সরিষার তেল হলো সরিষার বীজ থেকে তৈরিকৃত তেল। গ্রামাঞ্চলে এই সরিষার তেল কে সর্ষের তেল নামেও বলা হয়ে থাকে। এই তেলটি তার অনন্য স্বাদ ও ঝাঁজের জন্য বিখ্যাত। প্রাচীন কাল থেকে রান্নার পাশাপাশি রুপচর্চা এবং অনেক ঔষুধ হিসেবে এই তেলের ব্যবহার লক্ষ্যনীয়।
সরিষা আমাদের দেশের একটি উল্লেখ্যযোগ্য অধিক চাষকৃত শস্যদানা। এই ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সরিষা দানা থেকেই তৈরি করা হয় খাটি সরিষার তেল। সরিষার তেল পিষ্ট করে তা থেকে তেল তৈরির জন্য রয়েছে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি। আজ আমরা জানব কীভাবে এই সরিষার তেল তৈরি করা এবং এই তেলের ব্যবহার সম্পর্কে।
সরিষা সম্পর্কে কিছু কথা
সরিষার তেল কীভাবে তৈরি হয় এটার আগে আমাদের সরিষা সম্পর্কে জানা উচিত। সরিষার তেল বা সরিষা দানা সম্পর্কে বিস্তারিত আমরা ক”জন জানি বলুন তো। আমার মনে হয় স্বাস্থ্যসচেতন মানুষ হিসেবে আমাদের সকলেরই যেকোনো খাবার সম্পর্কে পরিপূর্ন ধারনা রাখা উচিত। গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য যেন প্রত্যেকটা মানুষ কে আকৃষ্ট করে।
এর সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয় না এমন মানুষ খুজে পাওয়া মুশকিল। বিশেষ করে শীতকালে গ্রামের কোনো এক মেঠো পথ ধরে হাটার সময় সবুজ পাতা এবং হলুদ ফুলে ভরপুর পরিবেশ দেখে মুগ্ধ না হয়ে উপায় আছে বলুন। এসময় একটু মনোযোগ দিলে শুনতে পারবেন মৌমাছিদের কলরোব। বছরের এই ২টা মাসেই মৌমাছিরা এভাবে সরিষা ফুলের মধু সংগ্রহ করে।
যাইহোক সরিষার কিন্তু অনেক জাত রয়েছে। জাত অনুযায়ী এই সরিষা গুলো একটি আরেকটির চেয়ে আলাদা। সব ধরনের সরিষা বীজ থেকেই ভালো মানের তেল সংগ্রহ করা সম্ভব হয় না। বাংলাদেশে উল্লেখযোগ্য সরিষার জাত হলো মাঘী সরিষা, রাই সরিষা, চৈত্রা সরিষা, বারি সরিষা- ৯, বারি-১৪, বারি-১৫, বারি-১৭, বিনা সরিষা-৪, বিনা-৯, বিনা-১০ ইত্যাদি। এছাড়াও অনেক প্রজাতির সরিষা এর পরীক্ষামুলক চাষ শুরু হয়েছে।
ব্যাক্তিগত সাজেশন, আপনার মন খারাপ? ভাবছেন কোথাও ঘুরতে যাবেন! সময়টা যদি হয়ে থাকে নভেম্বর থেকে ডিসেম্বর বেশি ভাবনা চিন্তা না করে বেড়িয়ে পড়ুন উত্তরের জেলা গুলোর উদ্দেশ্যে। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ, পাবনা, বগুড়া, রংপুর, নীলফামারী, লালমনিরহাট, দিনাজপুর। ট্রেন যাত্রা হলে সেরা দৃশ্য উপভোগ করতে পারবেন গ্যারান্টি! আর উত্তরের দিকের এই যাত্রায় সরষের ফুল দেখার উদ্দেশ্যে হিমালয়ের ঠান্ডা বাতাস গায়ে লাগলে হালকা কাপুনির সাথে মনখারাপ এবং অবসাদ ও দূর হয়ে যাবে।
