মাছে ভাতে বাঙালি- প্রবাদ বাক্য শুনে শুনেই আজ কয়েক যুগ পেরোলো। কিন্তু শহরে থাকার সুবাদে এবং উচ্চ বাজারমূল্যে সেই মাছ আজ ধরা ছোয়া বাইরে। তবে বাঙালিয়ানা কিন্তু থেমে নেই। ধোঁয়া উঠা এক প্লেট গরম ভাত, আলু ভর্তা আর সাথে ডাল, সেই সাথে একটু খাঁটি গাওয়া ঘি, ব্যস আর কি লাগে? বড় বড় রেস্তোরার অনেক নামীদামী মেন্যুকেও হার মানাবে মুখরোচক এবং বাঙালির রসনা বিলাসের এই খাবার। আর মজার বিষয় কি জানেন? ঘি কিন্তু নিজেই বাড়িতে থেকে বানাতে পারবেন। তবে যারা ঝামেলা পোহাতে চান না, তাদের জন্যও হোমমেড ঘি কিনতেও পাওয়া যায় সুলভ মূল্যেই।
কিন্তু সমস্যা হয় অন্য এক জায়গায়। ঘি এর ক্ষেত্রে যদি স্বাদ এবং গন্ধটা একটু পরিবর্তন হয়ে যায় তবে মুখে তোলা হয়ে যায় অনেক দূর কি বাত। তাই কিনে আনার পর কিংবা নিজেই বাড়িতে বানানোর পর দরকার একটু বেশি যত্ন, যাতে নষ্ট না হয়ে যায় স্বাদের খাঁটি গাওয়া ঘি। আজকে আমরা ঠিক সে বিষয়কে কেন্দ্র করেই জানাব ঘি সংরক্ষণের উপায়। জানতে হলে সাথেই থাকুন।
খাঁটি গাওয়া ঘি কেন নষ্ট হয়?
কোনো কিছু সংরক্ষণের জন্য সবচেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় কোনটি বলুন তো? আপনি হয়তো বলবেন উপায়গুলো, তাই না? তবে মনে রাখা জরুরি, উপায়গুলো মূলত মূল সমস্যাকে কেন্দ্র করে সামনে আসে। আর তাই ঘি সংরক্ষণের উপায় জানতে হলে আমাদের আসলে বুঝতে হবে কি কি কারণে ঘি নষ্ট হয়। কেননা সে অনুযায়ী আমাদের উপায় বাৎলাতে হবে। মূলত কয়েকটি কারণে ঘি নষ্ট হয়, এর মধ্যে রয়েছে-
জল মিশ্রিত করা
জলে যেমন তেল মিশে না, একই ভাবে তেলে কখনো ঘিও মিশে না। কেননা ঘিকেও এক প্রকার চর্বি হিসাবেই আখ্যায়িত করা যায়, যা কিছুটা তেলের সমগোত্রীয়। আর সে কারণেই, না জেনে পানি কিংবা জল মিশ্রিত করা হতে পারে আপনার ঘি এর গুণাগুণ নষ্টের কারণ। সতর্ক থাকুন।
আলোকিত ও গরম পরিবেশে রাখা
ঘি সংরক্ষণের ক্ষেত্রে মূলত সবচেয়ে উপযোগী পরিবেশ হলো অন্ধকার একই সাথে ঠান্ডা পরিবেশ। এতে গুণাগণ ঠিক থাকে। তবে এর ব্যত্যয় ঘটলেই, ঘি নষ্ট হতে পারে যেমন অত্যধিক আলোকিত ও গরম পরিবেশ।
দুর্গন্ধ যুক্ত পাত্রে রাখা
ঘি সংরক্ষণের মূল কারণ কি জানেন? ঘি এর স্বাদ এবং গন্ধ যাতে নষ্ট হয়ে যায়। কেননা ঘি এত পছন্দ হওয়ার কারণের মধ্যে এ দুটো অন্যতম। আর এক্ষেত্রে আপনি যখন ঘি সংরক্ষণ করছেন দুর্গন্ধযুক্ত কোনো পাত্রে, ঘিয়ের স্বাদ কিন্তু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। শেষমেশ ঘিও নষ্ট।
