You are currently viewing ঘি কিভাবে বানায়? ঘি বানাতে কোন দুধ ও কত লিটার  লাগে?

ঘি কিভাবে বানায়? ঘি বানাতে কোন দুধ ও কত লিটার লাগে?

ঘি কেন এত সুস্বাদু ও পুষ্টিকর হয় তা নিয়ে বরাবরই আমাদের মধ্যে একটি কৌতূহল কাজ করে। বিশেষ করে উচ্চ মাত্রাত ফ্যাট থাকার পরেও ঘি কেন ওজন কমাতে সক্ষম এবং স্বাস্থ্যকর তা আমাদের অজানা। তবে এই লেখায় ঘি কীভাবে বানায়, কোন ঘি ভালো, কোন কোন খাবারের সাথে ঘি খাওয়া যায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি লেখাটি পরে আপনি ঘি কেন স্বাস্থ্যকর এবং কেন এত সুস্বাদু সে সম্পর্কে ধারণা লাভ করতে পারবেন। 

ঘি কীভাবে বানায়?

ঘি আধুনিক ও সনাতনী দুই পদ্ধতিতেই বানানো যায়। নিচে কীভাবে দুধের ক্রিম অথবা দুধের সর দিয়ে ঘি তৈরি করা হয় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো। 

দুধের সরের ঘি 

প্রাচীন আমল থেকেই ঘি তৈরি করার জন্য এই পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়। সাধারণত কয়েকটি নির্দিষ্ট পদ্ধতি অনুসরণ করে সরের ঘি তৈরি করা হয়। নিচে বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া হলো। 

দুধ সংগ্রহ 

আমাদের খাঁটি ঘি তৈরি করতে হলে সবার প্রথমে দুধের গুণগত মান ও এতে অবস্থিত ফ্যাটের পরিমাণের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। সাধারণত যে দুধে বেশি পরিমাণে ফ্যাট থাকে সেই দুধ থেকে বেশি পরিমাণে সর সংগ্রহ করা সম্ভব হয়। এতে বেশি পরিমাণে ঘি সংগ্রহ করার সম্ভাবনা বেড়ে যায়। 

যাইহোক, দেশি গাভীর দুধ খাঁটি ঘি তৈরি করার জন্য সব থেকে বেশি উৎকৃষ্ট। বিশেষ করে চর এলাকার গাভি অথবা যে গাভি সতেজ ও ভেজাল মুক্ত খাবার খায় তার দুধে পুষ্টিগুণ বেশি থাকে। এই কারণে সবসময় ভেজাল ও পানি মুক্ত গাভীর দুধ সংগ্রহ করতে হবে। 

সর সংগ্রহ 

খাঁটি দুধ সংগ্রহ করার পর তা থেকে সর তৈরি করার পালা। সাধারণত দুধ থেকে সর তৈরি করার প্রসেস অনেক লম্বা এবং সময়সাপেক্ষ। তাছাড়া দুধ থেকে খুব অল্প পরিমাণে সর পাওয়া যায় যা ঘি তৈরি করার জন্য যথেষ্ট হয় না। এই কারণে বাসায় ঘি তৈরি করতে চাইলে সারা সপ্তাহ জুড়ে দুধ জ্বাল করে তা থেকে সর তুলে একটি পাত্রে জমা করে তা ফ্রিজে রেখে দিতে হবে। 

তো দুধ থেকে সর পেতে গেলে আমাদের দুধ পরিমিত সময় ধরে জ্বাল করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় জ্বাল করার ফলে দুধ হালকা লাল রঙের হবে যা ঠান্ডা করার পর উপরে পাতলা সরের আস্তরণ পরবে। তারপর একটি চামচের সাহায্য নিয়ে সেই সর উপর থেকে তুলে নিতে হবে। 