সরিষার তেল কীভাবে তৈরি করা হয়
সরিষা বীজ থেকে সরিষার তেল তৈরি করা হয় নির্দিষ্ট কিছু ধাপ বা পদ্ধতি অনুসরন করে।
১) সরিষা বীজ সংগ্রহ।
২) সরিষা বীজ প্রক্রিয়াকরন।
৩) সর্বশেষ ধাপ হলো সরিষা বীজ মাড়াইকরন বা বীজ থেকে তেল নিঃসরণ।
সরিষা তেল তৈরি পদ্ধতি
জমি থেকে সরিষা গাছ সংগ্রহ করার পর গাছ থেকে সরিষা দানা গুলোকে আলাদা করে নেওয়া হয়। এরপর ভালোভাবে পরিষ্কার করার পর পর্যাপ্ত রোদে শুকানো হয়। সরিষা বীজ গুলোকে অবশ্যই ভালো ভাবে পরিষ্কার করে নিতে হয় যেনো এতে কোনো পোকামাকড়, অথবা কোনো অপরিচ্ছন্ন বস্তু না থাকে। এর পর সরিষা গুলোকে ভালো ভাবে রৌদ্রে শুকিয়ে নেওয়া হয়। সর্বশেষ সরিষা দানা গুলো পিষ্ট করার মাধ্যমে তেল তৈরি করা হয়। এখানে দানা গুলো পিষ্ট করার জণ্য ২ টি পদ্ধতি অনুসরন করা হয়।
- ঘানির মাধ্যমে।
- মেশিনের মাধ্যমে।
ঘানি ভাঙ্গা এবং মেশিনে ভাঙ্গা সরিষার তেলের পার্থক্য
ঘানি ভাঙ্গা পদ্ধতি একটি সনাতন পদ্ধতি। প্রাচীন কাল থেকেই এই পদ্ধতিতে শতভাগ বিশুদ্ধ তেল প্রস্তুতকরন করা হয়ে থাকে। পরবর্তিতে আধুনিক পদ্ধতি হিসেবে মেশিনের মাধ্যমে কম সময়ে তেল তৈরি করা হয়।
সরিষার তেল খাওয়ার নিয়ম – শীতের সুস্থতায়
ঘানি ভাঙ্গা
ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেল অন্যান্য সব প্রসেসিং এর তুলনায় উর্ধ্বে। কেননা এতে কোন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়না। এটি একটি সনাতন পদ্ধতি। যা তৈরিতে দেশি সরিষা ব্যবহার করা হয় এবং কোল্ড প্রেস প্রক্রিয়ায় তেল উৎপাদন করা হয়। ঘানি ভাঙ্গা সরিষার তেলের গুনাগুন অক্ষুন্ন থাকার প্রধান কারণ প্রসেসিং এর সময় এতে খুব বেশি তাপ উৎপন্ন হয়না ফলে এর পুষ্টিগুন সঠিক থাকে।তেল ভাঙ্গানোর ঘানি ২ প্রকার।
- জন্ত চালিত– যেমনঃ গরুর ঘানি, মহিষের ঘানি, ঘোড়ার ঘানি।
- যন্ত্র চালিত– যেমনঃ মোটর চালিত কাঠের ঘানি।
মেশিনে ভাঙ্গানো
বর্তমানে বাজারে বিভিন্ন স্বয়ংক্রিয় মেশীন রয়েছে তেল ভাঙ্গানোর জন্য। মেশীনের মাধ্যমে অপেক্ষাকৃত কম সময়ে অধিক পরিমানে তেল নিঃসরণ করা সম্ভব হয়। তবে মেশিনে ভাঙ্গা সরিষার তেল উৎপাদনের ক্ষেত্রে লক্ষ করা যায় অধিক পরিমানে তাপ উৎপন্ন হয়। যে তাপের ফলে সরিষার অনেক উপকারী উপাদান পুড়ে নষ্ট হয়ে যায়। যার কারনে তেলের আসল পুষ্টিগুন নষ্ট হয়ে যায় এবং তা স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর।
কোল্ড প্রেসড সরিষার তেল কি?
