You are currently viewing তিলের তেল কি এবং কিভাবে সংগ্রহ করা হয় ও এর উপকারিতা কি
তিলের তেল

তিলের তেল কি এবং কিভাবে সংগ্রহ করা হয় ও এর উপকারিতা কি

তিলের তেল প্রাচীনকাল থেকেই নানা কারণে সুপরিচিত। এটি তিলের বীজ থেকে নিষ্কাশিত হয় এবং তেল তৈরির জন্য এটি বেশ কয়েকটি প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়। এই তেল তার স্বাদ, পুষ্টিগুণ এবং ঔষধি গুণাবলীর জন্য বিশেষভাবে খ্যাত। তেলের আদি উৎস মধ্যপ্রাচ্য এবং ভারতবর্ষ, তবে এখন এটি বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়। এটি তার উচ্চ পুষ্টিমান এবং স্বাস্থ্যকর ফ্যাটি অ্যাসিডের জন্য স্বাস্থ্যপ্রেমীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে পরিচিত। 

এই তেল স্নেহজাতীয় এবং মসৃণ হওয়ায় এটি ত্বকের যত্ন ও মসৃণতার জন্যও ব্যবহৃত হয়। এছাড়া এটি রান্নার তেল হিসেবেও জনপ্রিয়। আমাদের প্রাচীন আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় এবং রান্নাঘরের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে তিলের তেলকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আজকের আর্টিকেল থেকে আমরা তিলের তেল সম্পর্কে বিস্তারিত জানার চেষ্টা করব। 

তিলের তেল কি?

এটি হল তিলের বীজ থেকে নিষ্কাশিত একটি প্রাকৃতিক উদ্ভিজ্জ তেল, যা তার পুষ্টিগুণ এবং ঔষধি গুণাবলীর জন্য সুপরিচিত। প্রাচীনকাল থেকেই এটি বিভিন্ন সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। তিলের বীজে থাকে উচ্চমাত্রায় ফ্যাটি অ্যাসিড, প্রোটিন, ভিটামিন এবং খনিজ পদার্থ যা এই তেলের মধ্যে সংরক্ষিত থাকে। তেলটি তৈরির প্রক্রিয়াটি সাধারণত ঠান্ডা চাপ প্রয়োগ করে করা হয়, যা তেলের পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ রাখে। 

এই তেল হালকা বাদামি রঙের, এর মৃদু সুগন্ধ এবং স্বাদ রান্নায় একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করে। ত্বক এবং চুলের যত্নে এটি ব্যবহৃত হয়, কারণ এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রদাহ-প্রতিরোধী গুণে সমৃদ্ধ। এটি বিশেষত আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায়ও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, কারণ এই তেল শরীরের অভ্যন্তরীণ এবং বাহ্যিক স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী বলে বিশ্বাস করা হয়।

তিলের তেল কিভাবে তৈরি করা হয়?

তিলের তেল কিভাবে তৈরি করা হয়

তিলের তেল তৈরির প্রক্রিয়া মূলত তিনটি ধাপে সম্পন্ন হয়: তিল বীজ সংগ্রহ ও প্রস্তুতি, তেল নিষ্কাশন এবং পরিশোধন।

তিল বীজ সংগ্রহ ও প্রস্তুতি

তিলের তেল তৈরির প্রথম ধাপ হল তিল বীজ সংগ্রহ করা। তিলের বীজ সাধারণত সাদা, কালো বা বাদামি রঙের হয় এবং প্রায় সব ধরনের বীজ থেকেই তেল তৈরি করা যায়। বীজ সংগ্রহের পর, সেগুলি ভালোভাবে পরিষ্কার করা হয়। এই তেলের স্বাদ এবং গুণমান উন্নত করার জন্য কিছু সময় বীজগুলোকে রোদে শুকানো হয়। এরপর, বীজের ত্বক সরানোর জন্য এগুলো হালকা ভাজা হয়, যা তেলের স্বাদে সামান্য বাদামি টোন যোগ করে। ভাজা প্রক্রিয়ার সময় তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা হয় যাতে বীজের পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ণ থাকে।

তেল নিষ্কাশন

বীজগুলো প্রস্তুত হলে এগুলো থেকে তেল নিষ্কাশন করা হয়। তিলের তেল নিষ্কাশনের প্রধান দুটি পদ্ধতি হলো কোল্ড প্রেসিং এবং হট প্রেসিং।

কোল্ড প্রেসিং: এটি তিল এর তেল নিষ্কাশনের একটি প্রাকৃতিক পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে, তিল বীজ ম্যানুয়ালি পিষে তেল নিষ্কাশন করা হয়। এতে তেলের মধ্যে থাকা পুষ্টিগুণ এবং স্বাদ বজায় থাকে। এই পদ্ধতিতে তাপমাত্রা ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াসের নিচে রাখা হয়, যা তেলের গুণমান অক্ষুণ্ণ রাখতে সাহায্য করে। কোল্ড প্রেস তিলের তেল সাধারণত পুষ্টিকর এবং স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত উপকারী।

