সবুজ ও হলুদ বর্ণের পাঁচ কিনারা বিশিষ্ট কামরাঙা নামের ফলটি আমাদের বেশ পরিচিত। আমাদের বাড়ির আশে পাশে গাছটি বেড়ে উঠতে দেখা যায়। অনেকেই গাছে চড়ে কামরাঙা পেরে লবন ও মরিচ দিয়ে মাখিয়ে খেয়েছেন। এমন সব স্মৃতি আমাদের শৈশবের সাথেই জড়িয়ে আছে। কামরাঙা কাচা অবস্থায় খেতে কিছুটা টক লাগে।
তবে হালকা পেকে হলুদ হয়ে এসে মিষ্টি স্বাদ পাওয়া যায়। আবার বেশি পেকে গেলে স্বাদ হারিয়ে যায়। কামরাঙা ফলটি অন্যান্য ফলের চেয়ে কম দামেই বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। এটি এমনিতেই খাওয়া যায়। অনেকে তরকারি রান্নার করে খেয়েও থাকেন। এছাড়াও কামরাঙা দিয়ে চাটনি ও কামরাঙা আচার তৈরি করে খেতেও কিন্তু বেশ মজাদার। আজকে আমরা আলোচনা করবো কামরাঙ্গার আচার কিভাবে তৈরি করে এবং খাওয়ার উপকারিতা।
কামরাঙা আচার
আচার আমাদের খুবই পছন্দের একটি মুখোরোচক খাবার। ছোট বেলা থেকেই মায়ের হাতের তৈরি বড়ই, আম, চালতা, জলপাই ইত্যাদি আচার খেয়ে আসছি। কামরাঙ্গার আচার যে সুস্বাদু হয় তা অনেকের হয়তো জানা নেই। অনেকে কামরাঙা ফলটি কিছুটা টক হওয়ায় খেতে পারেন না। তারা চাইলেই টক ঝাল মিষ্টি স্বাদের কামরাঙ্গার চাটনি বা আচার তৈরি করে নিতে পারে। এই আচারের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো, অন্যান্য ট্রেডিশনাল আচারের মতো তৈরি করে রোদে দিতে হয় না। তাহলে চলুন কামরাঙ্গার আচারের তিনটি রেসিপি জেনে নেওয়া যাক-
রেসিপি ১
উপকরণ
১) কামরাঙা ১ কেজি,
২) রসুন বাটা ১ চা চামচ,
৩) আদা বাটা ১ চা চামচ,
৪) ধনে গুঁড়ো ১ চা চামচ,
৫) পাঁচফোড়ন গুড়ো ১ টেবিল চামচ,
৬) শুকনো মরিচ গুড়ো ১ টেবিল চামচ,
৭) চিনি ১ কাপ,
৮)তেল হাফ কাপ,
৯) সিরকা ১ চা চামচ,
১০) লবন পরিমাণমতো
প্রস্তুতপ্রণালী
প্রথমে কামরাঙ্গাগুলো ভালো করে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। তারপর পাতলা স্ল্যাইস করে কেটে নিতে হবে। এবং ভিতরের বিচি ফেলে দিতে হবে। এরপরে একটি কড়াই বা ফ্রাইপ্যানে তেল গরম হলে এলে সবগুলো মসলা দিয়ে ভালো করে কষিয়ে নিতে হবে। মসলা কষানো হলে কামরাঙ্গা, স্বাধমতো লবন, চিনি ও সিরকা দিয়ে জ্বাল দিতে হবে। কামরাঙা সিদ্ধ হয়ে এলে কিছুক্ষণ ভালো করে নাড়তে হবে। এবার আচার মাখো মাখো হলে পাঁচফোড়নের গুড়ো ছিটিয়ে চুলা থেকে নামিয়ে নিতে হবে। আচার ঠান্ডা করে এয়ারটাইট বক্স বা কাচের জারে সংরক্ষণ করতে হবে।
রেসিপি ২
উপকরণ
১) পাতলা স্ল্যাইস করে কাটা ২ কাপ কামরাঙ্গা
২) চিনি ১ কাপ, (মিষ্টি বেশি পছন্দ হলে দেড় কাপ ব্যবহার করা যাবে)
৩) আদা স্লাইস আড়াই চা-চামচ
৪) রসুন ১ চা চামচ
৫) শুকনো মরিচ গুড়ো ২ চা চামচ
৬) সিরকা১/৩ কাপ
৭) লবন স্বাদ অনুযায়ী
প্রস্তুতপ্রণালী
পাতলা স্ল্যাইস করে কাটা কামরাঙা প্রথমে লবন মেলে দেড় থেকে দুই ঘণ্টার জন্য রেখে দিতে হবে। এরপরে পানি দিয়ে ধুয়ে পানি ঝড়িয়ে নিতে হবে। একটি ফ্রাইপ্যানে সবগুলো উপকরণ একসাথে মিশিয়ে নিতে হবে। মাঝারি আচেঁ চুলায় জ্বাল দিতে হবে। কামরাঙা সেদ্ধ হয়ে আচার তৈরি হয়ে এলে চুলা থেকে নামিয়ে ঠান্ডা হতে দিতে হবে। এরপরে পরিষ্কার শুকনো কাচের বোয়ামে রেখে দিতে হবে।
রেসিপি ৩
উপকরণ
১) মাঝারি ভাবে কেটে রাখা কামরাঙা ২৫০ গ্রাম
২) পাঁচফোড়ন হাফ ১/২ চা চামচ
৩) শুকনো মরিচ গুড়ো ১ টেবিল চামচ
