ঈদ মুসলিম বিশ্বে একটি মহা আনন্দের উৎসব, যা ধর্মীয় উৎসব হিসেবে পরিচিত হলেও তার একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো খাদ্য ও রন্ধন প্রণালী। প্রাচীনকাল থেকেই বিশ্বজুড়ে ঈদের ঐতিহ্যবাহী খাবার বিভিন্ন দেশে ও সংস্কৃতিতে উপভোগ করা হয়। এটি কেবল পেট ভরানোর জন্য নয়, বরং পরিবারের সদস্যদের একত্রিত করার, সম্পর্ককে মজবুত করার এবং ঐতিহ্যকে সমুন্নত রাখার একটি মাধ্যম হিসেবে কাজ করে।
ঈদের দিনটি যেন শুধুমাত্র ধর্মীয় অনুষ্ঠান নয়, বরং তা এক রকম খাবার উৎসবে পরিণত হয়। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের মুসলিমরা তাদের নিজস্ব রীতি অনুসারে মজাদার সব খাবার প্রস্তুত করেন, যা তাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটায়। এই ভিন্ন ভিন্ন রেসিপিগুলো কেবল স্বাদের পরিধিকে বিস্তৃত করে না, বরং পৃথিবীর নানা অঞ্চলের রন্ধনশৈলীর সঙ্গে আমাদের পরিচয় করিয়ে দেয়। তবে চলুন আজকের সে বিষয়ে বিস্তারিত জানা যাক।
বিশ্বজুড়ে ঈদের ঐতিহ্যবাহী খাবার এর কিছু রেসিপি
বিশ্বজুড়ে ঈদ উপলক্ষে বিভিন্ন দেশের মুসলমানরা বিভিন্ন ধরনের ঐতিহ্যবাহী খাবার প্রস্তুত করে থাকে। ঈদ হল এক মহা উৎসব এবং এই বিশেষ দিনটি উদযাপন করা হয় বিশেষ খাবার দিয়ে, যা প্রায়শই স্থানীয় সংস্কৃতি, ঐতিহ্য এবং উৎসবের আনন্দকে প্রতিফলিত করে। নিম্নে কিছু বিখ্যাত ঈদের খাবার এবং তাদের রেসিপি সম্পর্কে আলোচনা করা হলো:

বিরিয়ানি (ভারত, পাকিস্তান, বাংলাদেশ)
বিরিয়ানি ভারত, পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ঐতিহ্যবাহী ঈদের খাবার। এটি মূলত মাংস, চাল এবং মশলার সুনিপুণ সংমিশ্রণে তৈরি হয়। প্রতিটি অঞ্চলে বিরিয়ানির রেসিপিতে কিছু ভিন্নতা থাকলেও, এর মূল উপকরণ এবং প্রস্তুতির পদ্ধতি প্রায় একই থাকে। বিরিয়ানিতে সাধারণত মুরগি, খাসি বা গরুর মাংস ব্যবহার করা হয়। এটি নানা ধরনের মশলা যেমন এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, জিরা এবং তেজপাতা দিয়ে মেরিনেট করে রান্না করা হয়।
মাংসকে প্রথমে আলাদাভাবে মশলা দিয়ে ভালোভাবে রান্না করা হয়, এরপর তার সঙ্গে সুগন্ধি বাসমতী চালের স্তর যুক্ত করে দমে রান্না করা হয়। রান্নার সময় চাল এবং মাংসের স্বাদ একে অপরের মধ্যে মিশে গিয়ে বিরিয়ানিকে এক অনন্য সুগন্ধি এবং মশলাদার স্বাদ প্রদান করে। বাংলাদেশে কাচ্চি বিরিয়ানি একটি বিশেষ ধরনের বিরিয়ানি, যেখানে কাঁচা মাংস এবং চাল একসাথে দমে রান্না করা হয়। পাকিস্তানে সিন্ধি বিরিয়ানি বেশ জনপ্রিয়, যা তুলনামূলক বেশি মশলাদার এবং টকদই দিয়ে তৈরি করা হয়।
ভারতে হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি ঈদের বিশেষ আকর্ষণ, যা ঐতিহ্যগতভাবে অনেক প্রাচীন এবং এতে ব্যবহার করা হয় জাফরান, কাজু, কিসমিসের মতো উপকরণ। বিরিয়ানির সাথে সাধারণত পরিবেশন করা হয় রায়তা, সালাদ এবং টক-মিষ্টি চাটনি, যা এর মশলাদার স্বাদকে আরও বাড়িয়ে তোলে। ঈদ উৎসবের খাবারের টেবিলে বিরিয়ানি শুধু একটি খাদ্য নয়, বরং এটি ঐতিহ্য, স্বাদ এবং ভালোবাসার প্রতীক।
