জিআই অথবা Geographical Indication পণ্য হল একটি অঞ্চলের ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য। অর্থাৎ এই এমন একটি প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে একটি পণ্যকে তার উৎপাদিত অঞ্চল হিসেবে চিহ্নিত করা। যেমন আমরা দই কিনতে গেলে সবার প্রথমে বগুড়ার দই খুঁজি। এখন বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় দই তৈরি করা হলেও শুধু বগুড়ায় তৈরি হওয়া দই এক নামে পরিচিত।
এখানে বগুড়ার দই সেই এলাকার ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। অর্থাৎ কোন নির্দিষ্ট পণ্যের জন্য আমরা একটি নির্দিষ্ট জায়গা চিনতে পারি। ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য চিহ্নিত করার প্রক্রিয়া সরকার কর্তৃক পরিচালিত হয়। এখন পর্যন্ত বাংলাদেশ সরকার মোট ১৭টি পণ্যকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। পৃথিবীর প্রায় সব দেশেই ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য আছে। আমাদের দেশে এই বিশেষ ভাবে পরিচিত পণ্যের স্বীকৃতি বৃদ্ধি পাচ্ছে। নিচে বাংলাদেশের এখন পর্যন্ত স্বীকৃত সব পণ্যের তালিকা দেওয়া হলো।
বাংলাদেশের সব জিআই পণ্যের তালিকা
জিআই পণ্য তালিকা করার প্রধান উদ্দেশ্য হলো উক্ত পণ্যের গুণগত মানদণ্ড বা নিৰ্দিষ্ট প্ৰস্তুত প্ৰণালী অথবা বিশেষত্ব নিশ্চিত করা। নিচে জিআই পণ্যের তালিকা এবং সংক্ষিপ্ত বিবরণী দেওয়া হলো।
বগুড়ার দই
দই দুধ থেকে তৈরি হওয়া একটি সুস্বাদু খাবার। ভারতীয় উপমহাদেশে সর্বপ্রথম এটি তৈরি করেন শেরপুরের ঘোষ সম্প্রদায়। তাদের হাত ধরেই দই বগুরা শহরে প্রবেশ করে এবং ধীরে ধীরে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে যায়। আমরা যাকে বগুড়ার দই বলি তা মূলত শেরপুরের তৈরি হয়। তবে কালের বিবর্তনে সেই দই এখন বগুড়ার দই নামে পরিচিত। বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় দই তৈরি করা হলেও বগুড়ার দইয়ের একটি স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে। এ কারণে বাংলাদেশ সরকার এই দইকে জিআই পণ্য হিসেবে ঘোষিত করেছে।
জামদানি
জামদানি সম্পূর্ণ হাতে বোনা হয় যার জন্য প্রয়োজন হয় বিশেষ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন কারিগরের। মূলত বাংলাদেশের নারায়ণগঞ্জের পাসে শীতলক্ষ্যা নদীর ধারে এই বস্ত্র তৈরি করা হয়। জামদানি তৈরি করতে বিশেষ আবহাওয়া ও পরিবেশের প্রয়োজন হয় যা শুধু শীতলক্ষ্যা নদীর ধারেই পাওয়া যায়। অন্যদিকে শুধু মাত্র এই নদীর পানি মিশিয়ে জামদানীতে রং মেসালে সেই রং দীর্ঘস্থায়ী হয়।
জামদানিকে এর স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যের কারণে একে মসলিনের উত্তরাধিকারী বলা হয়। ২০১৫ সালে বিসিক কর্তৃক জামদানিকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিতে আবেদন করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে একে বাংলাদেশের প্রথম ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।
