কথায় বলে যতো ঝাঁজ ততো স্বাদ। অনেকের মতে, যেই তেলের ঝাঁজ নেই সেটা আবার কিসের সরিষার তেল!! সত্যি বলতে সরিষার তেল অন্য সকল তেল থেকে আলাদা শুধু মাত্র তার এই অনন্য ঝাজ ও ঘ্রানের জন্যই। আপনি কি জানেন সরিষা তেলের এই ঝাঁজের কারন টা কি?
অ্যালাইল আইসোথায়োসায়ানেট নামক একটি রাসায়নিক যৌগ্য এর উপস্থিতির কারনে সাধারনত সরিষার তেল থেকে এমন ঝাঁজ পাওয়া যায়। প্রাচীন কাল থেকে শুধু রন্ধনশীল্প না বরং বিভিন্ন রোগের চিকিৎসায় এমনকি সৌন্দর্য্য চর্চা তেও বহুল ব্যবহৃত হলো সরিষার তেল। তবে আসল সরিষার তেলের গুনাগুন পেতে চাইলে আপনাকে খাটি সরিষার তেল টি ব্যবহার করতে হবে। চলুন আজ আমরা জানবো কীভাবে আপনি খুব সহজেই খাটি সরিষার তেল চিনতে পারবেন।
সরিষার তেল কীভাবে তৈরি করা হয়
আপনার কেনা সরিষার তেল টি খাটি কিনা এটা যাচাই করার আগে আমাদের সকলেরই সরিষার তেল সম্পর্কে বিস্তারিত জানা উচিত। একটি খাবার সম্পর্কে আপনি যতো বিস্তারিত জানবেন ততোই আপনি সেই খাবার টির ভালো ও খারাপ দিক সম্পর্কে সহজে ধারনা পেয়ে যাবেন।
সাধারণ ভাষায় বলতে গেলে সরিষার গাছ থেকে বীজ সংগ্রহ করে চাপের মাধ্যমে যে নিষ্কাশিত যে তরল পদার্থ পাওয়া যায় তাই হল সরিষার তেল। সাধারনত দুইটি পদ্ধতি অনুসরন করে এখন সরিষা দানা থেকে তেল তৈরি করা হয়। এর মাঝে একটি বেশ প্রাচীন বা সনাতনী পদ্ধতি। অন্য আরেকটি হলো আধুনিক পদ্ধতি। চলুন এই দুই পদ্ধতি সম্পর্কে একটু জেনে নেওয়া যাক।
ঘানি ভাঙ্গা তেল
ঘানি ভাঙ্গা তেল তৈরির এই পদ্ধতির আরেকটি নাম হলো কোল্ড প্রেসড পদ্ধতি। এই পদ্ধতিতে সরিষা দানা গুলোকে কোণো প্রকার তাপ ছাড়াঈ শুধু খানি তে পিষ্ট করে তেল তৈরি করা হয়। যেহেতু এই পদ্ধতিতে তেলে কোনো বাহিরের তাপ প্রয়োগ করা হয় না তাই এই তেলের শতভাগ বিশুদ্ধতা বজায় থাকে। এই পদ্ধতিতে তৈরিকৃত তেল হলো গুনে মানে সবচেয়ে সেরা। ঘানি ভাঙ্গা তেলের মাঝে আবার সবচেয়ে সেরা হলো তেতুল কাঠের ঘানি ভাঙ্গানো তেল।
মেশীনে ভাঙ্গানো তেল
প্রাচীন কাল থেকেই ঘানি তে তেল ভাঙ্গানো হতো। এতে নির্ভেজাল ও খাটি তেল পাওয়া গেলেও এটি বেশ সময় সাপেক্ষ্য ব্যাপার। তাই আধুনিক সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে সরিষার তেল তৈরি এর জন্য মেশীন তৈরি করা হয়। মেশীনের মাধ্যমে কম সময়ে সরিষা বীজ থেকে অধিক পরিমানে তেল তৈরি করা সম্ভব হয়। মেশিনের মাধ্যমে মুলত তাপের সাহায্য সরিষা বীজ থেকে তেল নিষ্কাশন করা হয়। এই পদ্ধতিতে যখন সরিষার বীজকে অতিরিক্ত চাপ ও তাপ দেওয়ার তখন সরিষা তেল তরক আকারে বের হতে থাকে। যেহেতু এই পদ্ধতিতে তাপের প্রয়োগ করা হয়, তাই অতিরিক্ত তাপ প্রয়োগ করার ফলে অনেক সময় তেলের গুনাগুন নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
খাটি সরিষার তেল চেনার ৬ টি কার্যকরি উপায়
বাজারে এখন হাত বাড়ালেই সরিষার তেল। স্বাস্থ্যসচেতন মানূষ এখন ভোজ্য তেল হিসেবে সরিষার তেল কেই বেশি প্রাধান্য দিচ্ছে। তবে এটার সুযোগ নিয়েই কিছু অসাধু ব্যবসায়ি ভেজাল মিশ্রিত বা নকল তেল বিক্রি করছেন। এসব তেল ব্যবহারে আপনার মারাত্বক স্বাস্থ্যঝুকি হতে পারে। তাই চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে খুব সহজে আপনি খাটি সরিষার তেল চিনবেন।
ফ্রিজিং পদ্ধতি
সরিষার তেল আসল নাকি নকল এটি চেনার একটি আধুনিক পদ্ধতি হল ফ্রিজিং পদ্ধতি। যেই তেলটি পরীক্ষা করতে চাচ্ছেন সেই তেলটি একটি পাত্রে রেখে ২-৩ ঘন্টার জন্য ফ্রিজে রাখুন। এরপর চেক করে দেখুন তেলটি কি অবস্তায় আছে। যদি তেল টি জমে গিয়ে থাকে বা তেলের মাঝে সাদা আবরন দেখতে পান তাহলে সেটি নকল বা ভেজাল মিশ্রিত তেল। মনে রাখবেন খাটি তেল কখনোই জমে না।
হাতের সাহায্যে টেস্ট
আমরা চাইলে বাজারেই সরিষার তেল খাটি কিনা তা পরীক্ষা করে নিতে পারি। প্রথমে হাতের তালুতে একটুখানি সরিষের তেল নিয়ে তারপর তা খানিকক্ষণ ঘষে নিন। যদি তেলের রঙ ছেড়ে যেতে শুরু করে, কোনোও আলাদা গন্ধ পান বা চিটচিটে ভাব অনুভব করেন তবে বুঝে নেবেন সেই তেল ভেজাল মিশ্রিত ।
ঝাঁঝালো ঘ্রান
সরিষা তেলের অর্ধেক স্বাদ বোধহয় তার ঘ্রানেই। ভর্তা কিংবা যেকোনো আচার যেনো সরিষার তেলের এই ঘ্রান ছাড়া কল্পনায় করা যায় না।
অজানা ১৪ টি সরিষার তেলের উপকারিতা
আপনি খুব সহজেই এই সরিষার তেলের ঘ্রানের পরিক্ষা এর মাধ্যমে খাটি সরিষার তেল শনাক্ত করতে পারবেন। সরিষা তেলের তীর্ব্র ঘ্রান অনেক সময় চোখে পানি আনিয়ে দেওয়ার সক্ষমতা রাখে। খাটি সরিষার তেল থেকে আপনি একটা ঝাঁজালো ঘ্রান পাবেন।
তেলের রং
সরিষার তেলের কালার বা রং দেখেও আপনি তেল টি পরীক্ষা করতে পারবেন। খাটি সরিষার তেলের রং হয় বেশ গাঢ় এবং ঘন। অন্যদিকে হালকা হলুদেটে বর্নের সরিষার তেল গুলো ভেজাল মিশ্রিত হওয়ার সম্ভাবনা ই বেশি।
কটন বা সুতি কাপড় দিয়ে টেস্ট
কটন বা সুতি কাপড় দিয়ে সরিষার তেল খাটি নাকি ভেজালযুক্ত তা খুব সহজেই বোঝা যায়। এখন আমার মতোই আপনার মনেও প্রশ্ন জাগতেই পারে যে কাপড় দিয়ে কিভাবে টেস্ট করা যায়? চলুন একটু বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক-
একটি সুতি কাপড় নিয়ে তাতে সামান্য সরিষার তেল ঢেলে নিতে হবে। তারপর ভালো ভাবে ঘষে নিতে হবে, যদি দেখা যায় যে কালো দাগ হয়েছে তাহলে বুঝে নিতে হবে যে এই তেলে ভেজাল মিশ্রন রয়েছে। কারন খাটি সরিষার তেলেরর কারনে কখনোই সুতি কাপড়ে দাগ হয় না।
ব্যারোমিটার পরীক্ষা
ব্যারোমিটার হল এমন একটি মিটার যার সাহায্যে তেলের রিডিং টেস্ট করে জানা যায় যে তেল আসল নাকি নকল। তেল ব্যারোমিটার রিডিং ৫৮ থেকে ৬০.৫। কিন্তু সরিষার তেলের রিডিং নির্ধারিত মানের চেয়ে বেশি হলে তেল নকল। অতএব তেল কিনার সময় ব্যারোমিটার রিডিং দ্বারা তেলটি আসল নাকি নকল তা চিহ্নিত করুন।
খাটি সরিষার তেল খাওয়ার উপকারিতা
খাটি সরিষার তেলের রয়েছে বহুবিধ উপকারিতা। অনান্য যেকনো ভোজ্য তেলের তুলনায় বিশেষ করে সয়াবিন তেলের চেয়ে সরিষার তেলের উপকারিতা বেশী।
- সরিষার তেল রক্তে কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রন করে।
- হার্টের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
- ঠান্ডা কাশী কমাতে সাহায্য করে।
- ক্যান্সার জনিত টিউমারের গঠন প্রতিরোধে কাজ করে।
- ত্বক ও চুল সুন্দর রাখে।
- বাতের ব্যাথা কমাতে সাহায্য করে।
- পোকামাকড় ও মশার প্রাদুর্ভাব কমাতে সাহায্য করে।
- শরীরের কোষ সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করে।
- হজম ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
- সরিষার তেল শরীরের প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে
উপসংহার
সরিষার তেলের নিজস্ব স্বাদ থাকার কারণে যেকোনো রান্নায় এই তেল ব্যবহার করলে এটি সেই খাবারের স্বাদটাকে বহু গুনে বাড়িয়ে দেয়। তার কারণ হলো খাটি সরিষার তেলের নিজেস্ব স্বাদ ও সুগন্ধ রয়েছে। সরিষার তেলের চাহিদা বৃদ্ধি পাবার কারনে বর্তমানে অনেকেই এই তেলে প্রচুর ভেজাল মিশিয়ে থাকেন। এমনকি অনেকেই তেলের সাথে কম দামী সরিষা বীজের মিশ্রন ও করে থাকে।
অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে তৈরি এসব ভেজালযুক্ত তেল আমাদের স্বাস্থ্য এর জন্য ক্ষতিকর। তবে আপনার সুস্বাস্থ্যের জন্য হলেও খাটি খাবার খাওয়া আপনারি দায়িত্ব। তাই অবশ্যই ভালো মন্দ যাছাই বাছাই করে আমাদের যেকোনো খাবার কিনতে হবে। আশা করছি আজকের এই ব্লগ থেকে আপনারা খাটি সরিষার তেল চেনার উপায় গুলো সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।