একবার রাস্তা দিয়ে যাওয়ার পথে চোখ আটকে গেলো ফুটপাতের একটি দোকানে। অসম্ভব রকমের সুন্দর লাল টুকটুকে একটি ফলের দিকে। অবশ্য এটি ফল নাকি সবজি এটি আমি তখনো নিশ্চিত ছিলাম না। ড্রাগন ফলের মতোই দারুণ তার রং।
বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন এটির নাম “বিটরুট”। বাংলাদেশে খুব একটা পরিচিত না এই বিটরুট। তাই অনেকেই জানেন না কি এই বিটরুট, কীভাবে খাবেন এই বিটরুট বা এই বিটরুটের উপকারিতা কি? আজকের এই লেখার মাধ্যমে আমি আপনাদের বিটরুট সম্পর্কে বিস্তারিত জানাবো।
বিটরুট ফল নাকি সবজি?
বিটরুট – Beetroot হলো ভিটামিন এবং খনিজ উপাদানে ভরপুর একটি সবজি। তবে দেখতে ড্রাগন ফলের মতো লাল টুকটুকে এবং আকর্ষণীয় হওয়ার কারণে অনেকেই এটিকে ফল ভেবে থাকেন। শুধু ফল ভেবেই যে চুপ করে থাকে মানুষ তাও না। রসালো ফলের মতো করেই বেশ মজা করে খেয়ে থাকে।
এই সবজি তার অপরূপ সৌন্দর্যের পাশাপাশি মানবদেহের জন্য ও অনেক উপকারী। বিটরুটে থাকা ভিটামিন, আয়রন, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, জিংক এবং কপার থেকে আমরা মানবদেহের জন্য সকল প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান পেয়ে থাকি। ফলে দিন দিন এটি অন্যতম সুপার ফুড হিসেবে পরিচিতি পেয়ে যাচ্ছে।
অর্গানিক ফুড কি? এর তালিকা এবং অর্গানিক ফুড বনাম নরমাল ফুড
শালগম ও বিটরুট কি একই?
অনেকেই বিটরুট কে শালগম বা শালগম কে বিটরুট মনে করে থাকেন। অর্থাৎ দেখতে একই হলেও দুই টা দুই রকম পুষ্টি উপাদানে ভরপুর। শালগম এবং বিটরুট বাহির থেকে দেখলে কিছুটা একই রকম মনে হলেও এগুলো আলাদা আলাদা প্রজাতি।
শালগমের বৈজ্ঞানিক নাম হলো “ Brassica Rapa”। শালগমের ছোট এবং ভালো জাতটি সাধারণত মানুষ সবজি হিসেবে খেয়ে থাকে এবং বড় আকারের শালগম পশু খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে বিটরুট এর বৈজ্ঞানিক নাম হলো “Beta vulgaris”। বিটরুট সাধারণত সবজি হিসেবে খাওয়া হয়।
বিটরুটের উপকারিতা
বিটরুট দেখতে তাজা লাল বর্ণের হয়। এর বাহিরের চেয়েও ভেতর টা দেখতে বেশি লাল হওয়ার কারণে অনেকেই মনে করে এটি খেলে রক্ত ভালো রাখে ও শরীরে রক্ত বৃদ্ধি পাবে। সত্যি বলতে এটি শুধু যে রক্ত স্বল্পতা দূর করে এমন না। এতে থাকা পুষ্টিগুণ শরীরের অনেক উপকার করে। যেমন –
- নিয়মিত বিটরুট খেলে এটি লিভার সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।
- বীটরুট চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
- বিটরুট ত্বকের উজ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- বিটরুটে রয়েছে প্রচুর পরিমাণ আয়রন, যা রক্তশূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে।
- বিট রুট উচ্চ রক্তচাপ এবং রক্তে শর্করার পরিমাণ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- এটি একটি আঁশ জাতীয় খাবার। তাই যারা হজম সমস্যায় ভুগছেন তারা নিয়মিত বিটরুট খেতে পারেন।
