রমজান এবং ঈদ কে কেন্দ্র করে বাঙালিদের ঘরে আয়োজন করা নানা পদের বাহারি সব খাবারের। এর মাঝে মিষ্টি খাবারের মধ্যে অন্যতম জনপ্রিয় হলো লাচ্ছা সেমাই।দুধ ও চিনি দিয়ে তৈরি এই সেমাই আমাদের সকলের ই ভীষণ পছন্দের একটি ডেসার্ট আইটেম। তবে এই লাচ্ছা সেমাই ঈদ ও রমজান ছাড়াও বিভিন্ন উৎসব-আয়োজনে রান্না করা হলেও এই সেমায়ের বিশেষ প্রস্তুতপ্রণালী ও ইতিহাস সম্পর্কে কি আমরা জানি? চলুন তবে আজ জেনে নেওয়া যাক কীভাবে এবং কোথায় থেকে এলো এই লাচ্ছা সেমাই!
লাচ্ছা সেমাই কী?
সেমাই মূলত একটি মিষ্টি জাতীয় খাবার। ময়দার ফালিকে চিকন চিকন সুতোতে পরিণত করে বানানো হয় এই সেমাই। যা পরবর্তী তে দুধ এবং চিনি মিশিয়ে রান্না করলেই মজাদার মিষ্টি খাবারে পরিণত হয়। বাংলাদেশে খুবই জনপ্রিয় এই সেমাই। বিশেষ করে রমজান এবং ঈদে এই সেমাইয়ের কদর বেড়ে যায় বহুগুণে। সেমাই মূলত দুই প্রকার।
১) খিল সেমাই।
২) লাচ্ছা সেমাই।স্বাদ বিবেচনায় বাঙ্গালীদের পছন্দের শীর্ষে রয়েছে লাচ্ছা সেমাই। লাচ্ছা সেমাইয়ের বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো এটি একদম চিকন একটি সেমাই। সেই সাথে খুব সহজে এবং অল্প সময়েই এটি রান্না করা যায়।
লাচ্ছা সেমাইয়ের উৎপত্তি
রমজান এবং ঈদ উপলক্ষে লাচ্ছা সেমাই ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশে জনপ্রিয় হলেও এর উৎপত্তি এবং নাম নিয়ে নানান মতভেদ রয়েছে।অনেকের মতে এটি একটি পার্সিয়ান খাবার যেটি মোঘলদের হাতে ধরে সূচনা হয়েছে।পার্সিয়ান এই খাবার টি রেস্তেহ নামে পরিচিত।তবে এই রেস্তেহ এর সাথে সেমাইয়ের আকৃতি গত সাদৃশ্য থাকলেও স্বাদের রয়েছে বিশাল পার্থক্য। অন্যদিক আরবি শব্দ ‘লম্বুতদার’ রাজধানী ঢাকার আদি নাগরিকদের মুখে ‘লাচ্ছাদার’ উচ্চারিত হতো। ‘লম্বুতদার এবং লাচ্ছাদার দুইটা শব্দের অর্থ হলো ‘সুস্বাদু’। তাই ধারনা করা হয় ঢাকায় আসা অবাঙালি অথবা আদি ঢাকাইয়া দের হাত ধরেই এর লাচ্ছা সেমাইয়ের উৎপত্তি এবং লাচ্ছাদার শব্দ থেকেই মূলত লাচ্ছা সেমাই নামকরণ হয়েছে।
যেভাবে তৈরি করা হয় এই মজার লাচ্ছা সেমাই!
সকল সেমাইয়ের মাঝে লাচ্ছা সেমাই তৈরির প্রসেস টা একটু বেশীই সময়সাপেক্ষ এবং জটিল। পারফেক্ট লাচ্ছা সেমাই তৈরির জন্য প্রথমেই প্রয়োজন দক্ষ কারিগর। দক্ষ কারিগর ছাড়া কখনোই পারফেক্ট স্বাদের সেমাই তৈরি সম্ভব না।ময়দা থেকে কারিগরদের সুনিপুণ কাড়িসই তৈরি হয় এই লাচ্ছা সেমাই। লাচ্ছা সেমাই তৈরি এর জন্য প্রথমে ময়দা এর সাথে পানি মিশিয়ে ময়দার খামির তৈরি করা হয়।এই খামির টি কিন্তু সাধারণ রুটি তৈরির খামিরের মতো নাহ। সঠিক মাত্রার পানি এবং ময়দা মিশিয়ে এটিকে বেশ লম্বা সময় ধরে মাখিয়ে খামির তৈরি করে নিতে হয়। এরপর সেই খামির কে ঘি মাখিয়ে কিছুক্ষণের জন্য রেখে দেওয়া হয়। এতে করে খামির টি নরম থাকে বেশ খানিক টা সময়ের জন্য। খামির রেডি হওয়ার পর শুরু হয় কারিগরদের আসল কারিশমা। ময়দার সেই খামির কে সুনিপুণ হাতে সুকৌশলে হ্যাঁচকা টান দিতে হয় প্রায় ৯ বার। আর সুনিপুণ হাতে এই ৯ টানেই ময়দা গুলো চিকন চিকন সুতোর রূপ ধারণ করে।সেমাই যতো চিকন হয় , সেমাইয়ের স্বাদ ততো বৃদ্ধি পায়। এরপর এই চিকন সেমাই গুলো ঘি/ ডালডা তে ভেজে অতিরিক্ত তেল ঝড়িয়ে প্যাকেট-জাত করা হয়।
রমজান ও ঈদে লাচ্ছা সেমাইয়ের চাহিদা বেশি কেন?
