মাঠা অনেকটা ঘোলের মত একটু সুস্বাদু পানীয়। তীব্র গরম ও রমজান মাসে এই পানীয় এর চাহিদা বৃদ্ধি পায়। বিশেষ করে শহর এলাকায় এই পানীয় সব থেকে বেশি পাওয়া যায়। বিভিন্ন দইয়ের দোকান বাদেও ফুটপাতে মাঠা দেখতে পাওয়া যায়। দই, মিষ্টি, ঘি, পনির, চিজ, মাখন, সন্দেশ ইত্যাদি যেমন দুগ্ধ জাতীয় খাবার। মাঠাও ঠিক তেমনি পানীয় দুগ্ধ জাতীয় ঘোল।
ঐতিহ্যবাহী এই পানীয় শরবত হিসেবে ব্যবহার করা হলেও ঘোল এবং এই ধরনের অন্যান্য পানীয় থেকে মাঠা একটু আলাদা। বিশেষ করে প্রস্তুত প্রণালি এবং পুষ্টিগুণের দিক থেকে এদের মধ্যে বেশি পার্থক্য বিরাজ করে। তো আমাদের আজকের লেখায় মাঠা কি, কেন এত বিখ্যাত এবং প্রস্তুত প্রণালি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
মাঠা কিভাবে তৈরি হয়?
মাঠা তৈরি করার পদ্ধতি নিচে বর্ণনা করা হলো।
উপকরণ
টক দই (জমাট বাঁধা দুধ), পানি, লেবু, বিট লবণ, চিনি
মাঠা প্রস্তুত প্রণালী
মাঠা সাধারণত একটি বিশেষ নিয়মে তৈরি করা হয়। পদ্ধতিটি অনেকটা দই তৈরি করার মতই তবে একটু ভিন্নতা রয়েছে। যাইহোক, বাণিজ্যিকভাবে মাঠা তৈরি করতে হলে আপনাকে প্রথমে খাঁটি গাভীর দুধ আগের দিন বিকেলে জ্বাল দিয়ে দইয়ের মত করে রেখে দিতে হবে। দুধ জ্বাল দেওয়ার সময় বিট লবণ ও চিনি দিতে হবে। ওইদিন ভোরে সেই জমানো দুধ সংগ্রহ করে একটি পাত্রে সংগ্রহ করতে হবে।
পাত্রে সব জমাটবাঁধা দুধ জমা করে তা দুইটি পদ্ধতিতে প্রস্তুত করা যাবে। প্রথমত ব্লেন্ডার করে অথবা “টানা” পদ্ধতি ব্যবহার করা। মোটকথা যেভাবেই হোক সেই জমাটবাঁধা দুধ একদম ঘোলের মত তরল করে ফেলতে হবে।
এই মিশ্রণ যত ঘন থাকবে তত বেশি দাম পাওয়া যাবে। ঘনত্বের পরিমাণ কমার সাথে সাথে এর দাম এবং স্বাদ উভয় কমতে থাকে। পরিবেশন করার সময় তাতে লেবুর রসের সাথে অন্যান্য মশলা ও বরফ যোগ করে দিতে হবে। মূলত এভাবেই বাণিজ্যিকভাবে মাঠা তৈরি করা হয়।
মাঠা খাওয়ার উপকারিতা
মাঠা খাওয়ার নানা রকম উপকারিতা রয়েছে যা নিচে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
গরমে স্বস্তি দেয়
মাঠা গাভীর খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি করা হয়। গরম গরম মাঠা তৈরি করে তা ঠান্ডা করে বিক্রির জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। স্বাদ বৃদ্ধি করার জন্য এতে বরফ কুঁচি যোগ করা হয়। বরফ যোগ করার কারণে মাঠা ঠান্ডা থাকে যা একটি শীতল পানীয় হিসেবে কাজ করে। তবে জমাট বাঁধা গঠনের জন্য অনেক লম্বা সময় ধরে এটি শরীর ঠান্ডা রাখে।
হজম বৃদ্ধি করে
দুধে প্রচুর পরিমাণে হজম সহায়ক এনজাইম থাকে। যখন মাঠা তৈরি করার হয় তখন তাতে যোগ করা উপাদান এই সংখ্যা আরও বৃদ্ধি করে। এতে হজম শক্তি আশানুরূপভাবে বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া দুধ এমনিতে স্বভাবগতভাবে হজম প্রক্রিয়া বৃদ্ধি করে।
এনার্জি বাড়ায়
মাঠা শীতল ও পুষ্টিগুণ সম্পন্ন হয় যা শরীরে একটি সুন্দর অনুভূতির জন্ম দেয়। এই অনুভূতির কারণে দেহের সর্বোপরি এনার্জি বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া দুধ এবং দইয়ের সংমিশ্রণ এবং সাথে মাখন যোগ করলে মাঠা যেমন সুস্বাদু হয় তেমনি দেহের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করে।
প্রোটিন সমৃদ্ধ
দুধে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন ও ক্যালসিয়াম থাকে। এই দুইটি ছাড়াও আরও অনেক উপকারী উপাদান দুধে বিদ্যমান। এই সকল উপাদান দিয়ে যখন মাঠা তৈরি হয় তখন এর পুষ্টিগুণ আরও বৃদ্ধি পায়। মোটকথা, দুধে যে সকল উপাদান থাকে তার সব কিছুই মাঠায় থাকে এবং বেশি পরিমাণে থাকে।
মাঠা কেন এত জনপ্রিয়?