সর মিক্সিং 

সারা সপ্তাহ সর সংগ্রহ করে তা ফ্রিজে রাখার ফলে তা জমে ক্ষীরের মত হবে। তখন সেই সংগ্রহ করা সর একটি মাটির বা স্টিলের পাত্রে রাখতে হবে। এখানে আপনি সনাতন পদ্ধতি ব্যবহার করে কিছু নারিকেলের পাতা প্রস্থে হাফ ইঞ্চি ও দীর্ঘে ৮ ইঞ্চি করে কেটে তা সরের খামিরের সাথে মিশিয়ে নিতে পারেন। কারণ ঘি তৈরির এই অংশে আমাদের সরগুলো মিক্সিং করে তা থেকে মাখন বের করে নিতে হবে। 

তো সর মিক্সিং করার জন্য যেমন ব্লেন্ডার অথবা ডাল ঘুঁটনি ব্যবহার করা যায় তেমনি হাতে মিক্সিং করার জন্য নারিকেলের পাতা ব্যবহার করা যায়। এখন যে পদ্ধতিতে সর মিক্সিং করেন না কেন সরে কোনো প্রকারের শক্ত অংশ থাকা যাবে না। বরং উক্ত মিশ্রণ একদম মিহি ও সফট হতে হবে। 

মাখন তৈরি 

মনে রাখবেন সর মিক্সিং করার সময় অবশ্যই ঠান্ডা পানি ব্যবহার করতে হবে। ঠান্ডা পানি ব্যবহারের ফলে সরের মিশ্রণ থেকে তরল মাখনের যে অংশ আছে তা দানা বাঁধতে শুরু করবে। দ্রুত নাড়ার কারণে সরের মিক্সিং থেকে মাখন উপরে ভেসে উঠবে এবং নিচে ঘোল পরে থাকবে। 

পরবর্তীতে ঘোলের উপর থেকে মাখনের অংশ গুলো ছাঁকনি ব্যবহার করে অন্য পাত্রে উঠিয়ে নিতে হবে। নিচে থাকা ঘোল অনেক সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর হয়। এই কারণে অবশ্যই ঘোল সংগ্রহ করে অন্য পাত্রে সংরক্ষণ করবেন। যাইহোক, মাখন উঠানো হলে তা একটি পাতলা সুতি কাপড় অথবা মসলিন কাপড়ে বেঁধে রাখতে হবে যাতে অবশিষ্ট পানি ঝরে যায়। 

মাখনের মধ্যে যদি পানি থাকে তবে তা থেকে ভালো ও উন্নতমানের ঘি তৈরি হয় না। এই জন্য খেয়াল রাখতে হবে মাখন যেন পানিমুক্ত হয়। 

ঘি সংগ্রহ 

মাখন একদম পানিমুক্ত করে তা একটি স্টিলের বা লোহার কড়াইয়ে ঢেলে নিতে হবে। মূলত এই মাখন জ্বাল করেই ঘি তৈরি করা হয়। কড়াইয়ে মাখন দিয়ে তা প্রথমে জোরে জ্বাল দিতে হবে ও ক্রমান্বয়ে তাপের মাত্রা কমিয়ে আনতে হবে। 

তো মাখন জ্বাল দেওয়ার সময় তা ক্রমাগত নাড়তে দিতে হবে। যত বেশি নাড়া পরবে ঘি তত পরিষ্কার ও দ্রুত তৈরি হবে। যখন মাখনে জ্বাল পড়বে তখন তা ধীরে ধীরে গলতে থাকবে এবং তেলে পরিণত হতে থাকবে। আর অবশিষ্ট মাখন গলতে গলতে একদম কড়াইয়ের নিচে জমা হবে। লম্বা সময় জ্বাল হওয়ার কারণে ঘি এর নিচে মাখনের অংশ পুড়ে কালো হয়ে যাবে। 

কালো হয়ে আসলে আর ঘি নেড়ে দেওয়া যাবে না। কারণ নাড়ার কারণে কালো পোড়া অংশ গুলো ঘিয়ের সাথে মিশে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। এখন জ্বাল বন্ধ করে দিয়ে ঠান্ডা হওয়ার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কিছুসময় রুম টেম্পারেচারের রাখার কারণে ঘি ঠান্ডা হয়ে যাবে। তখন চামচের মাধ্যমে উপর থেকে ধীরে ধীরে ঘি সংগ্রহ করে নিতে হবে। সমার উপরের স্তরের ঘি সব থেকে দেরিতে জমে যেখানে পরবর্তী স্তরের ঘি ক্রমান্বয়ে দ্রুত জমে যায়। 

দুধের ক্রিমের ঘি 

দুধের ক্রিম ব্যবহার করে ঘি তৈরি করা একেবারে ঘরোয়া পদ্ধতি। সনাতন পদ্ধতিতে যেখানে সর দিয়ে ঘি তৈরি করা হয় সেখানে এই পদ্ধতিতে ক্রিম ব্যবহার করা হয়। সাধারণত দুধের ক্রিম তৈরি করতে আপনাকে কাচা দুধ সংগ্রহ করতে হবে। 

কাচা দুধ ব্লেন্ডার করলে তা তরল কিন্তু হালকা শক্ত সাদা ক্রিমে পরিণত হয়। মূলত দুই পদ্ধতিতে ঘি তৈরি করার জন্য এখানেই পার্থক্য। বাকি স্টেপ গুলো দুই পদ্ধতিতেই একই। অর্থাৎ সনাতন পদ্ধতি এবং বর্তমান পদ্ধতির মধ্যে সর ও দুধের ক্রিমের পার্থক্য। 

এই পদ্ধতিতে আপনি ঘরে বসেই একদম খাঁটি গাওয়া ঘি তৈরি করতে পারবেন। এর স্বাদ যেমন অতুলনীয় হবে তেমনি দেখতে উজ্জ্বল ও সুঘ্রাণ যুক্ত হবে। চাইলেই পোলাও, কোরমা, বিরিয়ানি, নান রুটি এবং রোস্টের সাথে খেতে পারবেন। 

১ লিটার ঘি বানাতে কত দুধ লাগে?

১ লিটার ঘি বানাতে কত দুধ লাগে?

এক কেজি দুধ থেকে কতটুকু ঘি পাওয়া যাবে তা নির্ভর করে দুধে থাকা ফ্যাটের পরিমাণের উপর। সাধারণত দুধে যদি ৫% ফ্যাট থাকে তাহলে প্রতি ১০০ কেজি দুধে ৫ কেজি ফ্যাট থাকে। এখন এই ১০০ কেজি কে ৫ দিয়ে ভাগ করলে ২০ কেজি পাওয়া যায়। অর্থাৎ ফ্যাটের পরিমাণের উপরে হিসেব করলে ১ কেজি ঘি তৈরি করতে ২০ কেজি গরুর দুধের প্রয়োজন পরবে। এখানে ৫% উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে। 

আপনি যে দুধ দিয়ে ঘি তৈরি করবেন সে দুধে কি পরিমাণ ফ্যাট আছে তার উপর নির্ভর করে দুধের পরিমাণে তারতম্য হবে। যাইহোক, প্রতি কেজি ঘি তৈরি করতে ২৫ থেকে ৩০ কেজি গাভীর দুধ প্রয়োজন পরে। অন্যদিকে, ২০ কেজি মহিষের দুধ দিয়ে ১ লিটার ঘি বানানো সম্ভব। 

কোন দুধে ঘি তৈরি করা ভালো?

ঘি তৈরি করার সময় আমাদের সব থেকে বেশি গুরুত্ব দিতে হয় কোন দুধে বেশি পরিমাণ ফ্যাট থাকে। তাছাড়া দুধের ধরন ও কোয়ালিটির উপর এর স্বাদ নির্ভর করে। ঘি তৈরি করার জন্য সব থেকে বেশি ব্যবহার হয় গরুর ও মহিষের দুধ। তবে মহিষের দুধে ফ্যাটের পরিমাণ কম থাকার কারণে এটি অপেক্ষাকৃত কম জনপ্রিয়। 

অন্যদিকে গরুর দুধে বেশি পরিমাণে ফ্যাট থাকে। তাছাড়া গরুর দুধ খেতে বেশি সুস্বাদু ও সবসময় সব জায়াগায় পাওয়া যায়। খাঁটি গরুর দুধের ঘি এর গঠন সুন্দর হয়। অন্যদিকে গরুর দুধের ঘিতে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট থাকে যা শরীরের জন্য উপকারী। মহিষের দুধের থেকে গরুর দুধের গাওয়া ঘিতে পুষ্টি উপাদান বেশি থাকে। সর্বোপরি গরুর দুধের ঘি সব থেকে বেশি স্বাস্থ্যকর ও গরুর দুধে ঘি তৈরি করা সব থেকে ভালো। 

ঘি দিয়ে কি কি তৈরি করা যায়?

ঘি দিয়ে নানা পদের খাবার তৈরি করা যায়। এটি যেমন খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করে তেমনি স্বাস্থ্য উপকারিতা নিশ্চিত করে। নিচে ঘি কি কি কাজে ব্যবহার হয় তা বর্ণনা করা হলো। 

তেল হিসেবে 

তেল হিসেবে ঘি সেই প্রাচীন আমল থেকেই ব্যবহার করা হচ্ছে। এর স্মোক পয়েন্ট বেশি হওয়ার কারণে অতিরিক্ত তাপের কারণে ঘি তেলের মত অস্বাস্থ্যকর হয়ে ওঠে না। এই কারণে যে কোন তেলের থেকে ঘিতে রান্না করা খাবার বেশি সুস্বাদু হয় পাশাপাশি খাবারের পুষ্টিগুণ অক্ষুণ্ন থাকে। 

মাংস রান্না 

ঘি দিয়ে রান্না করা গরু ও খাসির মাংস যে একবার খাবে সে বারবার খেতে চাইবে। কারণ ঘি মাংসের স্বাদ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি সুঘ্রাণ বৃদ্ধি করে। 

মনসুর মিষ্টি 

মনসুর মিষ্টি থেকে শুরু করে প্রায় সকল ধরনের মিষ্টি ও সন্দেশে ঘি ব্যবহার করা যায়। স্বাদ বৃদ্ধি করার পাশাপাশি পুষ্টি উপাদান যোগ করার বিষয়ে ঘি এর কোনো জুড়ি নেই। 

পায়েস তৈরি 

ঘি দিয়ে পায়েস তৈরি করা যায়। স্বাদে অতুলনীয় ঘি দিয়ে তৈরি করা পায়েস দেখতে অনেক লোভনীয় হয়। 

নান রুটি তৈরি 

নান রুটিতে ঘি ব্যবহার করা অনেক প্রচলিত বিষয়। বিশেষ করে পরিবেশন করার সময় ঘি দিয়ে তার উপর টক সালাদ অথবা চাটনি দিলে তা গ্রিলের সাথে অথবা বারবিকিউের সাথে খাওয়ার থেকেও বেশি সুস্বাদু হয়। 

পোলাও ও বিরিয়ানি তৈরিতে 

পোলাও ও বিরিয়ানি তৈরি করতে ঘি ব্যবহার করা বেশ প্রচলিত। সাধারণত উক্ত খাবারের স্বাদ ও ঘ্রাণ বৃদ্ধি করার জন্য রান্নার সময় খাঁটি ঘি ব্যবহার করা হয়। 

উপরিউক্ত আলোচনায় কীভাবে ঘি তৈরি করা হয় সে বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে। এর পাশাপাশি ঘি কীভাবে এবং কেন গরুর দুধ দিয়ে তৈরি করা বেশি সুবিধাজনক তা বর্ণনা করা হয়েছে। অন্যদিকে কোন কোন খাবারের সাথে ঘি খাওয়া যায় সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা দেওয়া হয়েছে। তাই আপনি সরের কিংবা ক্রিমের, যে ঘি খান না কেন তার যদি খাটি ও ভেজালমুক্ত হয় তবে রান্না থেকে শুরু করে খালি মুখে খেলে অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা পাবেন।