ঈদের আনন্দের সাথে সেমাই জেনো একে অপরের পরিপূরক। সেমাই ছাড়া ঈদ কল্পনায় করা যায় নাহ।হাদিসে উল্লেখিত আছে, ঈদের দিনে মিষ্টি খাবার খেয়ে নামাজ আদায় করা সুন্নত। আর ঠিক সে কাড়নেই হয়তো ধর্মপ্রাণ মুসল্লিরা ইদের দিনের মিষ্টি আইটেম হিসেবে সেমাইকে বেছে নিয়েছে। এছাড়াও চটজলদি এবং খুব সহজেই তৈরি করা যায় এই সুস্বাদু এই লাচ্ছা সেমাই। সারা দিন রোজা রাখার পর ইফতারিতে প্রয়োজন একটি ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা মিষ্টি ডেসার্ট আইটেম। আর এই ডেসার্ট আইটেম হিসেবে লাচ্ছা সেমাইয়ের অপশন টা সবচেয়ে বেস্ট
বগুড়ার বিখ্যাত লাচ্ছা সেমাই
লাচ্ছা সেমাই সারা বাংলাদেশে জনপ্রিয় হলেও বগুড়ার চিকন সেমাইয়ের কদর বহুদিনের। প্রায় অর্ধশত বছর ধরে বগুড়াতে এই লাচ্ছা সেমাই কে ঘিরে প্রতি রমজানে কোটি কোটি টাকার ব্যবসা হয়ে থাকে। যুগ যুগ ধরের বগুড়ার দই, মিষ্টি এবং কটকটি এর পাশাপাশি বগুড়ার ঐতিহ্য কে ধরে রেখেছে এই চিকন লাচ্ছা সেমাই। এমনকি বগুড়ার এই লাচ্ছা সেমাইয়ের কদর এতো বেশী যে শুধু দেশেই না বরং বিদেশেও খ্যাতি ছড়িয়েছে এই লাচ্ছা সেমাই। বগুড়ার শেওলাগাতি, বেজোরা, সাবগ্রাম, ঘাটপাড়া তে রয়েছে বহু পুরনো সেমাই পল্লি
লাচ্ছা সেমাই এর দাম
লাচ্ছা সেমাই মূলত দুই প্রকার। একটি হলো ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাই এবং অন্যটি হলো ডালডা ভাজা লাচ্ছা সেমাই। কোয়ালিটি হিসেবে এই সেমাই গুলো আলাদা আলাদা প্রাইজের হয়ে থাকে। সচরাচর ডালডা ভাজা লাচ্ছা সেময়ের চেয়ে ঘিয়ে ভাজা লাচ্ছা সেমাইয়ের দাম টা তুলনামূলক বেশী। অন্যদিক কোম্পানি হিসেবেও সেমাইয়ের দামের পার্থক্য হয়ে থাকে।মূলত বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য নিয়ে তৈরি করা সেমাইয়ে খুব বেশী স্বাস্থ্যসম্মত পরিবেশ মেইনটেইন করা হয় নাহ। তাই সেমাই কেনার আগে যাচাই বাছাই করেই প্রডাক্ট কেনা সবচেয়ে ভালো। বাজারে জনপ্রিয় কিছু লাচ্ছা সেমাই এর ব্যান্ড হলোঃ প্রাণ, বনফুল, কুলসুম,বসুন্ধরা ইত্যাদি। এছাড়াও বর্তমানে অনলাইনে বিভিন্ন ফেসবুক পেজে সম্পূর্ণ নিজস্ব তত্বাবধানে বগুড়ার লাচ্ছা সেমাই তৈরি করা হয়, যেমনঃ বিন্নিফুড। কোয়ালিটি হিসেবে এসব লাচ্ছা সেমাইয়ে প্রাইজ শুরু হয় ১০০০ থেকে ১৬০০ টাকা অব্দই। অবশ্য এর চেয়ে কম দামেও লোকাল বাজারে লাচ্ছা সেমাই পাওয়া যেতে পারে। তবে সেগুলো কোয়ালিটি অথবা টেস্ট কোনোদিক দিয়েই সেরা হবে নাহ।