হট প্রেসিং: এই পদ্ধতিতে তিলের বীজ ভাজার পর তাপ প্রয়োগ করে তেল নিষ্কাশন করা হয়। এতে তেলের পরিমাণ কিছুটা বেশি পাওয়া গেলেও, পুষ্টিগুণ কিছুটা হ্রাস পায়। হট প্রেসিংয়ের মাধ্যমে উৎপাদিত তেল রান্নার জন্য উপযুক্ত হলেও, ত্বক এবং চুলের যত্নে কোল্ড প্রেস তেল বেশি প্রাধান্য পায়।

পরিশোধন

তেল নিষ্কাশনের পর তাতে কিছু পরিমাণ অমেধ্য থাকতে পারে, যেমন তিলের খোসা বা অন্যান্য কণা। এই অমেধ্যগুলো সরাতে তেলকে পরিশোধিত করা হয়। পরিশোধনের মাধ্যমে তেল পরিষ্কার এবং বর্ণহীন বা স্বচ্ছ হয়ে ওঠে। পরিশোধিত তেলের গুণমান এবং স্থায়িত্ব বৃদ্ধি পায়। তবে কোল্ড প্রেস তিল এর তেল সাধারণত কম পরিশোধিত হয়, যাতে তেলের প্রাকৃতিক গুণাগুণ বজায় থাকে।

এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে উৎপন্ন তিলের তেল রান্না, ত্বক ও চুলের যত্ন এবং ঔষধি প্রয়োগে ব্যবহার করা হয়। এটি তৈরির প্রক্রিয়া যতটা যত্ন সহকারে করা হবে, ততটাই এর গুণমান ও পুষ্টি অক্ষুণ্ণ থাকবে।

তিলের তেলের উপকারিতা কি কি? 

তিলের তেল তার ঔষধি গুণাবলী এবং পুষ্টিগুণের কারণে সুপরিচিত। এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য নানাভাবে উপকারী। নিচে তিল এর তেলের বিভিন্ন উপকারিতা বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হলো:

হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য রক্ষা

তিল এর তেলে মোনো-আনস্যাচুরেটেড এবং পলি-আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটি অ্যাসিড প্রচুর পরিমাণে থাকে। এই উপাদানগুলো কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে সহায়ক। তিল এর তেলে থাকা সিসামোল এবং সিসামিনোল নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদানগুলো রক্তনালীকে শক্তিশালী করে এবং প্রদাহ কমায়, যা হৃদপিণ্ডের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। নিয়মিত এই তেল গ্রহণ উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করতে পারে।

সয়াবিন নাকি সরিয়ার তেল কোনটি ভালো?

ত্বকের যত্ন

তিলের তেল ত্বকের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এতে ভিটামিন ই, ফ্যাটি অ্যাসিড এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা ত্বককে নরম, কোমল এবং আর্দ্র রাখে। তিল এর তেল ত্বকে সহজেই শোষিত হয় এবং এটি ত্বককে গভীরভাবে পুষ্টি জোগায়। শুষ্ক ত্বকের সমস্যা, ব্রণ এবং সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি থেকে ত্বক রক্ষা করতে এটি কার্যকর। তিল এর তেলে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল এবং অ্যান্টিফাঙ্গাল গুণও রয়েছে, যা ত্বকের সংক্রমণ প্রতিরোধে সাহায্য করে।

চুলের যত্ন

এই তেল চুলের জন্য একটি প্রাকৃতিক কন্ডিশনার হিসেবে কাজ করে। এতে ভিটামিন ই এবং ফ্যাটি অ্যাসিড রয়েছে, যা চুলের শুষ্কতা এবং খুশকির সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। নিয়মিত তিলের তেল ম্যাসাজ চুলের গোড়ায় পুষ্টি জোগায়, চুলকে মজবুত করে এবং চুল পড়া রোধ করে। তিল এর তেল চুলের প্রাকৃতিক রং বজায় রাখতে সাহায্য করে এবং অকালে চুল পাকা প্রতিরোধে কার্যকর।

প্রদাহ প্রতিরোধ ও ব্যথা উপশম

তিলের তেলে উপস্থিত সিসামোল এবং সিসামিনোল নামক অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট উপাদানগুলো প্রদাহ প্রতিরোধে সাহায্য করে। এটি আর্থ্রাইটিসের মতো প্রদাহজনিত সমস্যা এবং পেশী ব্যথা উপশমে কার্যকর। তিল এর তেল গরম করে আক্রান্ত স্থানে ম্যাসাজ করলে ব্যথা এবং প্রদাহ কমে যায়। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসায় এই তেল বিভিন্ন শারীরিক ব্যথা উপশমে বহুল ব্যবহৃত।

