু। মধু তে থাকা শর্করা খুব সহজেই আমাদের রক্তের সাথে মিশে যায় এবং হজম ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
কোষ্টকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে
অনেক সময় হজমের সমস্যার কারনে মারাত্বক কোষ্টকাঠিন্য এর সমস্যা দেখা যায়। বিশেষ করে দীর্ঘদিন এই কোষ্টকাঠিন্য এর কারনে অনেকের পাইলস এর সমস্যা দেখা যায়। মধু আমাদের হজম ক্ষমতা বাড়ানোর পাশাপাশি কোষ্টকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। নিয়মিত মধু ও ইসবগুলের ভুষি শরবত বানিয়ে খেতে পারেন।
নতুন রক্ত গঠনে সাহায্য করে
মধু তে রয়েছে ম্যাঙ্গানিজ, লৌহ এবং কপার যা আমাদের রক্তের হিমোগ্লোবিন গঠনে সাহায্য করে থাকে। তাই যারা রক্তশূন্যতার সমস্যায় ভুগছেন তারা নিয়মিত মধু খেতে পারেন।
অতিরিক্ত মেদ ঝরাতে সাহায্য করে
মধু তে কোনো চর্বি বা ফ্যাট নেই। মধু দীর্ঘক্ষন আমাদের পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। তাই ওজন নিয়ন্ত্রনে রাখার জন্য নিয়মিত মধু খেতে পারেন। বিশেষ করে সকাল লেবু ও মধু মিশ্রিত হালকা গরম পানি খেলে এটি শরীরের বাড়তি মেদ ঝরাতে সাহায্য করবে।
ঠান্ডা, কাশি কমাতে সাহায্য করে
মধু তে রয়েছে অ্যাান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাংগাল উপাদান। ফলে মধু সহজে আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে এবং সেই সাথে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়া থেকে আমাদের সুরক্ষা করে। ঠান্ডা কাশি দূর করার জন্য তুলসি পাতা রতের সাথে মধু মিশিয়ে খেলে উপকার পাওয়া যাবে।
অনিদ্রার সমস্যা কমাতে সাহায্য করে
মধু খেলে ঘুম ভালো হয়। এছাড়া মধু ও দুধ একসাথে খেলে এটি আমাদের অবসাদ কমাতে সাহায্য করে। রাতে নিয়মিত মধু খেলে এটি আপনার ভালো ঘুমের ক্ষেত্রে সাহায্য করবে।
গলার স্বর সুন্দর রাখে
মধু খেলে গলার স্বর পুরোপুরি সুন্দর হয়ে যাবে বিষয় টি এমন না তবে মধু গলার স্বরের পরিবর্তনে সাহায্য করে।
শ্বাসকষ্ট দূর করতে সাহায্য করে
শ্বাসকষ্ট, হাপানি সহ যেকোনো ফুসফুসজনিত সমস্যার সমাধানে মধু বেশ উপকারি। মধু তে থাকা অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান আমাদের ফুসফুস কে ভালো রাখতে সাহায্য করে। যারা হাপানি কিংবা শ্বাসকষ্ট এর সমস্যায় ভুগছেন তারা নিয়মিত মধু ও কালোজিরা খেতে পারেন। এছাড়া মধু এর সাথে লং খেলেও শ্বাস কষ্ট কিছুটা কম অনুভব হয়।
দাত ও মুখগহব্বরের স্বাস্থ্য ভালো রাখে
নিয়মিত মধু খেলে এটি আমাদের দাত কে মজবুত রাখে সেই সাথে সমস্ত মুখগহব্বরের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে। বিশেষ করে মাড়ির কোনো ক্ষত সারাতেও মধু বেশ ভালো কাজ করে।
পোড়া ভাব কমাতে সাহায্য করে
রোদে পোড়া ভাব অথবা আগুনে পোড়া ভাব কমাতে মধু বেশ উপকারি। এছাড়া ত্বকের বিভিন্ন ক্ষত সারাতে মধু দারুণ কাজ করে। মধু কে বলা হয় প্রাকৃতিক এন্টিসেপটিক।
যৌন ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে
পুরুষ অথবা মহিলাদের যৌন ক্ষমতা বৃদ্ধিতে মধু অনেক উপকারি। এটি শরীরে টেস্টেটোরেন হরমোন বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। বিশেষ করে মধুর সাথে কাচা রসুন মিশিয়ে খেলে সবচেয়ে বেশী উপকারিতা পাওয়া যায়। আবার আপনারা চাইলে গজানো রসুন বানিয়েও খেতে পারবেন।
বিভিন্ন বয়সের ছেলেদের মধু খাওয়ার উপকারিতা
ত্বক সুন্দর রাখে