কোল্ড প্রেসড মানে হলো ঘানিতে ভাঙ্গা তেল। এই পদ্ধতিতে কোনো রকম তাপ ছাড়াই বীজ থেকে তেল নিঃসরণ করা হয় এবং কোনো রাসায়নিক দ্রব্যের ব্যবহার করা হয় না। সাধারন কারখানাতে যখন তেল তৈরি করা হয় তখন এতে উচ্চ মাত্রার তাপ ব্যবহার করা হয়। এর ফলে তেলের গুনাগুন অনেকটাই নষ্ট হয়ে যায়। তবে কোল্ড প্রেসড পদ্ধতিতে তাপের পরিবর্তে হাইড্রোলিক প্রেসের মাধ্যমে সরিষা বীজ থেকে তেল টা তৈরী করা হয়। তাই একদম পিউর এবং অথনেটিক তেলের স্বাদ পেতে চাইলে আপনাকে কোল্ড প্রেসড তেল নির্বাচন করতে হবে।
সেরা দানা থেকেই সেরা সরিষার তেল
সেরা মানের সরিষার তেলের জন্য আপনাকে ভালো মান ও জাতের সরিষা দানা পেতে হবে। মাঘি, রাই, চৈত্রা, শ্বেতী, সোনালি, টরী, দৌলত, বারী ইত্যাদি নামে অনেক সরিষার জাত রয়েছে। এগুলোর মাঝে সবচেয়ে উন্নত মানের সরিষা জাত হলো মাঘী সরিষা। তবে শুধু এই মাঘী সরিষা থেকে তেল ভাঙ্গানো হলে এই তেলের কালার টা একদম কালোজিরা তেলের মতো কুচকুচে কালো দেখায়।
এছাড়া এই তেলের খৈল ও ভালো মানের হয় না। এতে করে বাজারে উপযুক্ত মুল্যে এই খৈল বিক্রি করা যায় না। ফলে শূধু মাঘী সরিষা থেকে তেল ভাঙ্গানো হলে এর উৎপাদন খরচ বেড়ে যায় যা সর্বসাধারনের সাধ্য এর বাহিরে চলে যায়। তবে মাঘী সরিষার সাথে সামান্য রাই সরিষা মিলিয়ে তেল ভাঙ্গানো হলে একদিকে যেমন এই তেলের কালার টা সুন্দর হয় ঠিক তেমনি এর ঘ্রান এবং ঝাঁঝ টাও বজায় থাকে।
সরিষার তেলের উপকারিতা
- সরিষার তেলে থাকা অ্যান্টিওক্সিডেন্ট রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
- সরিষার তেল পেটে জীবানুর সংক্রমণ বন্ধ করতে সহয়তা করে।
- ক্যান্সারের ঝুকি কমায়।
- ক্ষুধা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- দেহের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে।
- মুখের রুচি বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত সরিষার তেল খেলে ক্যান্সারের ঝুকি কমে যায়।
- হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
- এই তেলে রিবোফ্লাবিন(Reboflavin) এবং নায়াসিন (Niacin) থাকে। যা শরিরের মেটাবলিজম ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে।
- সরিষার তেলে থাকা ঝাজালো উপদান শ্লেষা ও অবরুদ্ধ সাইনাস পরিষ্কার করতে সাহায্য করে।
- মহিলাদের মাসিকের ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে।
- দাতের স্বাস্থ্য ভালো রাখে।
- বাতের ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে।
- বিভিন্ন পোকামাকড় এবং মশা তাড়াতে সাহায্য করে।
- সরিষার তেল পলিস্যাচুরেটেড ফ্যাট ও মনিস্যাচুরেটেড ফ্যাটে ভরপুর। এটি রক্তে কোলেস্ট্রেরল এর ভারসম্য বজায় রাখে।
- সরিষার তেল মস্তিষ্কের জন্য ভিষন উপকারি।
- সরিষার তেল রানান্র স্বাদ বৃদ্ধিতে সাহয্য করে।
- ত্বক ও চুল সুন্দর রাখতে সরিষার তেলের ভুমিকা অপরিসীম।
- সরিষার তেল হার্ট ভালো রাখতে সাহায্য করে।
উপসংহার
একটি খাবার যতোই পুষ্টি সমৃদ্ধ হয়ে থাকুক না কেন, অতিরিক্ত কোন খাবার খাওয়া উচিত না। তাই আমরা সরিষার তেল রান্নার কাজে এবং নানাবিধ ব্যবহারে সঠিক পরিমানে ব্যবহার করবো। সেই সাথে সঠিক পূষ্টি উপাদান এবং গুনাবলি পেতে চাইলে খাটি তেল ব্যবহার করতে হবে। তাই বাজার থেকে তেল কিনে আনার আগে যাছাই বাছাই করে খাটি তেল কেনা উচিত। আশা করছি আজকের এই লেখার মাধ্যমে আপনারা সরিষার তেলের তৈরি পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।