দই আমাদের দেশের অনেক বিখ্যাত মুখরোচক খাবার। বিভিন্ন অনুষ্ঠান অথবা অতিথি আপ্যায়নের জন্য দই ব্যবহার করা হয়। পুরো দেশে অনেক জায়গায় দই তৈরি করা হল্ব বগুড়ার দইয়ের সুনাম সব থেকে বেশি। আমাদের আজকের লেখায় বগুড়ার দই কেন এত বিখ্যাত এবং এটি খেলে কি কি উপকার পাওয়া যাবে সে বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
বগুড়ার দই কেন বিখ্যাত?
দই প্রাচীনকাল থেকে পরিচিত একটি সুস্বাদু খাবার। এখন থেকে ঠিক চার হাজার বছর আগে সুমেরীয় বা আক্কাদীয় যাযাবর নোম্যাডিক জাতি দই প্রস্তুত করা শুরু করে। তবে ভারতীয় উপমহাদেশে দইয়ের প্রথম প্রচলন শুরু হয় ১৫০ বছর আগে থেকে। মূলত ভারতীয় উপমহাদেশে প্রথম দই তৈরি করেন শেরপুরের ঘেটু ঘোষ নামের একজন।
তিনি একজন সনাতন ঘোষ সম্প্রদায়ের সদস্য যারা সে সময় থেকে এখন পর্যন্ত দই তৈরি করে আসছেন। যাইহোক, আমরা বগুড়ার দই বলতে যে দইয়ের কথা বলি তা আসলে শেরপুর জেলার দই। দই প্রচলনের শুরুর দিকে এর স্বাদে মুগ্ধ হয়ে তৎকালীন বাংলার ইংরেজ গভর্নর তার দেশে নিয়ে গিয়েছিলেন। স্বাধীনতা পূর্ববর্তী সময়ে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান এই দইয়ের স্বাদে এতটা মুগ্ধ হন যে তা উপহার হিসেবে বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্র প্রধানদের প্রেরণ করে।
তো বগুড়ার দই এত বিখ্যাত হওয়ার কারণ হল শুরুর দিকে এই দই তৈরি প্রণালি গোপন ছিল। অর্থাৎ ঘোষ সম্প্রদায়ের কারিগরেরা অতি গোপনে এই দই তৈরি করত। এতে বাজারে দইয়ের স্বাদ আর মান অনেক লম্বা সময় ধরে অক্ষুণ্ন ছিল। তাছাড়া যে পদ্ধতিতে এই দই তৈরি ও বিক্রি করা হতো তাতে বাজারে সব থেকে ভালো মানের দই বলতে এই একটি ছিল।
এই কারণে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে এই দই তৈরি ও বিক্রি বৃদ্ধি পায়। তখন দেশের বিভিন্ন জায়গায় বগুড়ার দই ছড়িয়ে পরে যা পরবর্তীতে এর সুনাম বৃদ্ধি করে। বর্তমান সময়ে বগুড়ার দই তৈরি করার শিল্প ঘোষ সম্প্রদায় বাদেও অনেকের কাছে ছড়িয়ে পরেছে। এখন হিন্দু কারিগরের পাশাপাশি অনেক মুসলিম কারিগর দই তৈরি করার কারখানা স্থাপন করেছে।
দই খাওয়ার উপকারিতা
![দই খাওয়ার উপকারিতা](https://binnifood.com/wp-content/uploads/2023/12/দই-খাওয়ার-উপকারিতা_18-1024x576.jpg)
টক দই, চিনা পাতা দই অথবা মিষ্টি দই প্রচলিত দুগ্ধজাত খাবারের মধ্যে অন্যতম। দই যেহেতু দুধ দিয়ে তৈরি করা হয় সেহেতু এতে দুধে থাকা বিভিন্ন খনিজ, প্রোটিন ও ভিটামিন বেশি আকারে পাওয়া যায়। নিচে নিয়মিত দই খেলে আমরা কি কি উপকারিতা পাবো সেই বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ছত্রাক প্রতিরোধ করে
মানব দেহে এমন অনেক অঙ্গ থাকে যা ছত্রাক সংবেদনশীল। এই অঙ্গগুলো দ্বারা সহজেই দেহে ছত্রাক আক্রমণ ঘটে। আমরা খুব সহজেই এই ছত্রাক আক্রমণ থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারি যার জন্য প্রয়োজন হবে নিয়মিত দই খাওয়ার। অর্থাৎ নিয়মিত দই খেলে তা ছত্রাক সংবেদনশীল অঙ্গকে রক্ষা করে।
ওজন কমায়
