বাজারের কিছু অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক মুনাফা লাভের আশায় খাবারের মধ্যে ফরমালিন মিশিয়ে থাকে। আর ফরমালিনযুক্ত খাবার খেলে মানবদেহে বিভিন্ন রোগ বাসা বাঁধে। এটা থেকে বাঁচার উপায় সম্পর্কে আমাদের হয়তো অনেকেরই অজানা। যেহেতু খাবারে ফরমালিন ব্যবহার প্রতিরোধ করা আমাদের একার পক্ষে সম্ভব নয়। তাই খাবারের আইটেম থেকে কিভাবে ফরমালিন দূর করতে হবে তা সম্পর্কে আমাদের অবশ্যই অবগত হতে হবে।
কলা বা আম, কাচা অবস্থায় গাছ থেকে পেরে দ্রুত পাকাতে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়, এর ফলে সহজে পঁচন ধরেনা। সাধারণত বাজারে ফরমালিনযুক্ত ফলগুলোর ত্বক অনেক মসৃণ ও দাগমুক্ত দেখতে পেয়ে থাকি। আপাতদৃষ্টিতে এই উপকারী ফল মনে হয় যা আমাদের চোখকে আকৃষ্ট করে। এবং আমরাও ফরমালিনযুক্ত ফল কিনে খাই। আমাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে অসুস্থতায় ভুগতে হয়। আজকের আর্টিকেলে ফরমালিন কি, খাবারের ফরমালিন দূর করার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।
ফরমালিন কি
আমরা কমবেশি ফরমালিন কথাটির সাথে সকলেই পরিচিত। তবে এই সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা আমাদের অনেকের নেই। ফরমালিন মূলত কয়েকটি রাসায়নিক পর্দাথের একটি সম্মিলিত যৌগ। ফরমালডিহাইড বা মিথান্যাল (H-CHO) এর ৪০% জলীয় দ্রবণকে মূলত ফরমালিন বলা হয়। এটির প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে সংক্রমিত হতে না দেয়। অর্থাৎ ব্যাকটেরিয়া এবং ছত্রাককে মেরে ফেলে।
সাধারণত এটি ব্যবহার করা হয় রং ও পলিমারন তৈরীতে যা বস্ত্রখাতে কাপড় কুঞ্চিত হতে দেয় না। ফরমালিনের অপব্যবহার করে থাকে অসাধু ব্যবসায়ীরা। তারা পচনশীল খাবার অনেকদিন পর্যন্ত ভালো রাখার জন্য ফরমালিন ব্যবহার করে। এটি এক ধরনের বিষ। যা শরীরকে তাৎক্ষণিক ভাবে কোনো ক্ষতি না করলেও ধীরে ধীরে এর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। তাই ফরমালিন যুক্ত খাবার হতে আমাদের সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।
খাবারের ফরমালিন দূর করার নিয়ম
ক্লিনাভা হলো ফরমালিন অপসারণের একটি সহজ উপায় যা বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। বিভিন্ন ধরনের তরল মিশ্রণ ফরমালিন দূর করার প্রোডাক্ট পাওয়া গেলেও ক্লিনাভা সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়। তবে এর দাম অনেক বেশি যা সবসময় কিনে ব্যবহার করা ঝামেলার। আমাদের আজকের লেখায় জানতে পারবেন কীভাবে ঘরোয়া উপায়ে খাবারের ফরমালিন দূর করা যায়।
শাকসবজি ও ফলমূলের ক্ষেত্রে করণীয়
বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ফলের দোকানে বা সবজির দোকানে এসকল খাবার তাজা রাখার জন্য ফরমালিন ব্যবহার করে থাকে। আর এই ফরমালিন দূর করার উপায় হচ্ছে
- পানি: বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, পানিতে প্রায় এক ঘন্টা যেকোনো খাবার ভিজিয়ে রাখলে ফরমালিনের মাত্রা শতকরা ৬১ ভাগ কমার সম্ভাবনা থাকে।
- লেবুপানি বা ভিনেগার: গবেষণায় দেখা গিয়েছে, খাবারের ফলমালিন দূর করতে অনেকটা সাহায্য করে লেবুপানি বা ভিনেগারে। ৫ লিটার পানিতে এক কাপ লেবুর রস বা ভিনেগার মেশানোর পর সেই পানিতে ফলমূল বা শাকসবজি ভিজিয়ে রাখতে হবে ১৫ মিনিটের জন্য। বিশেষজ্ঞরা মনে করেন এতে খাবারে থাকা ফরমালিন শতভাগ দূর হয়ে যায়।
