You are currently viewing খুলনার চুইঝাল কেন বিখ্যাত? চুইঝালের ইতিহাস ও রেসিপি

খুলনার চুইঝাল কেন বিখ্যাত? চুইঝালের ইতিহাস ও রেসিপি

চুইঝাল আমাদের দেশের খুলনা অঞ্চলের একটি ঐতিহ্য। খুলনার পাশাপাশি সিলেট, রংপুর ও চট্টগ্রামের পাহাড়ি অঞ্চলে এই মশলা জাতীয় এই উদ্ভিদ পাওয়া যায়। তবে স্বাদে এবং গুনে খুলনা ও বাগেরহাটের চুইঝাল সব থেকে বেশি সুস্বাদু ও উন্নতমানের। এই কারণে দেশে এবং বিদেশে এই মশলার সুনাম ছড়িয়ে পরেছে। আমাদের আজকের লেখায় আমরা চুইঝাল কি, কেন এত বিখ্যাত এবং এর ইতিহাস সম্পর্কে জানবো। 

চুইঝাল কি? 

চুই একটি পিপারেসি পরিবারের উদ্ভিদ যার বৈজ্ঞানিক নাম “piper chaba”। এটি আমাদের সকলের পরিচিত পান গাছের মত দেখতে এবং দুইটি একই উদ্ভিদ পরিবারের। এই লতা জাতীয় উদ্ভিদ বাংলাদেশের পাহাড়ি অর্থাৎ উঁচু এলাকায় সব থেকে বেশি জন্মে। 

আমরা চুইঝাল (Chui Jhal) বলতে যে উদ্ভিদকে বুঝি এটি আসলে একটি মশলা জাতীয় উদ্ভিদ। অর্থাৎ চুইঝাল হলো অনেকটা দারুচিনির মত গাছ। অন্যদিকে ঝাল শব্দটি চুই এর স্বাদের উপর নির্ভর করে যোগ করা হয়েছে। মোটকথা। চুই একটি পান জাতীয় উদ্ভিদ যা রান্নায় মশলা হিসেবে ব্যবহার করা হয়। 

এটি দেখতে পুরোপুরি পান গাছের মত তবে এর পাতা, ফুল এবং ফল আলাদা। অন্যান্য কাছের মত চুইঝাল গাছে ফুল ফোটে এবং পরাগায়নের মাধ্যমে ফল হয়। পরবর্তীতে সেই ফল থেকে নতুন চারা গজায়। মূলত একটি চারা চুইঝাল গাছ বিক্রি করার উপযুক্ত হতে কমপক্ষে এক বছর সময় প্রয়োজন হয়। 

সাধারণত চুইঝাল এঁটো চুই, গাছ চুই ও ডাল চুই এই তিন ধরনের হয়। তাছাড়া উৎপাদিত এলাকার উপর নির্ভর করে এর গুণগত মান, স্বাদ, গন্ধ ও অন্যান্য বিষয় পরিবর্তিত হয়। মান পরিবর্তনের সাথে সাথে দামেও পরিবর্তন আসে যা একজন সচেতন ক্রেতার সবসময় মনে রাখা উচিত। 

খুলনার চুইঝাল কেন বিখ্যাত?

খুলনার চুইঝাল কেন বিখ্যাত?

আমরা জানি কোন খাবার সুস্বাদু করার জন্য সব থেকে বেশি কাজ করে এতে ব্যবহার করা মশলা। ভারতীয় উপমহাদেশে মশলার প্রচলন সব থেকে বেশি। যদিও মধ্যপ্রাচ্য এলাকায় অনেক ধরনের মশলা ব্যবহার করা হয় তবে উপমহাদেশে ঝাল স্বাদের মশলা সব থেকে বেশি প্রচলিত। 

এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশ ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চুইঝাল – chuijhal নামক একটি বিশেষ মশলা পরিচিতি পায়। বিশেষ করে বাংলাদেশে গরু ও ছাগলের মাংস রান্না করার সময় দক্ষিণাঞ্চলে চুইঝাল ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের রংপুর, চট্টগ্রাম এবং সিলেটে চুইঝাল বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন হয়। 

চুইঝাল অল্প সময়ে এত বেশি জনপ্রিয়তা পাওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে এটি তরকারিতে এক অন্য ধরনের স্বাদ যোগ করে। চুইঝাল যুক্ত তরকারি অনেক গাঢ় এবং রসালো হয় যা খেতে সহনীয় মাত্রায় ঝাল স্বাদ সমৃদ্ধ। অন্যদিকে এই মশলা থেকে সুন্দর একটি ঘ্রাণ আসে যা খাবারের রুচি আরও বৃদ্ধি করে। 