ওজন বৃদ্ধি হওয়ার সব থেকে বড় কারণ অতিরিক্ত চর্বি। আমরা খাবারের সাথে নিয়মিত প্রাণিজ এবং তেল থেকে তৈরি চর্বি গ্রহণ করি। এগুলো শরীরে জমে দেহের ওজন বৃদ্ধি করে। এই কারণে দেহের ওজন কমাতে চাইলে অথবা ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে এই অতিরিক্ত চর্বি কমানোর প্রয়োজন পরে।
এই ক্ষেত্রে দই দেহের চর্বি গলিয়ে ওজন কমাতে সাহায্য করে। কারণ যখন পরিমাণ মত দই গ্রহণ করা হয় তখন তা শরীরকে তার জমে থাকা চর্বি খরচ করতে বাধ্য করে। এতে দীর্ঘ সময় ধরে জমে থাকাক চর্বি দ্রবীভূত হয়ে শরীরের ওজন হ্রাস পায়। অন্যদিকে নতুন করে চর্বি জমতে বাঁধা সৃষ্টি করে।
পেটের সমস্যা দূর করে
পেটের সমস্যা বৃদ্ধি করতে এবং প্রতিরোধ করতে দুগ্ধজাত পণ্য সমানভাবে কাজ করে। অর্থাৎ আপনার পেটে যদি সমস্যা তৈরি করতে চান তবে পরিমাণের অধিক দুগ্ধজাত পণ্য গ্রহণ করুন। অন্যদিকে দই পনির ইত্যাদি খাবার গুলো পরিমাণ মত খেলে তা পেটের বিভিন্ন সমস্যা দূর করতে সহায়তা করে। বিশেষ করে পেটের ভেতরে গ্যাসের সমস্যা থাকলে অথবা কোন জ্বালাপোড়া থাকলে দই খেলে তা নিরাময় হয়। অন্যদিকে দই পেট ঠান্ডা রাখে এবং বদহজম প্রতিরোধ করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
দই তৈরি করা হয় এক বিশেষ প্রজাতির উপকারী ব্যাকটেরিয়া দ্বারা। এটি শরীরে প্রবেশ করলে তা দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধিকারী উপাদান গুলো বৃদ্ধি করে। এতে শরীরের রোগ প্রতিরোধ করার ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়। যা পরবর্তীতে শরীরে অনেক রোগ আক্রমণ হওয়া প্রতিরোধ করে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে
দইয়ের মধ্যে থাকা যে সকল পুষ্টি উপাদান আছে তাদের মধ্যে পটাশিয়াম অন্যতম। সাধারণত পটাশিয়াম শরীরের রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। এই উপাদান সঠিক পরিমাণে থাকলে তা রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে চাপ কমায়।
হজম শক্তি বৃদ্ধি করে
আমরা জানি দইয়ে উপকারী ব্যাকটেরিয়া থাকে যা শরীরের অনেক উপকারে কাজ করে। বিশেষ করে হজমের কাজে নিয়োজিত বিভিন্ন এনজাইমের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করার পাশাপাশি দই পাচন উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি করে। অন্যদিকে গবেষণায় দেখা গেছে দই পেপটিক আলসার সমস্যার জন্য দায়ী এইচ পাইলোরি ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে। এতে পেটের আলসার সমস্যা দূর হয়।
ত্বক উজ্জ্বল করে
দই প্রাকৃতিক ত্বক উজ্জ্বল করার কাজ করে। এছাড়া দইয়ের মধ্যে থাকা ল্যাকটিক অ্যাসিড লোমকূপ পরিষ্কার করে ত্বকের মৃত কোষ পরিষ্কার করে সজীবতা বৃদ্ধি করে।
দাঁত ও হাড় মজবুত করে
দইয়ের মধ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্যালসিয়াম এবং ফসফরাস থাকে। এই উপাদান দুটি দাঁত ও হাড়ের সমস্যা দূর করে সুগথিত করে। নিয়মিত দই খেলে হাড় সম্পর্কিত সমস্যা থেকে সুস্থ থাকা সম্ভব হয়।
উদ্বিগ্নতা কমায়