শামী কাবাব (পাকিস্তান)
শামী কাবাব পাকিস্তানের একটি বিখ্যাত ঈদ স্পেশাল খাবার, যা গরু বা মুরগির মাংস, ডাল এবং নানা ধরনের মশলা দিয়ে তৈরি করা হয়। এই কাবাব তৈরির প্রাথমিক ধাপে গরু বা মুরগির মাংস ছোট টুকরা করে, মশুর ডাল, আদা-রসুন বাটা, পেঁয়াজ এবং বিভিন্ন মশলা যেমন ধনে, জিরা, এলাচ দিয়ে সিদ্ধ করতে হয়। সিদ্ধ মাংস এবং ডাল ভালোভাবে মিহি করে ব্লেন্ডার বা হ্যান্ড মিক্সারে পেস্ট বানিয়ে নেওয়া হয়।
এরপর এই মিশ্রণ থেকে ছোট ছোট বল বানিয়ে তা চ্যাপ্টা করে শামী কাবাবের আকৃতি দেওয়া হয়। কাবাবগুলোকে ডিমের মধ্যে ডুবিয়ে ফ্রাইং প্যানে তেলে ভাজা হয় যতক্ষণ না তারা সোনালি রং ধারণ করে। শামী কাবাবের বাহ্যিক ক্রিস্পি টেক্সচার এবং ভেতরের নরম মাংসের সংমিশ্রণ ঈদের খাবারের টেবিলে এক দারুণ স্বাদ যোগ করে। এটি সাধারণত পুদিনার চাটনি বা টক দইয়ের সাথে পরিবেশন করা হয়।
ফাতায়ের (লেবানন)
ফাতায়ের লেবাননের একটি জনপ্রিয় ঈদ স্পেশাল খাবার, যা মাংস, পালং শাক, পনির বা আলুর পুর দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি মূলত এক ধরনের ছোট আকারের পিটা পেস্ট্রি, যা হালকা গরম পরিবেশন করা হয়। ফাতায়ের তৈরির জন্য প্রথমে ময়দা, ইস্ট, চিনি, লবণ ও পানি দিয়ে মোলায়েম খামির তৈরি করতে হবে এবং সেটিকে কিছুক্ষণ রেখে দিতে হবে যাতে সেটি ফুলে ওঠে। এরপর খামিরকে ছোট ছোট বল আকারে ভাগ করে পাতলা করে বেলে নেওয়া হয়।
পুর হিসেবে মাংসের জন্য ভাজা মাংস, পেঁয়াজ, দারুচিনি এবং মশলা মিশিয়ে প্রস্তুত করতে হবে। পালং শাকের জন্য পালং শাক, লেবুর রস, পেঁয়াজ এবং লবণ মিশিয়ে পুর তৈরি করা হয়। পাতানো খামিরের মধ্যে পুর দিয়ে তা ত্রিভুজ আকারে মুড়িয়ে নেওয়া হয় এবং ওভেনে ১৮০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে ১৫-২০ মিনিট বেক করা হয়। এটি সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর হওয়ায় ঈদে খাওয়ার ধুম পরে যায়।

কুনাফা (মধ্যপ্রাচ্য)
কুনাফা হল আরব বিশ্বের ঈদ উৎসবের এক বিশেষ মিষ্টি যা ক্রিসপি কাতাইফি বা সেমাইয়ের স্তর এবং ক্রিমি পনির দিয়ে তৈরি হয়। এটি প্রস্তুতের জন্য প্রথমে সেমাইগুলোকে গলানো মাখন দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে নেওয়া হয়, যাতে তা সম্পূর্ণ ভিজে যায়। এরপর একটি বেকিং ট্রেতে সেমাইয়ের অর্ধেক অংশ সমানভাবে ছড়িয়ে দেওয়া হয় এবং এর উপর আরবীয় পনির (আকাওরি বা মোজারেল্লা) বিছিয়ে দেওয়া হয়।
তারপর বাকি সেমাই পনিরের উপর ঢেকে দেওয়া হয় এবং ওভেনে ৩০ মিনিটের জন্য বেক করা হয়। বেক করার পর, একপাশ লালচে হয়ে গেলে কুনাফার উপর সুগন্ধি সিরাপ ঢেলে দেওয়া হয়, যা চিনির সিরাপ, গোলাপজল এবং অল্প লেবুর রস দিয়ে তৈরি। কুনাফার উপর পেস্তা বাদাম ছড়িয়ে পরিবেশন করা হয়। ঈদের সময় মধ্যপ্রাচ্যে কুনাফা একটি জনপ্রিয় মিষ্টি হিসেবে খুবই প্রশংসিত।