এই কারণে ধীরে ধীরে চুইঝাল সমৃদ্ধ রান্নার চাহিদা বৃদ্ধি পায়। যাইহোক, চুইঝাল যুক্ত খাবার অনেক সুন্দর ঘ্রাণ যুক্ত এবং অনেক সুস্বাদু। এই কারণে মাংস ব্যতীত অন্যান্য তরকারি এবং খিচুড়িতে অবাধে এই মশলা ব্যবহার করা হয়। সময়ের সাথে সাথে দক্ষিণবঙ্গের সকল জেলা সহ ঢাকায় এই মশলার কদর বৃদ্ধি পেতে থাকে। 

মানুষের মধ্যে এত চাহিদা সৃষ্টি হওয়ার জন্য কয়েকদিনের ব্যবধানে অনেক হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট গড়ে উঠে। কিছু কিছু হোটেল এবং রেস্টুরেন্ট শুধু চুইঝাল দিয়ে রান্না করা গরু, হাস ও ছাগলের মাংসের উপর নির্ভর করে গড়ে ওঠা।  

খুলনার চুইঝালের ইতিহাস

মনে করা হয় চুইঝাল সর্বপ্রথম প্রচলন হওয়া শুরু করে বাগেরহাটে। তবে সময়ের সাথে সাথে খুলনার চুইঝাল (Khulnar chuijhal) দেশ এবং বিদেশে সুনাম অর্জন করে। খুলনার চুইঝালের কথা যখন আসে তখন সবার আগে মনে পরে আব্বাসের হোটেলের কথা। 

চুইঝাল দিয়ে ছাগলের মাংস রান্না করার জন্য দেশে এবং বিদেশে বিশেষ সুনাম অর্জন করেছে এই হোটেল। মূলত এই হোটেলের মালিক আব্বাস আলী মোড়ল বসবাস করতেন উক্ত অঞ্চলের চুকনগরের। তারপর তিনি ভারতের মাদ্রাজ থেকে চুইঝাল দিয়ে এক বিশেষ পদ্ধতির রান্না শিখে আসেন। 

তারপর ডুমুরিয়া উপজেলার চুকনগর বাজারে চুইঝাল হোটেল স্থাপন করেন যা আব্বাসের হোটেল নামে সুপরিচিত। তিনি সুনামের সাথে হোটেল পরিচালনা করার পাশাপাশি তার তিন ছেলেকে পরবর্তী প্রজন্মের জন্য তৈরি করতে থাকেন। এক পর্যায় তিনি মারা গেলে তার তিন সন্তান ব্যবসার হাল ধরেন এবং বর্তমানে আবাসের হোটেল পরিচালনা করছেন। 

তাদের হোটেলের বিশেষত্ব হচ্ছে তারা খুলনা-বাগেরহাটের খাঁটি চুইঝাল দিয়ে ছাগলের মাংস রান্না করে। খুলনায় এরকম আরও অনেক প্রতিষ্ঠান আছে যারা শুধু চুইঝালের উপর নির্ভর করে তাদের প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছে। 

যাইহোক, খুলনা অঞ্চল চুইঝাল মশলা গোটা দেশব্যাপী প্রচারণা চালানোর মাধ্যমে জনপ্রিয়তার সৃষ্টি করেছে। তাছাড়া দেশের সব থেকে উন্নত ও ভালো মানের চুইঝাল শুধু মাত্র খুলনা ও বাগেরহাটে পাওয়া যায়। যে কারণে স্থানীয় সরকার চুইঝালকে উক্ত অঞ্চলের ঐতিহাসিক ধারক হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করছে। 

দামের দিক থেকে অঞ্চল এবং মানের উপর নির্ভর করে ৪০০ থেকে ১৮০০ টাকা প্রতি কেজি হিসেবে চুইঝাল বিক্রি হয়। যা হিসেব করলে দেখা যায় প্রতি কেজি সব থেকে নিম্ন মানের চুইঝাল ২০০ থেকে সব থেকে উন্নত মানের গুলো ২০০০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়। 

চুইঝালের উপকারিতা 

যদিও চুইঝাল একটি মশলা তবে এর অনেক পুষ্টিগুণ রয়েছে। বিশেষ করে এই উদ্ভিদের শিকড় থেকে শুরু করে বাকি সব জায়গা ভেষজ ক্ষমতা সম্পন্ন। তাছাড়া এই উদ্ভিদে আইসোফ্লাভোন, অ্যালকালয়েড, পিপালারিটিন, পোপিরন, পোলার্টিন, গ্লাইকোসাইডস, মিউসিলেজ, গ্লুকোজ, ফ্রুকটোজ, সিজামিন, পিপলাস্টেরল থাকে। এই সকল উপাদানের সাথে থাকা অন্যান্য উপাদান ক্যানসার, হৃদ্‌রোগ, শরীরব্যথা, ক্ষুধামান্দ্য, গ্যাস্ট্রিক, অ্যাজমা, অনিদ্রাসহ অসংখ্য রোগের প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। 