মধু ত্বকের উজ্বলতা ও লাবণ্য ভাব বজায় রাখতে সাহায্য করে। নিয়মিত মধু খেলে এটি ত্বকের লাবণ্য ভাব বজায় রাখবে ত্বকে বয়সের ছাপ রোধ করতে সাহায্য করবে।
চূল সুন্দর রাখে
মুখের সৌন্দর্য্য এর পাশাপাশি চুলের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধির জন্যও মধুর কিন্তু অনেক উপকারিতা রয়েছে। মধু চুল একদম মাথার স্কাল্প থেকে পূষ্টি যোগাতে সাহায্য করে। সপ্তাহে একদিন মধুর তৈরি হেয়ারপ্যাক ব্যবহার করলে চুল অনেক বেশী সিল্কি ও শাইনি থাকবে।
শরীরে তাপ উৎপাদনে সাহায্য করে
নিয়মিত মধু খেলে এটি শরীরে ইন্সটান্ট শক্তির যোগান দিতে সাহায্য করবে সেই সাথে শরীরে তাপ উৎপাদন করতে সাহায্য করে। শীতকালে মধু খেলে এটি শরীর গরম রাখতে সাহায্য করবে।
হাড়ের গঠন মজবুত রাখে
মধু তে রয়েছে বিভিন্ন খনিজ উপাদান। মধু খেলে এই খনিজ উপাদান গুলোর কারনে আমাদের শরীরে হাড়ের গঠন মজবুত হয়।
বাতের ব্যাথা উপশমে সাহায্য করে
মধু তে থাকা অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট ও অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি উপাদান বাতের ব্যথা কমাতে সাহায্য করে। মধু এবং দারুচিনি মিশ্রিত পানি খেলে খুব অল্প সময়েই ব্যাতের ব্যথা কমে যায়।
মধু খাওয়ার সময়
মধু খাওয়ার কোনো উপযুক্ত সময় নেই। আপনি চাইলে যেকোনো সময় মধু খেতে পারবেন। তবে যদি ওজন কমাতে চান সেক্ষেত্রে সকালে খালি পেটে মধু ও লেবু পানি খেতে পারেন। অথবা চিনির বিকল্প হিসেবে সকালে রুটি কিংবা পরটার সাথে মধু খেতে পারেন। এছাড়াও আপনি যদি রাতে ভালো ঘুম পেতে চান সেক্ষেত্রে রাতে এক গ্লাস গরম দুধের সাথে মধু মিশিয়ে খেতে পারেন। এছাড়া বিকেলে চা এর সাথে মধু মিশিয়ে খেতে পারেন। মোট কথা যত টা সম্ভব চিনি এভোয়েড করুন এবং চিনির বিকল্প হিসেবে মধু খাওয়া শুরু করুন।
মধু বিষয়ে পরামর্শ
মধুর সঠিক উপকারিতা পেতে হলে আপনাকে খাটি মধু খেতে হবে। বর্তমানে বাজারে দুই ধরনের মধু পাওয়া যায় ।
- পরিশোধিত মধু (Processing Honey)
- অপরিশোধিত মধু (Raw honey)
পুষ্টিউপাদান ও দামের কথা চিন্তা করলে এই মধু গুলো একটি আরেকটির চেয়ে আলাদা। পরিশোধিত মধুর চেয়ে অপরিশধিত মধুতে পুষ্টিগুনের মাত্রা বেশি। তাই বাজার থেকে মধু কেনার সময় এই বিষয় টি লক্ষ্য রাখবেন। এছাড়াও বর্তমানে বাজারে ভেজাল মিশ্রিত মধুর পরিমান তাও অনেক বেশি। তাই মধু কেনার সময় অবশ্যই সতর্ক অবস্থায় থাকবেন এবং যাচাই বাছাই করে মধু কিনবেন। মনে রাখবেন খাটি মধু যেমন আমাদের শরীরের জন্য অনেক উপকারি ঠিক তেমনি ভেজাল মিশ্রিত মধু খেলে আমাদের অনেক ক্ষতি ও হতে পারে। তাই অবশ্যই নিরাপদ খাবার খান, সুস্থ্য থাকুন।
উপসংহার
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৌমাছিরা দীর্ঘ সময় যাবত বিভিন্ন ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে। ফুল থেকে সংগ্রহ করা নেকটার গুলো মৌমাছিরা প্রথমে খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে আর বাকিটা মধু হিসেবে জমা হয়ে যায়। সম্পূর্ন প্রসেস টা কিন্তু মৌমাছিরা একাই করে। মধুর উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানার পর চেষ্টা করবেন দৈনিক অন্তত ১-২ চা চামচ মধু খাওয়ার জন্য। পরিবর্তন টা নিজেরাই বুঝতে পারবেন। সুস্থ্য থাকার জন্য স্বাস্থ্যকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই আর মধু হলো ঠিক তেমনি একটি স্বাস্থ্যকর খাবার। তাই স্বাস্থ্যকর খাবার নিজে খান ও পরিবারকেও খেতে উৎসাহিত করুন।