তিলের তেলের উপকারিতা কি

হাড়ের স্বাস্থ্য উন্নয়ন

তিলের তেলে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং জিঙ্কের মতো খনিজ পদার্থ রয়েছে, যা হাড়ের ঘনত্ব ও শক্তি বাড়াতে সাহায্য করে। বিশেষ করে বয়স্কদের জন্য তিল এর তেল হাড়ের ক্ষয় রোধ এবং অস্টিওপরোসিস প্রতিরোধে সহায়ক। নিয়মিত তিল এর তেল গ্রহণ হাড়ের ক্ষয়প্রক্রিয়া ধীর করতে সাহায্য করে।

পাচনতন্ত্রের জন্য উপকারী

তিলের তেল পাচনতন্ত্রের জন্য উপকারী, কারণ এটি অন্ত্রের মসৃণতা বাড়িয়ে হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে। এটি গ্যাস, বদহজম এবং কোষ্ঠকাঠিন্যের মতো সমস্যার উপশমে কার্যকর। প্রতিদিন সকালে খালি পেটে এক চামচ তিল এর তেল খেলে অন্ত্র পরিষ্কার থাকে এবং হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়।

দাঁতের যত্ন

তিলের তেল মুখের স্বাস্থ্য রক্ষায় একটি প্রাচীন আয়ুর্বেদিক পদ্ধতি হিসেবে ব্যবহৃত হয়, যা “অয়েল পুলিং” নামে পরিচিত। এই পদ্ধতিতে তেল মুখে নিয়ে কুলকুচি করলে মুখের জীবাণু এবং ব্যাকটেরিয়া দূর হয়। এটি দাঁতের মাড়ি মজবুত করে এবং মুখের দুর্গন্ধ দূর করে। এই তেলে থাকা অ্যান্টিমাইক্রোবিয়াল গুণাবলী মুখের সংক্রমণ প্রতিরোধে সহায়ক।

মানসিক চাপ কমায়

তিল এর তেলে ট্রিপটোফ্যান নামক একটি অ্যামিনো অ্যাসিড থাকে, যা সেরোটোনিন উৎপাদন বাড়াতে সাহায্য করে। সেরোটোনিন একটি নিউরোট্রান্সমিটার, যা মানসিক চাপ কমাতে এবং মস্তিষ্ককে শিথিল করতে সাহায্য করে। এই তেল দিয়ে ম্যাসাজ করলে রক্তসঞ্চালন বৃদ্ধি পায় এবং মানসিক প্রশান্তি আসে।

রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি

তিলের তেলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন এবং খনিজ উপাদানের উপস্থিতি শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সহায়ক। এটি শরীর থেকে বিষাক্ত পদার্থ বের করে দেয় এবং ফ্রি র‌্যাডিকাল দ্বারা সৃষ্ট ক্ষতি প্রতিরোধ করে। নিয়মিত এই তেল গ্রহণ শরীরকে সুস্থ ও সবল রাখে।

এটি প্রকৃতির এক অনন্য উপহার, যা স্বাস্থ্যের নানাদিক থেকে উপকারী। এটি খাদ্য, রূপচর্চা এবং চিকিৎসা-সহ নানাভাবে আমাদের জীবনে প্রয়োগ করা যেতে পারে।

উপসংহার 

তিলের তেল শুধুমাত্র একটি রান্নার উপাদান নয়, এটি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য একটি প্রাকৃতিক উপহার। এর মধ্যে রয়েছে উচ্চমানের পুষ্টি, শক্তিশালী অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এবং প্রদাহ প্রতিরোধী গুণাবলী যা আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে সহায়ক। এটি ত্বক ও চুলের যত্নে অসাধারণ ভূমিকা পালন করে। 

এছাড়া হৃদরোগের ঝুঁকি কমানো, হাড়ের স্বাস্থ্য রক্ষা এবং পেটের সমস্যায় এই তেল অত্যন্ত কার্যকর। এই তেল প্রকৃতির এক অপার উপহার, যা আমাদের দৈনন্দিন জীবনে নানাভাবে উপকার করে। আমাদের খাদ্যাভ্যাস এবং রূপচর্চায় তিলের তেলকে অন্তর্ভুক্ত করে আমরা সহজেই একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাত্রা অর্জন করতে পারি।

Bornali Akter Borno

Bornali Akter Borno is a passionate food enthusiast and entrepreneur. From an early age, her love for culinary exploration led her to experiment with flavors and ingredients, ultimately inspiring her to work with Binni Food, an e-commerce brand dedicated to offering premium quality Organic Food and delectable treats to food enthusiasts in Bangladesh. Bornali's relentless pursuit of flavor and commitment to excellence have earned her recognition in the culinary world. Her journey is a testament to the power of passion and perseverance, showcasing how dedication to one's craft can lead to entrepreneurial success and culinary innovation.