তাছাড়া চুইঝাল কফ পরিষ্কার করার পাশাপাশি সর্দি জ্বর ভালো করে। এতে থাকা ঝাঁজ ভাব যে কোন সর্দি এবং কাশীতে বিশেষ উপকার করে। যে কোন ব্যথা দ্রুত কমার সাথে সাথে চুইঝাল টনসিল ও লিভার সমস্যায় টনিক হিসেবে কাজ করে। 

এই সকল কিছুর সাথে চুইঝাল খেলে সিজার রোগীরা অনেক উপকার পায় যে কারণে শুধু মাংসের স্বাদ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি অনেকেই এই মশলা তাদের নিত্যদিনের সকল রান্নার তালিকায় যোগ করছে। এতে একদিকে যেমন সুস্বাদু খাবার রান্না হচ্ছে অন্যদিকে সেই খাবারের পুষ্টিগুণ আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। 

খুলনার চুইঝাল রেসিপি

খুলনার চুইঝাল রেসিপি

চুইঝাল একটি সর্বজনীন মশলা। যদিও বর্তমানে চুইঝাল শুধু মাংসের সাথে জনপ্রিয়তা পেয়েছে তবে এর নানামুখী ব্যবহার শুরু হয়েছে যা নিচে দেওয়া হলো। 

ঝালমুড়ি

চুইঝাল ব্যবহার করে বিভিন্ন মাংস রান্না করার পাশাপাশি এর ভিন্নধর্মী ব্যবহার শুরু হয়েছে। এর মধ্যে ২০ টাকায় পাওয়া বিখ্যাত আনয়ার ভাইয়ের ঝালমুড়ি অন্যতম। মূলত ১ পিস চুই ঝাল, ১টি আস্ত রসুূন এবং চুই এর মশলার সাথে মুড়ি মিশিয়ে এই ঝালমুড়ি তৈরি করা হয় যা উক্ত এলাকায় বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছে। সাধারণত আনয়ার ভাইয়ের ঝালমুড়ির এত পরিমাণ চাহিদা যে তা ফোন করে পূর্বে থেকেই সিরিয়াল নিতে হয়। 

রসুনের ঝালমুড়ি ও চানাচুর মাখা

খুলনার অদূরে খালিশপুরে মাত্র ৫ টাকায় পাওয়া যায় বিশেষ চুইঝাল রসুন। এর সাথে এখানে ৫ টাকায় চানাচুর মাখা পাওয়া যায়। দুটো খাবারেই চুইঝাল মশলা এবং ঝোল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই কারণে সন্ধ্যা থেকে বিক্রি শুরু হয়। তবে সুস্বাদু এই রসুন ও চানাচুর মাখা খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। উক্ত এলাকায় ঘুরতে গেলে অবশ্যই এই খাবার একবার চেষ্টা করে দেখবেন। 

ছোলার ঘুগনি

খুলনা থেকে একটু দূরে দৌলতপুর এলাকায় মাত্র ১০ টাকা প্লেট দরে চুইঝাল সমৃদ্ধ ছোলার ঘুগনি পাওয়া যায়। স্বাদে অসাধারণ এই খাবার চুইঝাল মশলার কারণে আরও বেশি সুস্বাদু হয়। অন্যদিকে বিকেল চারটা থেকে শুরু হওয়া এই স্ট্রিট ফুড দোকানে খুব দ্রুত ঘুগনি বিক্রি হয়ে যায়। 

ছোলা ভুনা

ভুনা ছোলা খেতে আমরা কে না ভালোবাসি। যদি এর সাথে চুইঝালের মত উৎকৃষ্ট মশলা যোগ করা হয় তবে স্বাদ দ্বিগুণ হয়। খুলনা শহরের বড়বাজার এলাকায় ১৫ টাকার চুইঝাল ছোলার প্লেটে ২টি আস্ত চুইঝাল রসুন দিয়ে পরিবেশন করা হয়। 

প্রতিটি জেলা ও অঞ্চল ভিত্তিক বিখ্যাত কিছু খাবার, জিনিস কিংবা জায়গা থাকে। যা ঐ জেলার বিখ্যাত বা ফেমাস। যেমন বগুড়া দই মিষ্টির জন্য, গাইবান্ধা রসমঞ্জুরি, পাবনার ঘি, প্যারা সন্দেস, নওগা জেলার প্যারা সন্দেস, পোড়াবাড়ির চমচম ইত্যাদি।

Bornali Akter Borno

Bornali Akter Borno is a passionate food enthusiast and entrepreneur. From an early age, her love for culinary exploration led her to experiment with flavors and ingredients, ultimately inspiring her to work with Binni Food, an e-commerce brand dedicated to offering premium quality Organic Food and delectable treats to food enthusiasts in Bangladesh. Bornali's relentless pursuit of flavor and commitment to excellence have earned her recognition in the culinary world. Her journey is a testament to the power of passion and perseverance, showcasing how dedication to one's craft can lead to entrepreneurial success and culinary innovation.