দইয়ে থাকা পুষ্টি উপাদান মস্তিষ্কের নিউরন উজ্জীবিত করে। এতে সকল ধরনের দুঃখ, বিষণ্নতা, উদ্বিগ্নতা ইত্যাদি কমে যায়। তাছাড়া দই দেহের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখে যা আমাদের মস্তিষ্ক সচল রাখে এবং কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে। মানুষিক চাপ থেকে সুস্থ থাকার জন্য দই অনেক ভালো টোটকা হিসেবে কাজ করে। সর্বোপরি দই একাধারে অনেক গুলো রোগ থেকে সুস্থতা দান করে।
হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখে
হৃৎপিণ্ড আমাদের দেহের অনেক গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। এই কারণে এর সুস্থতা এবং সুস্বাস্থ্য বজায় রাখা অনেক জরুরি। হৃৎপিণ্ডের সব থেকে বড় সত্রু হল এলডিএল কোলেস্টেরল। দই এই ক্ষতিকর কোলেস্টেরল বৃদ্ধি এবং বণ্টন প্রতিরোধ করে। অর্থাৎ নিয়মিত দই খেলে তা দেহের ক্ষতিকারক কোলেস্টেরল কমিয়ে উপকারী কোলেস্টেরল বৃদ্ধি করে। এতে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ স্বাভাবিক ভাবে কাজ করতে পারে।
ক্যানসার প্রতিরোধ করে
দেহে ক্যানসার কোষ জন্ম হওয়ার জন্য ল্যাকটোব্যাসিলাস ও স্ট্রেপটোকক্কাস থ্রেমোফিলাস এই দুইটি ব্যাকটেরিয়া কাজ করে। কোন ভাবে যদি এই ব্যাকটেরিয়া দুইটি শরীরে আক্রমণ করে তাহলে ক্যানসার হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। তবে দইয়ের মধ্যে থাকা পুষ্টিগুণ এই ব্যাকটেরিয়া দুইটি ধ্বংস করে। যে কারণে পরবর্তী সময়ে শরীরে ক্যানসার আক্রমণ হতে পারে না। অর্থাৎ নিয়মিত দই খেলে তা ক্যানসার প্রতিরোধ করতে সহায়তা করে।
বগুড়ার দই বানানোর রেসিপি
![বগুড়ার দই বানানোর রেসিপি](https://binnifood.com/wp-content/uploads/2023/12/বগুড়ার-দই-বানানোর-রেসিপি_7-1024x576.jpg)
বগুড়ার দই তৈরি করার প্রক্রিয়া অনেক বছর গোপন থাকলেও বর্তমানে এই রেসিপি কারিগরেরা সবার সাথেই শেয়ার করে। যে কারণে আপনি নিজস্ব বা বাণিজ্যিকভাবে এই দই তৈরি করতে পারবেন। তো বগুড়ার দই তৈরি করার প্রক্রিয়া হিসেবে প্রথমে গরুর খাঁটি দুধ সংগ্রহ করা হয়। পরবর্তীতে সেই দুধ এক বিশাল কড়াইয়ে দিয়ে তার সাথে চিনি মিশিয়ে তানা ৫ ঘণ্টা জ্বাল দেওয়া হয়।
জ্বাল দেওয়ার সময়ে বড় হাতা দিয়ে ঘন ঘন নেড়ে দেওয়া হয়। এতে দুধ যেমন চিনির সাথে বেশি ভাল করে মিশ্রিত হয় তেমনি কড়াইয়ের গায়ে পোড়া লেগে যায় না। দুধ যে পর্যন্ত লালাভ বর্ণের না হয় ঠিক সে পর্যন্ত জ্বাল দিয়ে তা ছোট ছোট মাটির সরা বা হাঁড়িতে রাখা হয়। এরপর সেগুলো একটি চুলার চারপাশে সাজিয়ে রাখা হয় এবং বিশালাকার বাঁশের তৈরি ডালা দিয়ে ঢেকে দেওয়া হয়।
এভাবে ঢাকা অবস্থায় ৮ ঘণ্টা রাখা হয়। তারপর ডালা গুলো তুলে প্রতিটি দইয়ের সরাতে পুরোনো দই দেওয়া হয়। এতে দইয়ে ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন হয় এবং দুধ জমাট বাঁধতে থাকে। তারপর পুনরায় সরা গুলো ঢেকে আরও কয়েক ঘণ্টা রাখা হয়। সবমিলিয়ে দই তৈরি করতে সময় লাগে ১৮ থেকে ২০ ঘণ্টার মত। এই কারণে দইয়ের কারখানায় দই তৈরি করে তা বেশি সুস্বাদু হওয়ার জন্য পুরো রাত রাখা হয় এবং ফজরের দিকে তা সাপ্লাই করা হয়।