হারিরা (মরক্কো)
হারিরা হল মরক্কোর একটি ঐতিহ্যবাহী স্যুপ, যা সাধারণত ঈদে এবং রমজান মাসে ইফতারের সময় পরিবেশন করা হয়। এটি মূলত টমেটো, মাংস, মসুর ডাল, ছোলা এবং নানা ধরনের মশলা দিয়ে তৈরি করা হয়। প্রথমে পেঁয়াজ, রসুন, আদা, ধনে গুঁড়া, জিরা গুঁড়া এবং গোলমরিচ দিয়ে মাংসটি ভেজে নেওয়া হয়, তারপর এতে টমেটো পেস্ট, কুচানো টমেটো এবং লবণ দিয়ে কিছুক্ষণ রান্না করতে হয়।
এরপর ছোলা ও মসুর ডাল মিশিয়ে মিশ্রণটি ঘন হওয়া পর্যন্ত রান্না করতে হয়। শেষে অল্প লেবুর রস এবং ধনে পাতা দিয়ে হারিরাকে সাজিয়ে পরিবেশন করা হয়। এটি স্বাস্থ্যকর এবং পুষ্টিকর হওয়ায় ঈদের দিন খাবারের মেনুতে মরক্কোতে এটি খুবই জনপ্রিয়।
বাকলাভা (তুরস্ক)
বাকলাভা তুরস্কের এক বিশেষ মিষ্টি, যা ঈদ ও বিভিন্ন উৎসবের সময় অত্যন্ত জনপ্রিয়। এই মিষ্টিটি তৈরি হয় পাতলা ফিলো ডো, বাদাম এবং চিনির সিরাপ দিয়ে। প্রথমে ফিলো ডো পাতগুলোকে একে একে ঘি দিয়ে চুবিয়ে একাধিক স্তরে রাখা হয়। প্রতিটি স্তরের মাঝখানে বাদামের গুঁড়া, পেস্তা বা আখরোট ছড়িয়ে দেওয়া হয়।
এরপর সমস্ত স্তর প্রস্তুত হলে এটিকে ছোট ছোট চৌকো বা ত্রিভুজ আকৃতিতে কেটে ওভেনে ৩০-৪০ মিনিট বেক করা হয়। বেকিং শেষে গরম বাকলাভার উপর ঠাণ্ডা সিরাপ ঢেলে দিতে হয়, যা চিনির সাথে লেবুর রস ও গোলাপজল মিশিয়ে তৈরি হয়। বাকলাভার ক্রিসপি টেক্সচার এবং মিষ্টি স্বাদ, এটি ঈদের সময় বিশেষ করে অতিথিদের আপ্যায়নে বিশেষ জনপ্রিয়।

কাতায়েফ (মিশর, লেভান্ট)
কাতায়েফ হল মধ্যপ্রাচ্যের এক বিশেষ মিষ্টি যা ঈদের সময় খুবই জনপ্রিয়। এটি এক ধরনের ছোট প্যানকেক যা ভিজিয়ে, ভেতরে বাদাম, পনির বা খেজুরের পুর দিয়ে তৈরি করা হয়। প্রথমে ময়দা, ইস্ট, চিনি এবং পানির মিশ্রণ থেকে পাতলা ব্যাটার তৈরি করতে হয় এবং সেটি কিছুক্ষণ রেখে ইস্ট ফুলে ওঠা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়।
তারপর ননস্টিক প্যানে ছোট ছোট প্যানকেক আকারে এটি ভাজা হয়, তবে শুধুমাত্র একপাশেই ভাজতে হয় যাতে অন্যপাশ নরম থাকে। ভাজা প্যানকেক ঠাণ্ডা হলে তার ভিতরে বাদাম বা খেজুর পুর ভরে সেটিকে অর্ধেক করে মুড়ে সিরাপে চুবিয়ে পরিবেশন করা হয়।
উপসংহার
বিশ্বজুড়ে ঈদের ঐতিহ্যবাহী খাবার গুলো শুধু পেট ও মনকে তৃপ্ত করে না, বরং প্রতিটি রেসিপি বিভিন্ন সংস্কৃতি ও ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত বিশেষ একটি গল্প বহন করে। এসব রেসিপি শুধুমাত্র খাবার হিসেবে বিবেচিত হয় না, বরং সেগুলো একটি জাতির ঐতিহ্য, আচার-অনুষ্ঠান এবং পারস্পরিক ভালোবাসার প্রতীক।
ঐতিহ্যের এই সংরক্ষণ ও নতুন প্রজন্মের সঙ্গে তার পরিচয় করিয়ে দেয়া আমাদের দায়িত্ব। ঈদে খাবারের এই বৈচিত্র্য আমাদের শেখায় যে, ধর্মীয় উৎসবের প্রেক্ষাপটে খাদ্য কেবল একটি প্রয়োজন নয়, বরং এটি সুখ, আনন্দ এবং ভালোবাসার আদান-প্রদানের এক মহা-মিলন ক্ষেত্র।