ইলিশ মাছ
ইলিশ বাংলাদেশের মানুষের একটি আবেগের জায়গায়। স্বাধীনতার পূর্ববর্তী এবং তাৎক্ষণিক পরবর্তী সময়ে এই মাছের উৎপাদন যেমন অনেক বেশি ছিল তেমনি দামও হাতের নাগালে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে বিভিন্ন কারণে এই মাছের দাম সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যায়। মৎস্য বিষয়ক আন্তর্জাতিক সংস্থার মতে বিশ্বে ইলিশের মোট জোগানের ৮০% আসে বাংলাদেশে।
বাংলাদেশ সহ বিশ্বের আরও ১০ টি দেশে ইলিশ পাওয়া গেলেও সেগুলো বিলুপ্তির পথে। অন্যদিকে এই দেশে সরকারের হস্তক্ষেপে এই মাছের উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাধারণত পদ্মা এবং মেঘনা নদীর ইলিশ সব থেকে বেশি সুস্বাদু হয়। অন্যদিকে এই দুই নদীর অববাহিকা সহ বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় অঞ্চলে ইলিশ পাওয়া যায়। ২০১৭ সালে ইলিশ কে জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করার আবেদন করার পরের বছরেই তা স্বীকৃতি পায়।
ঢাকাই মসলিন
মসলিন একটি অতি পুরাতন বাংলার হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্য। আনুমানিক সতেরশো সালের দিকে মোঘল আমলে মসলিন কাপড়ের প্রচলন শুরু হয়। তৎকালীন সময়ে এটিই ছিল পৃথিবীর সব থেকে দামি কাপড়। সেই সময়ে বিভিন্ন দেশের রাজা বাদশা, উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা সবাই এই কাপড় ব্যবহার করত। দুঃখজনকভাবে ১৮৫০ সালের দিকে লন্ডনে ঢাকাই মসলিনের সর্বশেষ প্রদর্শনীর মাধ্যমে এই শিল্প বিলীন হয়ে যায়।
পরবর্তীতে ২০২১ সালে বাংলাদেশে পুনরায় মসলিন তৈরি করা শুরু হয়। বাংলাদেশ তাঁত বোর্ড ২০২০ সালে এই ঐতিহাসিক বস্ত্রকে জিআই পণ্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন করে যা পরবর্তীতে স্বীকৃতি পায়।
চাঁপাই নবাবগঞ্জের খিরসাপাত আম
অতুলনীয় স্বাদের খিরসাপাত আমে কোন আঁশ থাকে না। এটি অনেক রসালো ও ছোট আটির হয়ে থাকে। এই আম দেখতে যেমন সুন্দর তেমনি খেতে অনেক মিষ্টি ও সুস্বাদু। খিরসাপাত আম বাণিজ্যিকভাবে শুধু চাঁপাই নবাবগঞ্জে উৎপাদন হয়।
বাংলাদেশের আর কোনো অঞ্চলে এই আম উৎপাদিত হয় না। যদি উৎপাদন হয় তবে তা ওরিজিনাল খিরসাপাত আমের মত হয় না। এই কারণে এই ঐতিহ্যবাহী আমের বৈশিষ্ট্য ধরে রাখার জন্য বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট একে জিআই তালিকার অন্তর্ভুক্ত করার আবেদন করে যা স্বীকৃত হয়।
দিনাজপুর কাটারিভোগ
কাটারিভোগ চাল দেখতে অনেকটা কালিজিরা চালের মত সরু ও সুগন্ধযুক্ত হয়। এই চাল বাংলাদেশের অনেক জায়গায় উৎপাদিত হয় তবে এর উৎপত্তিস্থল হল বৃহত্তর দিনাজপুর অঞ্চল। সব এলাকায় এই চাল উৎপাদিত হলেও তা শুধু দিনাজপুর এলাকায় চাষ হওয়া কাটারিভোগ চাল বেশি সুগন্ধযুক্ত হয়। এই কারণে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট আবেদন করার পর শুধু মাত্র দিনাজপুরে উৎপাদিত কাটারিভোগ চালকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