- লবন পানি: লেবুপানি বা ভিনেগারের মতোই লবন কার্যকরী। ৫ লিটার পানিতে ১ টেবিল চামচ লবন মিশিয়ে নিতে হবে। এরপরে লবন মিশ্রিত পানিতে ফলমূল ও শাকসবজি ভিজিয়ে রাখতে হবে। এভাবেও ফরমালিন দূর করা সম্ভব হয়।
খোসাযুক্ত ফল ও সবজির ক্ষেত্রে করণীয়
বাজার থেকে ফল কিনে ভালো করে ধুয়ে খোসা ছাড়িয়ে নিতে হবে। আবার পানি দিয়ে ধুয়ে তারপরে খেতে হবে। অন্য দিকে যেসকল সবজি ও ফলমূলের ছাল ফেলে দেওয়ার প্রয়োজন হয়না, সেগুলো প্রথমে পানি দিয়ে ধুয়ে তারপরে একটি পরিষ্কার কাপড় দিয়ে ভালোভাবে মুছতে হবে। তারপরে খেতে হবে।
সুস্থ থাকার জন্য খাবারের তালিকা – সুস্থতার অর্গানিক সমাধান
শুঁটকির ক্ষেত্রে করণীয়
শুঁটকি কম বেশি সকলের পছন্দ। আমরা হয়তো অনেকেই জানিনা, শুঁটকিতে প্রচুর পরিমাণে ফরমালিন থাকে। আর এই ফরমালিন দূর করতে রান্নার লবণ পানি বা ভিনেগারে ভিজিয়ে রাখতে হবে। এতে শুঁটকিতে বিদ্যমান ফরমালিন দূর হওয়ার পাশাপাশি স্বাদও বেড়ে যায়।
মাছের ক্ষেত্রে করণীয়
মাছ তাজা রাখতে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। আর এই ফরমালিন দূর করতে ১ ঘণ্টা ঠান্ডা পানিতে মাছ ডুবিয়ে রাখতে হবে। এতে মাছের শরীরে থেকে প্রায় ৬১ শতাংশ ফরমালিন দূর হয়ে যায়। এছাড়া আরও একটি উপায় হলো মাছ রান্নার আগে ১ ঘণ্টা লবণ পানিতে ডুবিয়ে রাখা। এতে করেও ফরমালিনের পরিমাণ কমে যায়। আরেকটি উপায় হচ্ছে, চাল ধোয়ার পানি দিয়ে মাছটি ধুয়ে নিতে হবে, এরপরে স্বাভাবিক তাপমাত্রার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। এতে করেও ফরমালিন দূর হয়ে যাবে।
খাবারের ফরমালিন ব্যবহারের ভয়াবহতা
ফরমালিন মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর ও বিষাক্ত। ফরমালিনের গন্ধ শুকলেই মাথাব্যথাসহ শ্বাসকষ্ট সমস্যা হতে পারে। ফরমালডিহাইযুক্ত মাছ খেলে পাকস্থলীতে অস্বস্তি অনুভূত হতে পারে। ফরমালিন আমাদের দেহে ফরমিক এসিডে রুপান্তরিত হয়ে রক্তের এসিডিটি বাড়ায়। পরবর্তীতে শ্বাস প্রশ্বাস অস্বাভাবিকভাবে উঠানামা করে। যা মৃত্যু পর্যন্ত ঘটাতে পারে। জেনে অবাক হবেন, ফরমালিন মানুষের জন্য ক্যান্সার সৃষ্টিকারী উপদান। দীর্ঘ সময় ধরে ফরমালিনযুক্ত মাছ খেলে ফুসফুস, শ্বাসনালী ও পাকস্থলীতে ক্যান্সার হতে পারে। ফরমালিনের ব্যাপক ব্যবহার মারাত্মক হুমকিস্বরূপ।
উইকিপিডিয়া তথ্য সূত্রে পাওয়া যায়, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল টক্সিকোলজি প্রোগ্রাম কর্তৃক ফরমালিনকে মানুষের ক্যান্সার রোগ সৃষ্টিকে সরাসরি সম্পৃক্ত বলে জানায়। ফরমালিনের এমন ভয়াবহতা ও মানবদেহের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে বেশ কয়েকটি ইউরোপীয় দেশ ফরমালিন ব্যবহার ও ফরমালিনজাত দ্রব্যাদি আমদানীতে বিধি নিষেধ আরোপ করেছে।
উপসংহার
আজকাল বাজারে ফল থেকে শুরু করে মাছ মাংস, শাকসবজিতেও ব্যবহার হচ্ছে ফরমালিন। ফরমালিন ছাড়া কোনো খাবার পাওয়া প্রায় অসম্ভব হয়ে পরেছে। এই ধরনের খাবার খেয়ে আমরা অসুস্থ্য হয়ে পরছি। আমাদের স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। তাই অবশ্যই এই বিষয়ে নিজেকে ও পরিবারে সদস্যদের খাবারের ফরমালিন দূর করার নিয়ম সম্পর্কে সর্তক করে নিতে হবে। বাজারের কেনা সবজি ও ফলমূল খাওয়ার আগে ঘরোয়া পদ্ধতিতে ফরমালিনমুক্ত করে নিতে হবে।