দুগ্ধজাত পণ্য বরাবরই আমাদের সবার পছন্দের তালিকায় সবার উপরে থাকে। আমাদের দেশে যত ঐতিহ্যবাহী খাদ্য আছে তাদের মধ্যে দুধ দিয়ে তৈরি খাবার সব থেকে বেশি। বিভিন্ন ধরনের চমচম থেকে শুরু করে মিষ্টি, রসমালাই, কাঁচাগোল্লা, দই ইত্যাদি দুধ ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। এসব খাবারের এলাকা ভিত্তিক ব্যাপক সুখ্যাতি রয়েছে।
মাঠা আমাদের কাছে ব্রিটিশ আমল থেকেই একটি পরিচিত নাম। আগের দিনে প্রসিদ্ধ এলাকা যেমন পুরান ঢাকায় গোয়ালারা মাথায় করে মাঠা বিক্রি করতো। খেতে সুস্বাদু এই খাবার প্রায় সব ঋতুতে খাওয়া যায়। এই জন্য সব বয়সী মানুষ সেই সময় থেকে মাঠা খেতে পছন্দ করতো।
যাইহোক, মাঠা এত সুপরিচিতি পাওয়ার পেছনে বড় কারণ হচ্ছে এর রং, স্বাদ এবং প্রস্তুত প্রণালি। অন্যদিকে, গরমের দিনে বরফ মিস্ত্রিত মাঠা শরীর শীতল করতে অনেক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে। এছাড়া ইফতারে মাঠা খাওয়া একটি বনেদি ঐতিহ্য। খাঁটি দুধ থেকে তৈরি করতে হয় জন্য এতে ভেজাল থাকে না। দুধ থেকে তৈরি এবং সব বয়সের মানুষ খেতে পারে জন্য সময়ের সাথে সাথে এর গুণাগুন ও পরিচিত অক্ষুণ্ন আছে।
মোটকথা মাঠা এত পরিমাণ জনপ্রিয় হওয়ার পেছনে অনেক গুলো কারণ আছে। মিষ্টি জাতীয় হরেক রকমের খাবারের উদ্ভাবক হিন্দু সম্প্রদায়ের মধ্যে ঘোষ সম্প্রদায় মাঠা তৈরি করে। তাদের তৈরি মাঠা খেতে অতুলনীয় এবং দাম একদম হাতের নাগালে। সর্বোপরি দাম এবং সহজলভ্যতার কারণে মাঠা এত জনপ্রিয়।
প্রতিদিনের খাবারে পাবনার গাওয়া ঘির আসল স্বাদ ও পুষ্টি যুক্ত করুন!
বাংলাদেশে ঘোলকে মাঠার সাথে তুলনা করা হলেও এদের প্রস্তুত প্রণালি একটু ভিন্ন। মাঠা তৈরি করার সময় ঘোল ব্যবহার করে হলেও তা এক নয়। যাইহোক, মাঠার পরিচিতি পুরো ভারতীয় উপমহাদেশে বিদ্যমান। প্রতিটি আলাদা আলাদা দেশে এর নাম আলাদা আলাদা যেমন ভারতে একে মাঠা বা ঘোল হিসেবে ডাকা হলেও, বাংলাদেশে মাঠা এবং নেপালে মোহি নামে ডাকা হয়।
বাংলাদেশে মাঠা তৈরি করার দিক দিয়ে প্রসিদ্ধ হল পাবনা জেলার বেড়া উপজেলা। সাধারণত চর এলাকা হওয়ায় এখানে খাঁটি ও সুস্বাদু দেশি গাভীর দুধ পাওয়া যায়। এই দুধ দিয়ে এখানকার ঘোষ সম্প্রদায়ের মাঠা তৈরি করার কারিগরগন সিজন ভিত্তিক মাঠা তৈরি করে। স্বাদে অতুলনীয় বেড়ার মাঠা পাবনা এবং ঢাকা সহ দেশের আনাচে কানাচে সরবরাহ হচ্ছে।
অন্যদিকে বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের মাঠাও সমানভাবে পরিচিত। মাঠার এই অনন্য জনপ্রিয়তা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে যা ঐতিহ্যবাহী এই খাবারের বিকাশে প্রত্যক্ষ অবদান রাখছে।
আশা করা যায় লেখাটি পড়ে আপনি মাঠা কি, কীভাবে তৈরি করে এবং কি কি উপকার করে সেই বিষয়ে বিস্তারিত ধারণা লাভ করেছেন।