- বিটরুট মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল বাড়িয়ে দেয় এবং ব্লাড সুগার ঠিক রাখে । তাই মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে নিয়মিত বিটরুট খেতে পারেন।
- পরিমিত পরিমাণ বিটরুট খেলে এটি শরীর থেকে টক্সিক উপাদান দূর করতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত বিটরুট খেলে পিত্তথলি এবং কিডনিতে পাথর জমা হওয়ার সমস্যা থেকে মুক্তি পাবেন ।
রূপচর্চায় বিটরুট
- বিটরুট আমাদের ত্বকের রোদে পোড়া দাগ দূর করতে এবং ত্বকে ইন্সট্যান্ট একটা পিংক গ্লো আনতে সাহায্য করে। বিটরুটের রস কিছুক্ষণ ফ্রিজে রেখে স্কিনে ব্যবহার করতে পারেন।
- বিট রুটের জুস, সামান্য কস্তুরী হলুদ এবং মুলতানি মাটি মিক্সড করে ত্বকে ব্যবহার করলে এটি ত্বকের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করবে।
- অনেকেই চুলে খুশকি হওয়া, চুল রুক্ষ হয়ে যাওয়া এবং চুলে জট পাকানো সমস্যায় ভুগছেন। তারা সপ্তাহে অন্তত ১ দিন চুলের গোড়ায় নারিকেল তেল ম্যাসেজ করে এরপর বিটের রস ব্যবহার করবেন। ৩০ মিনিট পর মাইল্ড কোনো শ্যাম্পু দিয়ে চুল ধুয়ে ফেলবেন। ব্যাস ঝলমলে চুলের জৌলুস দেখে নিজেই চুলের প্রেমে পড়বেন।
- আমরা অনেকেই মেকআপ তোলার জন্য বিভিন্ন রকমের মেকআপ রিমুভাল টোনার ব্যবহার করে থাকি। এক্ষেত্রে বিট জুস ব্যবহার করতে পারেন। ফ্রিজে রাখা বিট জুস তুলোর সাহায্যে মুখে ব্যবহার করে কিছুক্ষণ রেখে মুখ ধুয়ে ফেলবেন। এতে মেকআপ তো পরিষ্কার হবেই সাথে স্কিনেও পর্যাপ্ত ভিটামিন সরবরাহ হবে।
বিটরুট কীভাবে খাবেন!
বিটরুট যেহেতু একটি উপকারী সবজি তাই এটি কাঁচা অথবা রান্না করেও খেতে পারেন। তবে কাচা বিটরুটের উপকারিতা সবচেয়ে বেশী। জুস অথবা সালাদ হিসেবেও খেতে পারেন এই বিটরুট। এছাড়া বিভিন্ন সবজির সাথে মিশিয়ে অথবা শুধু বিটরুট ও রান্না করে খেতে পারবেন।
বিটরুট কি ওজন কমাতে সাহায্য করে?
বিটরুট আমাদের শরীরে দ্রুত হজম হয়।বিটরুটের জুস আমাদের শরীরে বিপাকের হার বাড়াতে সাহায্য করে। ফলে শরীর থেকে অতিরিক্ত ফ্যাট কমাতে বিটরুট খুবই কার্যকরী।
বিটরুট কোথায় পাওয়া যায়?
ধারণা করা হয় জার্মান বা ইতালি সহ ইউরোপের উত্তরপূর্ব অঞ্চলে এই বিটরুটের উৎপত্তি। তবে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, হরিয়ানা, উত্তর প্রদেশ এবং মহারাষ্ট্রে বর্তমানেও বিপুল পরিমাণে বিটরুট চাষ করা হয়। বিটরুট একটি শীতকালীন সবজি হলেও বর্তমানে দেশের বিভিন্ন সুপার শপে সারা বছরই এই বিটরুট পাওয়া যায়।
বিটরুটের দাম কত?
বিটরুট অন্যান্য সবজির মতো খুব একটা পরিচিত না আমাদের কাছে। তাই আমরা অনেকেই এটির দাম সম্পর্কে জানি না। যেহেতু এটি একটি মৌসুমি সবজি তাই শীতকালীন সময়ে এটি তুলনামূলক কম দামেই হাতের নাগালে পাওয়া যায়। শীতকালে এলাকা ভেদে এই সবজির দাম ১০০-২০০ টাকা অবধি হয়ে থাকলেও মৌসুম ফুরিয়ে গেলেই এই বিটরুট এলাকাভেদে ৩০০-৫০০ টাকা দরে বিক্রি করা হয়।
ডায়াবেটিকস রোগীরা কি বিটরুট খেতে পারবেন?