কালিজিরা ধান
কালিজিরা ধানের খোসা কালো রঙের হয় তবে ভেতরে চাল খুব ছোট ও সুগন্ধ যুক্ত হয়। এই চাল সচরাচর পায়েস, পোলাও ও ফিরনি রান্না করার কাজে ব্যবহার করা হয়। আকারে অনেক ছোট এই সালা রঙের চাল সারা দেশেই জনপ্রিয়তা লাভ করে। মূলত এই চাল দেখতে অনেকটা কালোজিরা মশলার মত দেখা যায় যে কারণে এর এমন নাম। কালিজিরা ধানের উৎপত্তিস্থল হচ্ছে ময়মনসিংহ এলাকা। এটি জিআই পণ্য হিসেবে আবেদন করার পর ২০২১ সালে সরকার কর্তৃক কালিজিরাকে বাংলাদেশের জিআই পণ্য হিসেবে অনুমোদন দেওয়া হয়।
বিজয়পুরের সাদা মাটি
বিজয়পুর যা নেত্রকোণা জেলায় অবস্থিত তা সাদা মাটির জন্য সারাদেশে বিখ্যাত। মূলত এই এলাকায় প্রাকৃতিক কেওলিন বা অ্যালুমিনিয়ামসমৃদ্ধ মাটি পাওয়া যায় যা দেখতে চুনের মত সাদা। এই মাটি দিয়ে সিরামিকের বাসনকোসন, টাইলস, গ্লাসসহ অন্যান্য পণ্য তৈরি করা হয়। যদিও স্থান ভেদে এই মাটি কালো, লাল এবং ধূসর হতে পারে তবে সাদা রঙের মাটির কদর সব থেকে বেশি। বিজয়পুরের সোমেশ্বরী নদীর কাছে যে সাদা মাটির পাহাড় আছে তা এই এলেকার স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য বহন করে। এই কারণে বিজয়পুরের সাদা মাটিকে একটি জিআই পণ্য হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে।
রাজশাহী সিল্ক
সাধারণত তুঁতগাছের পাতা থেকে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তৈরি করা রেশম থেকে বিশেষ ধরনের সুতা তৈরি করা হয়। সেই সুতা দিয়ে তৈরি করা কাপড়কে সিল্কের কাপড় বলে। মূলত ১৭৫৯ সাল থেকেই রাজশাহীতে তুঁতগাছ উৎপাদিত হতো এবং তখন থেকেই রেশম সুতা তৈরি করার প্রচলন শুরু হয়। যেহেতু রেশম সুতা শুধু রাজশাহীতেই তৈরি করা হয় সেহেতু এই সিল্কের একটি আলাদা ভূতান্ত্রিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই কারণে ২০১৭ সালে রাজশাহী সিল্ককে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার আবেদন করা হলে ২০২২ সালে তা অনুমোদন পায়।
রংপুরের শতরঞ্জি
নির্দিষ্ট পরিমাণ মাটির উপর সুতা তান দিয়ে বাঁশ ও রশির উপর হাতে নকশা তৈরি করে শতরঞ্জি তৈরি করা হয়। এই শিল্প বৃহত্তর রংপুরে ঘাঘট নদের তীরে গড়ে ওঠে। তৎকালীন ইংরেজি গভর্নরের সহায়তায় এই সুতার তৈরি গালিচা বা শতরঞ্জি বিশ্ব দরবারে পরিচিতি পায়। রংপুর অঞ্চলে এই শিল্প নিহিত থাকার কারণে বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন এই পণ্য জিআই হিসেবে স্বীকৃতির আবেদন করে যা ২০২২ সালে তালিকাভুক্ত হয়।
রাজশাহী-চাপাইনবাবগঞ্জের ফজলি আম
বাংলাদেশে যত প্রকারের আম পাওয়া যায় তাদের মধ্যে ওজন এবং গঠনের দিক থেকে ফজলি আম সব থেকে বড়। খেতে মিষ্টি এই আম রাজশাহীর চাপাইনবাবগঞ্জে সব থেকে বেশি উৎপাদিত হয়। উক্ত এলাকায় অনেক ধরনের আমের জাত পাওয়া যায় যা চাপাইনবাবগঞ্জকে বাংলাদেশে এক বিশেষ স্থান দিয়েছে। ফল গবেষণা ইনস্টিটিউট ফজলি আমকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতির আবেদন করলে তা ২০২১ সালে নিবন্ধিত হয়।