৪) লবন ১/২ চা চামচ
৫)সরিষার তেল ১ কাপ
৬) ধনে গুড়ো ১ টেবিল চামচ
৭) হলুদের গুড়ো ১ চিমটি
৮) বিট লবণ ১/২ চা চামচ
৯) সাদা সরিষা বাটা ১ টেবিল চামচ
১০) চিনি ১/৪ কাপ
১১) তেঁতুলের কাথ হাফ কাপ
১২)শুকনো লাল মরিচ ৫/৬টি
প্রস্তুতপ্রণালী
প্রথমে তেঁতুলের কাথ তৈরি করে নিতে হবে। তেঁতুলের কাথ তৈরির প্রসেস হলো ২৫০ গ্রাম তেঁতুলের মধ্যে ১ কাপ পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখতে হবে। আধা ঘন্টা পরে তেঁতুল হাত দিয়ে ভালোভাবে কচলিয়ে নিতে হবে। ব্যস এভাবেই খুব সহজেই তেঁতুলের কাথ তৈরি করা যায়। চুলায় একটি কড়াই বা ফ্রাইপ্যান বসিয়ে সরিষার তেল গরম করে নিতে হবে। এর মধ্যে পাঁচফোচড় ও শুকনো লাল মরিচ দিয়ে কিছুসময়ের নেড়ে কেটে রাখা কামরাঙা দিতে হবে।
কামরাঙাগুলোর কালার একটু চেঞ্জ হয়ে এলে একে একে সকল মসলার উপাদান দিতে হবে। চুলার আঁচ হাই ফ্রেমে রেখেই পুরো রান্নার প্রসেস শেষ করতে হবে। ভালো করে মসলা কষিয়ে চিনি দিয়ে নিতে হবে। এরপরে কামরাঙা সিদ্ধ হয়ে ও চিনি সিরায় পরিনিত হলে চুলা থেকে নামিয়ে পরিষ্কার একটি পাত্রে রাখতে হবে। আচার ঠান্ডা হওয়ার পরে সংরক্ষনের জন্য কাচের বোয়ামে রাখতে হবে।
কামরাঙা আচার খাওয়ার উপকারিতা
কামরাঙা একটি পুষ্টিগুণ ভিটামিন সি ও এ যুক্ত একটি ফল। এছাড়াও রয়েছে ভিটামিন বি ও খনিজ উপাদান যেমন ক্যালসিয়াম, পটাসিয়াম, জিঙ্ক, আয়রন, ফসফরাস ইত্যাদি। প্রতি ১০০ গ্রাম কামরাঙ্গায় ৩১ কিলোক্যালরি পাওয়া যায়। এতে খাদ্য ফাইবার ২.৮ গ্রাম, শর্করা ৬.৭৩গ্রাম, চিনি ৩.৯৮গ্রাম, প্রোটিন ১.০৪ গ্রাম, স্নেহ ০.৩৩ গ্রাম, ভিটামিন ৩৪.৪ মিলিগ্রাম রয়েছে।
কোষ্টকাঠিন্য রোধ
অনেকে কোষ্টকাঠিন্যতায় ভুগেন, তারা চাইলে কামরাঙা আচারটি খেতে পারেন। যেহেতু কামরাঙা একটি আঁশ জাতীয় ফল। তাই কামরাঙার আচার খেলে কোষ্টকাঠিন্য সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
রুচি বৃদ্ধি
অনেক সময় আমাদের মুখে রুচি না থাকার কারণে পেটে খুদা থাকা শর্তেও পর্যাপ্ত পরিমাণে খাবার গ্রহন করেত পারিনা। পরবর্তীতে শরীরের ইমিউনিটি সিস্টেম দুর্বল হয়ে পরলে সহজে শরীরে রোগ বাসা বাধে। এক্ষেত্রে রুচি বৃদ্ধির জন্য কামরাঙ্গার আচার খাওয়া যেতে পারে। কামরাঙ্গাতে থাকা ভিটামিন সি আমাদের রুচি বৃদ্ধি করতে সহায়ত করে।
কোলেস্টরেলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ
শরীরের রক্তে খারাপ কোলেস্টরলের মাত্রা বাড়লে আমাদের হার্টের অনেক ধরনের রোগ দেখা দিতে পারে। এমনকি উচ্চ রক্তচাপ সৃষ্টি হতে পারে। তবে কামরাঙ্গার আচার খেলে ক্ষরিকারক কোলেস্টরেলের মাত্রা কমিয়ে, ভালো কোলেস্টরেল বাড়িয়ে এর মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে সাহায্য করে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে
কামরাঙ্গায় পটাশিয়াম ও সোডিয়াম বিদ্যমান হওয়ায় উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে কামরাঙ্গার আচার খেলে বেশ উপকার পাওয়া যাবে।
ক্যান্সার প্রতিরোধ
কারমাঙ্গার আচারে উপস্থিত রয়েছে এলজিক এসিড ও বিটা ক্যারোটিন। যা খাদ্যনালির ক্যান্সার প্রতিরোধ ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট হিসেবে কাজ করে আমাদের শরীরের ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ
কামরাঙ্গার আচার খেলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা কমিয়ে ডায়াবেটিস হওয়ার ঝুঁকি করায়।
হজম বৃদ্ধিতে
অতিরিক্ত তেল জাতীয় খাবার খাওয়ার ফলে হজম সমস্যা দেখা দেয়। এই সমস্যা দূর করে ও আমাদের খাবারের হজম ঠিক রাখতে কামরাঙার আচার বেশ কার্যকরী।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা
কামরাঙ্গার আচারে তেল ও বিভিন্ন মসলা ব্যবহার করা হয়। ফলে এই আচার খেলে মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
হার্ট সুস্থ রাখতে
চিকিৎসকরা বলেছেন, কামরাঙায় ভিটামিন বি-৯ ও ফলিক অ্যাসিড থাকে প্রচুর পরিমানে। এই আচার খাওয়ার ফলে আমাদের হার্ট অ্যাটাকের আশক্ষা কমিয়ে হার্টতে সুস্থ রাখতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
ত্বকের যত্নে
কামরাঙায় এমন অনেক উপাদান রয়েছে যা আমাদের ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা দূরে। যেমন- ব্রণ , ফুসকুড়ি ইত্যাদি। এই আচারটি খেলে ত্বক থাকে মসৃণ।
দাঁত ও মাড়ির স্বাস্থ্য
কামরাঙ্গাতে ভিটামিন সি থাকায় স্কার্ভি রোধ প্রতিরোধে সাহায্য করে দাঁত, মাড়ি ও হাড়কে সুস্থ রাখে। তাই নিয়মিত কামরাঙ্গার আচার খাওয়া যেতে পারে।
রক্ত জমাট বাধঁতে
কামরাঙার আচার থাকা উপাদান শরীরে রক্তের হিমোগ্লোবিনের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়। ফলে রক্ত সহজে জমাট বাধে।
ঠান্ডা দূর করতে
ঠান্ডা জনিত সমস্যায় এখন অনেকেই ভুগেন। বিশেষ করে বয়স্ক মানুষরা সহজেই জ্বর সর্দি কাশিতে ভুগতে থাকেন। এসকল সমস্যায় কামরাঙ্গার আচার প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে।
কামরাঙা আচার খাওয়ার সর্তকতা
কামরাঙ্গার আচারের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা অনেক। তবে কামরাঙ্গার অন্যতম একটি উপাদান হলো অক্সালিক অ্যাসিড। অতিরিক্ত কামরাঙার আচার খেলে কিডনিতে ক্ষতিকর প্রভাব পরে। কিডনির পাশাপাশি স্নায়ুতন্ত্রের আক্রমণের আশক্ষা রয়েছে। কামরাঙ্গায় থাকা এই উপাদানটি শরীর জমে গিয়ে কিডনি বিকল করতে পারে। এছাড়াও খালি পেটে কামরাঙা আচার খেলে ক্ষতির আশঙ্কা সব চেয়ে বেশি।
যাদের কিডনিতে সমস্যা আছে তারা কামরাঙা ফলসহ যেকোনো রেপিসি ও এর আচার খাওয়া থেকে বিরত থাকবেন। এবং যাদের কিডনিতে কোনো সমস্যা নেই তারা অল্প পরিমানে খেতে পারেন। কখনোই বেশি পরিমানে খাওয়া যাবে না। এবং সঠিক পরিমানে দীর্ঘদিন পর্যন্ত না খাওয়াই উত্তম। অন্যথায় কিডনির ওপর প্রভাব প্রভাব ফেলতে পারে। ডায়াবেটিস রোগিদের কামরাঙা খাওয়ার পূর্বে ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়া প্রয়োজন। ডায়াবটিস থেকেই কিডনির সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি।
গর্ভকালীন সময়ে গর্ভবতি নারীরা একটি সেন্সিটিভ সময়ের মধ্যে দিয়ে যান। সেক্ষেত্রে কামরাঙা বা কামরাঙ্গার আচার খাওয়া যাবে কিনা এটি নিয়ে চিন্তা হতে পারে। এই সময়কালে অবশ্যই ডাক্তার দেওয়া পরামর্শ অনুযায়ী যেকোনো খাবার খাওয়া উচিত।
উপরিউক্ত আলোচনায় কামরাঙা তৈরি করার রেসিপি, এর স্বাস্থ্য উপকারিতা ও সতর্কতার বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। আশাকরি লেখাটি পড়ে আপনি কামরাঙা এবং এর আচার সম্পর্কে বিস্তারিত ধারনা লাভ করেছেন।