প্লাস্টিকের পাত্র রাখা
আচ্ছা বলুন তো ঘি কি আধুনিক কোনো খাদ্য, পিজ্জা কিংবা বার্গারের মতো? না, এটা অনেক আগে থেকেই বাঙালি সংস্কৃতির সাথে জুড়ে আছে। আর মানুষ বহু আগে থেকেই একে সংরক্ষণের বিভিন্ন উপায় বের করেছে। যেমন তাদের একটা সাধারণ অভ্যাস ছিলো একে স্টিল কিংবা মাটির পাত্রে রাখা। যেখানে তা ভালো থাকতো। কিন্তু আমরা এখন প্লাস্টিক নির্ভর। তাই এসবে না গিয়ে প্লাস্টিকে চলে যাই। আর এটি ঘি নষ্ট হওয়ার অন্যতম একটি কারণ।
মোটামুটি এ কয়েকটি কারণেই ঘি নষ্ট হয়ে যেতে পারে। আর সেই সাথে উৎপাদনের সময় আরেকটি বিষয় মাথায় রাখতে হবে, আর তা হলো জালের বিষয়। কেননা, বেশি জাল কম জালের তফাতের কারণে ঘিয়ের শেলফ লাইফ কম বেশী হয়ে থাকে। যেমনঃ আমরা যারা বাড়িতেই ঘি বানাই, তারা যে কোন রকম করে হোক তৈরি করি। জালের বিষয়ে খেয়াল থাকে না। ফলে দেখা যায় কম জালের ঘি তৈরি হয়। যা সচরাচর পাতলা হয়ে থাকে। আর পাতলা ঘি সাধারণত কম দিন টিকে থাকে। তাই এ বিষয়টিও খেয়াল রাখা জরুরি।
ঘি সংরক্ষণের ৫টি উপায়
সমস্যা যেখানে সমাধানও সেখানেই। ইতোমধ্যে সমস্যার কারণ জেনে যাওয়ায় আপনি নিজেই বুঝতে পারছেন সম্ভাব্য সংরক্ষণের উপায়গুলো আসলে কি হতে পারে। বিষয়টা আরও পরিষ্কার করতে চলুন জেনে নেয়া যাক ঘি সংরক্ষণের ৫টি উপায়ঃ
ফ্রিজে সংরক্ষণ
ঘিয়ের ক্ষেত্রে শেলফ লাইফ বলতে একটা বিষয় থাকে। আর তা সাধারণত ৩ মাস হয়ে থাকে। তবে আপনি যদি একবারেই অনেকটুকু ঘি নিয়ে আসেন বা উৎপাদন করে থাকেন সেক্ষেত্রে হয়তো বা তা ৩ মাসের বেশি সময় রাখা লাগতে পারে। আর সেজন্য সহজ একটা পদ্ধতি হলো ফ্রিজে সংরক্ষণ। কোনো ঝামেলা পোহাতে না চাইলে, বেশিরভাগই এটি সাজেস্ট করবে।
শুকনা পাত্রে রাখা
ঘি নষ্ট হওয়ার কারণের মধ্যে আমরা আলোচনা করেছি, পানি পড়লে ঘি নষ্ট হতে পারে। কেননা ঘি এবং পানির সম্পর্ক খুব একটা মধুর না, হাহা। তাই পানি থেকে বাঁচাতে ঘিকে সংরক্ষণ করতে হবে পানি মুক্ত পরিবেশে। আর ঠিক সে কারণে শুকনা পাত্রে রাখা আবশ্যক।
পাত্র থেকে বের করতে শুকনা চামচ ব্যবহার
ঘি ব্যবহারের সময় আমাদের অবশ্যই পানিমুক্ত রাখার নীতিটা মনে রাখতে হবে। আর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, ঘি ব্যবহারের সময়টাতেই আমরা ভুলতে বসি, পানি কিংবা অন্যতরল মিশ্রিত চামচ ঢুকিয়ে ঘি বের করতে যাই। ফলে পানি লেগে যায়। আর দীর্ঘ যাত্রায় ঘি নষ্ট হয়। তাই অবশ্যই বের করার সময় শুকনা চামচ ব্যবহার করতে হবে।