বাগদা চিংড়ি
আমাদের দেশের দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চল এবং উপকূলীয় সমুদ্র এলাকায় সব থেকে বেশি বাগদা চিংড়ি পাওয়া যায়। লোনা পানির এই মাছ বিশ্বব্যাপী অনেক জনপ্রিয়। আমাদের দেশে বিভিন্ন আচার অনুষ্ঠান ও রেস্টুরেন্টে এই মাছ পাওয়া যায়। মৎস্য গবেষণা ইন্সটিটিউট একে জিআই হিসেবে চিহ্নিত করে আবেদন করলে তা ২০২১ সালে অনুমোদন পায়।
শেরপুরের তুলশীমালা ধান
তুলশীমালা ধান দেখতে লালচে এবং ছোট আয়তনের। এই চাল দেখতে সুন্দর এবং সুমিষ্ট সুগন্ধ যুক্ত। সাধারণত বিভিন্ন পিঠা, পায়েস, পোলাও, বিরিয়ানি ইত্যাদি রান্নার কাজে এই চাল ব্যবহার করা হয়। বাংলাদেশের শেরপুর জেলায় এই ধান সব থেকে বেশি উৎপাদন করা হয়। গুণগত মান এবং স্বাদ বজায় রাখার জন্য তুলসীমালা ধানকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
শীতল পাটি
শীতল পাটি বাংলাদেশের মসলিনের মতই একটি স্বনামধন্য পণ্য যা মোঘল আমল থেকে রাজ দরবারের শোভা বর্ধন করে আসছে। বিশেষত বাংলাদেশের সিলেট অঞ্চলের পাটি বেতি গাছ থেকে বেত সংগ্রহ করে তা থেকে বিশেষ বুনন পদ্ধতি ব্যবহার করে এই পাটি তৈরি করা হয়। শীতল পাটি এত সুনাম অর্জন করার পেছনে কারণ হল এটি অনেক আরামদায়ক। বিশেষ করে গরম কালে শীতল পাটিতে সুয়ে থাকলে শরীর শীতল থাকে। এই পণ্যের স্বতন্ত্রতা বজায় রাখার জন্য বাংলাদেশ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প করপোরেশন সরকারের কাছে জিআই সার্টিফিকেটের আবেদন করে যা ২০২১ সালে মঞ্জুর হয়।
চাঁপাই নবাবগঞ্জের আশ্বিনা আম
আশ্বিনা আম একটি বিশেষ জাতের আম যা আমের মৌসুম শেষ হওয়ার পর পাওয়া যায়। অর্থাৎ আমের মৌসুম শেষ হওয়ার ৪ বা ৫ মাস পর এই আম পাওয়া যায়। বিশেষ ধরনের এই আম খেতে অনেক সুমিষ্ট। মৌসুমি ফল না হওয়ায় বাজারে এই আমের দাম ভালো পাওয়া যায়। চাঁপাই নবাবগঞ্জের অনেক কম জায়গায় এখন বাণিজ্যিকভাবে এই আম চাষ করা হচ্ছে। ২০২১ সালে আশ্বিনা ও ল্যাংড়া আমকে একই সাথে জিআই পণ্যের অন্তর্ভুক্ত করা হয়।
নাটোরের কাঁচাগোল্লা
নাটোরের কাঁচাগোল্লা অনেক বিখ্যাত মিষ্টান্ন। এটি মূলত একটি সন্দেশ জাতীয় খাবার যাতে দুধ থেকে তৈরি করা ছানা ও চিনি মেশানো হয়। এটি খেতে অনেক সুস্বাদু এবং মজাদার। বাংলাদেশের অনেক জায়গায় সন্দেশ বা গোল্লা তৈরি করা হলেও নাটোরের কাঁচাগোল্লার স্বাদ অতুলনীয়। এই কারণে ঐতিহাসিক এই মিষ্টান্নকে জিআই পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।
চাঁপাই নবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আম
ল্যাংড়া আম খেতে অনেক সুস্বাদু এবং তীব্র সুগন্ধ যুক্ত। এটি দেখতে মাঝারি প্রকৃতির এবং আগা ও গোঁড়া ভিন্ন আকৃতির। দেশের অনেক জায়গায় এই আমের জাত পাওয়া গেলেও চাঁপাই নবাবগঞ্জের ল্যাংড়া আমের বৈশিষ্ট্য অনন্য। এই কারণে উক্ত অঞ্চলের আরও তিন ধরনের আমের সাথে ল্যাংড়া আমকে জিআই বা ভৌগোলিক নির্দেশক হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে।