You are currently viewing বিদেশি মাছ চেনার উপায় ও কেনার ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা 
বিদেশি মাছ

বিদেশি মাছ চেনার উপায় ও কেনার ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা 

বাংলাদেশের মাছ বাজারে দেশি মাছের পাশাপাশি বিদেশি মাছের চাহিদাও ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতি, খাদ্য সংস্কৃতির বৈচিত্র্য এবং প্রোটিন সমৃদ্ধ খাবারের চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ার কারণে বিদেশি মাছগুলি এখন বাজারে সহজলভ্য। তেলাপিয়া, পাঙাশ, কার্প ও চিংড়ির মতো বিদেশি মাছগুলো তাদের উচ্চ পুষ্টিগুণ এবং সহজ চাষাবাদ প্রক্রিয়ার জন্য জনপ্রিয়। এদের স্বাদ, পুষ্টিগুণ এবং চাষাবাদ পদ্ধতি স্থানীয় মানুষের কাছে বিশেষ গুরুত্ব লাভ করেছে। 

তবে, বাজারে মাছ কিনতে গেলে অনেকেই বিদেশি মাছের সাথে দেশি মাছের পার্থক্য করতে কষ্ট পান। সঠিকভাবে বিদেশি মাছ চেনা এবং জানার মাধ্যমে ক্রেতারা নিশ্চিত হতে পারেন যে তারা সুস্বাদু ও স্বাস্থ্যকর মাছ কিনছেন। এই লেখায় বিদেশি মাছ চেনার উপায় এবং কোন প্রজাতির মাছ কোন অঞ্চলে বেশি পাওয়া যায় তা বিস্তারিত আলোচনা করা হবে।

জনপ্রিয় বিদেশি মাছ গুলো চেনার উপায় কি?

বিদেশি মাছগুলো তাদের আকার, রঙ, আঁশ, স্বাদ এবং অন্যান্য শারীরিক বৈশিষ্ট্যের কারণে দেশি মাছের তুলনায় আলাদা। নিচে কিছু জনপ্রিয় বিদেশি মাছ চেনার উপায়গুলো বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো-

তেলাপিয়া মাছ

তেলাপিয়া মাছ চেনার জন্য প্রথমে লক্ষ্য রাখতে হবে এর শরীরের গঠন এবং রঙের দিকে। এদের শরীর সাধারণত চ্যাপ্টা এবং ডিম্বাকৃতির হয়। তেলাপিয়া মাছের আকার ছোট থেকে মাঝারি হতে পারে, তবে প্রাপ্তবয়স্ক মাছগুলো বেশ বড় হতে পারে। এই মাছের রঙ ধূসর, কালচে, বা সবুজাভ হয়ে থাকে। 

বিশেষ করে এদের পাখনা ও লেজের অংশে লালচে বা গোলাপি আভা দেখা যায়। তেলাপিয়ার আঁশ ছোট, মসৃণ এবং চামড়া তুলনামূলকভাবে মোটা। এদের শরীরের গঠন ও রঙ দেখে সহজেই তেলাপিয়া মাছ চেনা যায়। এছাড়া, তেলাপিয়া মাছের মাংসের রঙ সাদা এবং রান্না করার পর এর স্বাদ বেশ নরম ও মিষ্টি লাগে।

জনপ্রিয় বিদেশি মাছ

পাঙাশ মাছ

পাঙাশ মাছের শরীর লম্বাটে এবং কিছুটা সিলিন্ডার আকৃতির। এটি বড় আকারের মাছ, যা প্রায় ২০-২৫ কেজি পর্যন্ত ওজন হতে পারে। পাঙাশ মাছের দেহ সাধারণত রুপালি এবং পিঠের অংশ কালচে রঙের হয়। এদের পেটের অংশ কিছুটা সাদা এবং মসৃণ। পাঙাশ মাছের আঁশ প্রায় অনুপস্থিত, যার ফলে এদের শরীর অনেকটা মসৃণ এবং পিচ্ছিল হয়ে থাকে। এ কারণে, অনেকেই সহজেই পাঙাশ মাছ চেনেন। এছাড়া, পাঙাশের মাথা তুলনামূলকভাবে ছোট এবং মুখ কিছুটা চ্যাপ্টা। এদের মাংস সাদা এবং তেলযুক্ত, যা রান্নার পর নরম ও সুস্বাদু হয়।

বিদেশি কার্প (কার্পিও)

বিদেশি কার্প মাছগুলি চেনার প্রধান উপায় হলো এদের শরীরের আকার এবং রঙ। এদের দেহ কিছুটা বৃত্তাকার এবং মসৃণ, যা দেশি কার্পের থেকে ভিন্ন। বিদেশি কার্পের রঙ সাধারণত সোনালি বা হালকা বাদামি হয় এবং এদের আঁশ বড় ও চকচকে। এদের পিঠের অংশ কিছুটা গাঢ় এবং পেটের অংশ হালকা রঙের হয়ে থাকে। বিদেশি কার্পের আঁশের বিন্যাস খুবই সুশৃঙ্খল, যা এদের সৌন্দর্য বৃদ্ধি করে। এদের পাখনা স্বচ্ছ এবং লেজ কিছুটা গোলাকৃতির হয়। এরা বড় আকারে বৃদ্ধি পায় এবং এদের মাংস বেশ মিষ্টি ও কোমল।

বিদেশি চিংড়ি (টাইগার প্রন বা ভেনামি)

বিদেশি চিংড়ি মাছ, যেমন টাইগার প্রন বা ভেনামি, এদের শরীরের গঠন ও রঙের মাধ্যমে সহজেই চেনা যায়। টাইগার প্রন সাধারণত বড় আকারের হয় এবং এদের দেহে কালো বা বাদামি ডোরা কাটা দাগ থাকে। ভেনামি চিংড়ি সাদা বা হালকা ধূসর রঙের হয় এবং এদের গায়ে কোনো দাগ থাকে না। এই চিংড়িগুলো সাধারণত লম্বায় বড় হয় এবং এদের দেহের গঠন কিছুটা পিচ্ছিল। এদের মাংস সাদা ও মিষ্টি স্বাদের হয়। দেশি চিংড়ির তুলনায় বিদেশি চিংড়ির স্বাদে একটু ভিন্নতা লক্ষ্য করা যায় এবং রান্না করার পর এদের মাংস বেশ নরম ও সুকোমল হয়।

মাছে ভাতে বাঙালি ঐতিহ্যের স্বাদে জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ

সিলভার কার্প

সিলভার কার্প মাছের দেহ লম্বাটে এবং উজ্জ্বল রুপালি রঙের। এই মাছের মাথা বড় এবং চোখ সাধারণত নীচের দিকে অবস্থান করে। সিলভার কার্পের আঁশ ছোট এবং মসৃণ, যা শরীরের ওপরের অংশে পিঠের দিক থেকে পাতলা হয়ে আসে। এদের পিঠের অংশ কিছুটা কালচে এবং পেটের অংশ রুপালি ও মসৃণ। সিলভার কার্প সাধারণত বড় আকারের হয় এবং দ্রুত বৃদ্ধি পায়। এদের মাংস সাদা, নরম এবং একটু তেলযুক্ত। রান্নার পর এর স্বাদ অনেকটাই নরম ও মিষ্টি হয়।

কোন প্রজাতির বিদেশি মাছ কোথায় ভাল জন্মায়?

বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রজাতির বিদেশি মাছের চাষ বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে, যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল তেলাপিয়া, পাঙ্গাস এবং কার্প প্রজাতি। তেলাপিয়া মাছটি প্রথমে আফ্রিকা থেকে এসেছে এবং বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে, বিশেষ করে দক্ষিণাঞ্চল ও উত্তরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে চাষ হচ্ছে। 

এরা উষ্ণ এবং মিষ্টি পানির জলাশয়ে ভালো জন্মায়। তেলাপিয়া মাছ দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং এর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি হওয়ায় এটি চাষীদের মধ্যে খুবই জনপ্রিয়। ২৪-৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা এবং মাঝারি গভীরতার জলাশয় এই মাছের জন্য উপযুক্ত।

অপরদিকে, পাঙ্গাস মাছ মূলত দক্ষিণ এশিয়ার একটি মাছ হলেও এটি বাংলাদেশের নদী ও পুকুরে খুবই পরিচিত এবং বাণিজ্যিকভাবে চাষ করা হয়। পাঙ্গাসের জন্য গভীর এবং প্রবাহমান পানি প্রয়োজন, তাই মেঘনা ও যমুনা নদীর তীরবর্তী এলাকাগুলি এই মাছের চাষের জন্য উপযুক্ত। ২৫-৩২ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই মাছ ভালভাবে বংশবৃদ্ধি করে। 

তাছাড়া, এর খাদ্য রূপান্তর ক্ষমতা বেশি হওয়ায় এটি দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক। এভাবে, তেলাপিয়া এবং পাঙ্গাস বাংলাদেশের চাষিদের কাছে বিদেশি মাছ চাষের ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রজাতি।

বিদেশি মাছের দাম

বিদেশি মাছের দামের বিভিন্নতা 

বাংলাদেশে বিদেশি মাছের দামের বিভিন্নতা মূলত মাছের প্রজাতি, চাহিদা, উৎপাদন খরচ এবং সরবরাহের ওপর নির্ভর করে। যেমন, তেলাপিয়া মাছের চাহিদা বেশি হলেও এটি উৎপাদনে সহজ এবং তুলনামূলকভাবে দ্রুত বৃদ্ধি পায়, তাই এর দাম সাধারণত ১৫০-২৫০ টাকা প্রতি কেজি। অন্যদিকে, পাঙ্গাস মাছের দামও সাধারণত ১৮০-৩০০ টাকা প্রতি কেজি থাকে, কারণ এটি বড় আকারে উৎপাদন করা সম্ভব এবং দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সহজলভ্য। 

তবে, স্যামন এবং বাস (Bass) মাছের মতো প্রজাতিগুলোর দাম অনেক বেশি, কারণ এদের চাষের পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হয় এবং এগুলো সাধারণত আমদানি করা হয়। স্যামনের দাম প্রতি কেজি ১২০০-১৮০০ টাকা পর্যন্ত হতে পারে, যেখানে বাস মাছের দাম প্রজাতি ও উৎস অনুযায়ী ৫০০-১০০০ টাকা প্রতি কেজি হতে পারে। এছাড়া, বিদেশি মাছের সরবরাহ কম থাকলে বা আমদানিতে ব্যাঘাত ঘটলে দাম আরও বেড়ে যায়।

বিদেশি মাছ কেনার ক্ষেত্রে কিছু সতর্কতা 

  • উৎপত্তি ও উৎস: মাছটি কোন দেশ থেকে আমদানি করা হয়েছে এবং উৎপাদন প্রক্রিয়া কীভাবে সম্পন্ন হয়েছে, তা যাচাই করুন। কিছু উৎসের মাছ অস্বাস্থ্যকর হতে পারে।
  • সংরক্ষণ ও পরিবহন: মাছটি কীভাবে সংরক্ষণ ও পরিবহন করা হয়েছে তা নিশ্চিত করুন, কারণ তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণের অভাবে মাছ নষ্ট হতে পারে বা ব্যাকটেরিয়া সংক্রমিত হতে পারে।
  • কেমিক্যাল ব্যবহার: বিদেশি মাছের সংরক্ষণে বা বৃদ্ধিতে কোনও ক্ষতিকর কেমিক্যাল ব্যবহৃত হয়েছে কিনা, তা পরীক্ষা করুন। কিছু চাষে ক্ষতিকর অ্যান্টিবায়োটিক বা রাসায়নিক ব্যবহার করা হতে পারে।
  • মাছের গুণমান ও সতেজতা: মাছের গন্ধ, চামড়া ও চোখের অবস্থার ওপর ভিত্তি করে এর গুণমান যাচাই করুন। সতেজ মাছের গন্ধ মিষ্টি এবং চোখ উজ্জ্বল থাকে।
  • খুচরা বিক্রেতার বিশ্বস্ততা: মাছ বিক্রেতা বা দোকানের বিশ্বস্ততা সম্পর্কে নিশ্চিত হন। বিশ্বস্ত দোকান থেকে মাছ কিনলে নকল বা নষ্ট মাছের ঝুঁকি কম থাকে।
  • মাছের আকার ও ওজন: মাছের আকার এবং ওজন সতর্কতার সাথে দেখুন, কারণ কিছু বিক্রেতা মাছকে বেশি ভারী দেখানোর জন্য এতে পানি বা অন্যান্য পদার্থ ইনজেক্ট করতে পারে।
  • প্যাকেজিং চেক: প্যাকেটজাত মাছ কিনলে প্যাকেজিং তারিখ, মেয়াদ শেষ হওয়ার তারিখ এবং সিলিং ঠিক আছে কিনা তা পরীক্ষা করুন। খারাপ প্যাকেজিং থাকা মাছ স্বাস্থ্যঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

উপসংহার

সঠিকভাবে মাছ চেনা এবং প্রাপ্যতা সম্পর্কে জানা কেবলমাত্র স্বাদে বৈচিত্র্য আনতে নয়, স্বাস্থ্য সচেতনতার জন্যও প্রয়োজনীয়। তেলাপিয়া, পাঙাশ, কার্প ও বিদেশি চিংড়ি মাছ যেমন চাষাবাদ এবং খাদ্যপুষ্টিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, তেমনি আমাদের অর্থনীতিতেও এটি বিশেষ অবদান রাখছে। স্থানীয় বাজারে বিদেশি মাছ এর সঠিক পরিচিতি এবং পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানার মাধ্যমে আমরা খাদ্য নির্বাচনে সচেতন হতে পারি। সুস্বাদু এবং স্বাস্থ্যকর খাদ্য নিশ্চিত করতে মাছ চেনার উপায় ও প্রাপ্যতা সম্পর্কে সচেতন হওয়া একান্ত প্রয়োজন।

Bornali Akter Borno

Bornali Akter Borno is a passionate food enthusiast and entrepreneur. From an early age, her love for culinary exploration led her to experiment with flavors and ingredients, ultimately inspiring her to work with Binni Food, an e-commerce brand dedicated to offering premium quality Organic Food and delectable treats to food enthusiasts in Bangladesh. Bornali's relentless pursuit of flavor and commitment to excellence have earned her recognition in the culinary world. Her journey is a testament to the power of passion and perseverance, showcasing how dedication to one's craft can lead to entrepreneurial success and culinary innovation.