দুর্গন্ধ যুক্ত পাত্রে না রাখা
ঘিয়ের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে ইতোমধ্যে জেনেছেন এর গন্ধ সমন্ধে। তাই গন্ধ যেন নষ্ট না হয় সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে একই সাথে দুর্গন্ধযুক্ত পাত্রেও রাখা যাবে না। আর তাহলে ঘি-কে সংরক্ষণ করা সম্ভব।
রোদ দেয়া
অনেকেই পরামর্শ দিয়ে থাকেন ব্যবহারের পূর্বে ঘিয়ের পাত্রকে রোদ দিতে। কেননা এতে শুকনো রাখাটা সহজ হয়। আর মাঝে মধ্যে ঘি ব্যবহারের পূর্বে ফ্রিজ থেকে বের করে রোদে রাখতেও পরামর্শ দেন অনেকেই। এতে ঘিকে ব্যবহার করাটা সহজ হয়।
মোটা দাগে এই ঘি সংরক্ষণের উপায় হিসাবে এই পাঁচটিকেই আমরা নির্বাচন করেছি, যা আশা করি আপনার রসনা বিলাসের সহযোগী হবে। তবে এই অংশটুকু শেষ করার আগে বিশেষ দু’ধরনের ঘি সমন্ধে জানানো আবশ্যক মনে করছি। কেননা এখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই কিনতে গেলে এই ঘি গুলো দেখা যায় । আর সেগুলো হলঃ
হোমমেড খোলা জারের ঘি
হোমমেড ঘি দ্বারা, মূলত বাড়িতে বানানো ঘিকে বুঝানো হয়। এটি বাড়িতে নিজেই বানাতে পারবেন আবার দোকানেও কিনতে পাওয়া যায়। আর তা সচরাচর খোলা জারে থাকে। এক্ষেত্রে তা সংরক্ষণের জন্য, আপনার নিয়ে আসা পরিমাণটুকু যদি ৩ মাসের বেশি থাকার সম্ভাবনা থাকে সেক্ষেত্রে ফ্রিজে সংরক্ষণ করুন।
ঘি কিভাবে বানায়? ঘি বানাতে কোন দুধ ও কত লিটার লাগে?
এয়ার টাইট পাত্রের ঘি
এই ঘি অত্যন্ত ভালো হয়ে থাকে এবং অনেকদিন পর্যন্ত টিকে। এয়ার টাইট হওয়ায় পানি কিংবা বাতাস থাকে না ফলে ব্যাকটেরিয়া কিংবা মোল্ডও জন্মায় না । ফলে ঘি ভালো থাকে।
ঘি চর্বি জাতীয় একটি খাদ্য এবং তা প্রাণিজ চর্বি হওয়ায় প্রথম শ্রেণির ফ্যাটের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত। ঠিক সে কারণেই এর পুষ্টিমান অনেক উঁচুমানের হয়ে থাকে। আর ঘি প্রেমীদের একইসাথে যেমন এর স্বাদ কিংবা গন্ধ পছন্দ তেমনিভাবে পুষ্টিমানও। সকল কিছু ঠিক রাখতেই ঘি সংরক্ষণের উপায় জানা জরুরি। ঘি গ্রহণের ক্ষেত্রে অবশ্যই সুষম খাদ্যের চার্ট অনুযায়ী নিজের যতটুকু প্রয়োজন ঠিক ততটুকুই খাবেন। কেননা অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়।
আশা করি পুরো পোস্টটি আপনার উপকারে এসেছে, পরবর্তীতে কি সমন্ধে জানতে চান, তা অবশ্যই কমেন্টে জানাবেন। ধন্যবাদ।