বিটরুটের রয়েছে প্রচুর পরিমাণে শর্করা এবং এটি খেতেও কিছুটা মিষ্টি। এই কারণে অনেকেই ভেবে থাকেন বিটরুট খেলে ডায়াবেটিকস রোগিদের রক্তে সুগারের মাত্রা টা বেড়ে যায়। কিন্তু বাস্তবিক ভাবে বিটরুট হলো ভিটামিন, আয়রন ও খনিজ উপাদানে ভরপুর একটি পুষ্টি ভাণ্ডার। বিটরুটে রয়েছে নাইট্রেট।
যা নাইট্রিক অক্সাইডে রূপান্তরিত হয় এবং এটি রক্তনালী প্রসারিত করে এবং আমাদের রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ফলে ডায়াবেটিকস রোগিদের জন্য বেশ উপকারী এই বিটরুট। তাই যাদের ডায়বেটিস রয়েছে তারা সামান্য পরিমাণে জুস করে খেতে পারেন বা সালাদ অথবা সবজি হিসেবে খেতে পারেন।
বিটরুটের মজাদার রেসিপি
বিটরুট দিয়ে তৈরি করা যায় মজাদার সব জুস ও সালাদ। চলুন তবে সহজ কিছু রেসিপি জেনে নেওয়া যাক।
বিট ও গাজরের জুস
বিটরুট এবং গাজরের জুস শরীর থেকে টক্সিক দূর করতে এবং স্কিনের উজ্জ্বলতা বাড়াতে সাহায্য করে।
উপকরণ
- বিটরুট
- গাজর
- সামান্য লবণ
- পানি
- পুদিনা পাতা
- লেবু
প্রস্তুতপ্রনালি
প্রথমে বিট, গাজর, পানি এবং পুদিনা পাতা একসাথে ব্লেন্ড করে নিন। এরপর এটিকে একটি গ্লাসে ঢেলে সামান্য লবণ ও লেবুর রস মিশিয়ে বরফ দিয়ে পরিবেশন করুন।
বিট ও ডালিমের জুস
ডালিম রক্তে হিমোগ্লোবিন এর মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে ।
উপকরণ
- বিট
- ডালিম
- সামান্য লবণ
- পানি
প্রস্তুতপ্রনালি
প্রথমে বিট এবং ডালিম এর সাথে সামান্য পানি মিশিয়ে এটিকে ব্লেন্ড করে নিন। এরপর এতে লবণ ও লেবুর রস মিশিয়ে পরিবেশন করে নিন।
বিটরুট ও টমেটোর জুস
টমেটো এবং বিটে থাকা এন্টিঅক্সিডেন্ট শরীরে রক্ত সঞ্চালন এর মাত্রা বাড়াতে সাহায্য করে।
উপকরণ
- বিট
- টমেটো
- লেবুর রস
- পুদিনা পাতা
- লবণ
প্রস্তুতপ্রনালি
বিট , টমেটো এবং পুদিনা পাতা একসাথে ব্লেন্ড করে নিতে হবে। এরপর এর সাথে লবণ ও লেবুর রস এড করে নিয়ে উপভোগ করুন ঠান্ডা ঠান্ডা জুস।
বিটরুটের সালাদ
শুধু বিটরুট কিংবা বিটরুটের সাথে বিভিন্ন সবজি মিশিয়েও মজাদার সালাদ তৈরি করা যায়। এক্ষেত্রে বিটরুটের সাথে শসা, গাজর , টমেটো, বাঁধাকপি ,লেটুস পাতা এবং সামান্য টক দই মিশিয়ে নিলেই রেডি মজাদার সালাদ।
বিটরুটের শেক (Shake)
সামান্য দুধ, কলা, বিটরুট এবং মাখন একসাথে ব্লেন্ড করে শেক বানিয়েও খেতে পারেন। এটি শরীরে এক্সট্রা এনার্জি পেতে সাহায্য করবে।
উপরিউক্ত আলোচনায় বিটরুট কি, উপকারিতা, কি কি কাজে লাগে এবং রুপচর্চায় এর ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।