আপনি কি জানেন পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধ খাবার কি? বিবিসির দেওয়া তথ্য মতে পৃথিবীর সবচেয়ে বিশুদ্ধতম খাবার হলো “ঘি”। ঘি হলো পরিশোধিত মাখন। দুধ থেকে তৈরি করা এই খাবার টি ঘ্রানে এবং স্বাদে অতুলনীয়। একটা সময় এই ঘি এর চাহিদা ছিলো শুধু ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে। সেই সময় উচু শ্রেনির মানুষ কিংবা রাজা বাদশা দের পছন্দের খাবার ছিলো এটি। তৎকালীন সময়ে ঘি ছিলো একটি দামী খাবার।
তবে সময়ের বিবর্তনে এখন ঘি শুধু ভারতে না বরং বাংলাদেশ সহ বিশ্বের অনেক স্থানেই এটি বেশ জনপ্রিয়। অধিক জনপ্রিয়তার ফলে ক্রমাগত ঘি এর চাহিদা বাড়ছে। তাই দেশের বিভিন্ন স্থানেই এখন বানিজ্যিক ভাবে ঘি তৈরি করা হচ্ছে। ঠিক তেমনি একটি জনপ্রিয় ঘি হলো সিরাজগঞ্জের ঘি। চলুন তাহলে আজকের এই লেখার মাধ্যমে সিরাজগঞ্জের গাওয়া ঘি নিয়ে সকল জানা, অজানা তথ্য গুলো জেনে নেওয়া যাক।
ঘি এর শহর সিরাজগঞ্জ
সিরাজগঞ্জ জেলা মুলত দুগ্ধজাত পন্য এবং তাত শীল্পের জন্য পুরো দেশে খ্যাতি লাভ করেছে। সিরাজগঞ্জের দুগ্ধজার পন্যর মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো ঘি। এই জন্যই সিরাজগঞ্জের অন্য নাম ঘি এর শহর। সিরাজগঞ্জে রয়েছে ছোট বড় অসংখ্য গরুর খামার। জানা যায়, প্রায় দেড়শ বছর আগে থেকেই সিরাজগঞ্জ জেলা গাভী পালন এবং দুধ উৎপাদনের জন্য বিখ্যাত। সিরাজগঞ্জে উৎপাদিত দুধ প্রায় সারা বাংলাদেশেই সরবরাহ করা হয়। এমনকি বড় বড় যেই কোম্পানি রয়েছে, যারা দুগ্ধজাত পন্য নিয়ে কাজ করে তারাও কিন্তু সিরাজগঞ্জ জেলা থেকে দুধ সংগ্রহ করে থাকে।
দৈনিক প্রথম আলো থেকে পাওয়া তথ্য মতে, সিরাজগঞ্জ উপজেলার প্রানীসম্পদ কার্যালয়ের হিসেবে, এই জেলা তে ছোট বড় প্রায় ৩৩ হাজার গরুর খামার রয়েছে। আর এসব খামারে প্রায় ১৫ লাখের বেশি গরু পালন করা হয় যার অধিকাংশ ই গাভী। বিশেষ করে সিরাজগঞ্জ উপজেলার শাহজাতপুর এবং রায়গঞ্জ উপজেলাতে খামারি এবং দুগ্ধজাত পন্য তৈরির হার সবচেয়ে বেশী। একটা সময় এই সিরাজগঞ্জ জেলা বেশ অনুন্নত ছিলো। তবে সময়ের সাথে সাথে যখন সারা দেশে দুগ্ধজাত পন্য এর চাহিদা বেরেছে তখন থেকেই সরকারি – বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাহায্য এই জেলার মানুষ সাবলম্বি হতে শুরু করেছে। এখন শুধু বাংলাদেশেই না বরং সিরাজগঞ্জের ঘি বিদেশের মাটিতেও নিজের সুনাম ছড়িয়ে যাচ্ছে।
সিরাজগঞ্জের গাওয়া ঘি বিখ্যাত কেন?
গাওয়া ঘি হলো সবচেয়ে মজাদার স্বাদের ঘি। সাধারনত বাজারে দুইটি ঘি এর আধিক্য বেশী।
- গাওয়া ঘি।
- ক্রিমের ঘি।
তবে স্বাদ ও ঘ্রানের পার্থক্য জনিত কারনে গাওয়া ঘি রয়েছে সকলের পছন্দের শীর্ষে। গাওয়া ঘি তৈরির প্রসেস টাও কিন্তু বেশ কঠিন এবং সময় সাপেক্ষ্য। তবে আপনি কি জানেন খাটি ঘি তৈরির জন্য কোন উপাদান টি সবচেয়ে বেশী জরুরী? খাটি ঘি তৈরির জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় উপাদান টি হলো খাটি দুধ। দুধ যদি ভালো না হয় সেক্ষেত্রে ঘি ও ভালো হবে না। আর সিরাজগঞ্জ খাটি তরল দুধের জন্যই বিখ্যাত। এই জেলাতে অধিক গাভী পালন করা হয় বিধায় এই জেলা তে রয়েছে প্রচুর পরিমানে খাটি দুধ। এছাড়া সরকারি বেসরকারী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের উদ্দেগ্যে বর্তমানে এই জেলাতে অনেক দক্ষ ঘি এর কারিগর তৈরি করা হয়েছে। মুলত সিরাজগঞ্জে দুধের সহজলভ্য তার কারনের এই জেলার ঘি এতোটা সুখ্যাতি লাভ করেছে।
কীভাবে তৈরি হয় সিরাজগঞ্জের গাওয়া ঘি
গাওয়া ঘি তৈরি করতে বেশ সময় এবং পরিশ্রমের প্রয়োজন হয়। সিরাজগঞ্জে আমার এক আত্নিয় থাকার সুবাদে নিজ চোখে এই ঘি তৈরির পুরো প্রক্রিয়া টা দেখেছি। ঘি তৈরীতে যে একজন কারীগর কতটা শ্রম এবং সময় বিনিয়োগ করে সেটা নিজ চোখে না দেখলে সহজে বোঝা যায় না। চলুন গাওয়া তৈরি পদ্ধতি জেনে নেওয়া যাক-
দুধ সংগ্রহ
খাটি ঘি তৈরির জন্য প্রথমে ভেজাল্মুক্ত খাটি গরুর দুধ সংগ্রহ করা হয়। সাধারনত দেশি গরুর তৈরি ঘি এর স্বাদ বেশি হয়ে থাকে।
সর সংগ্রহ
দুধ সংগ্রহ এর পরে এগুলোকে একটি বড় পাত্রে রাখা হয়। এরপর এই দুধ গুলোকে জ্বাল করা হয়। একসময় ফুটন্ত দুধ থেকে হালকা বাদামি বর্ণের সর জমা হতে শুরু করে। এরপর সেই সর গুলোকে আলাদা করে নেওয়া হয় এবং বাকি দুধ গুলোকে পুনরায় জ্বাল করা হয়। মুলত এইভাবেই তরল দুধ থেকে জ্বালের মাধ্যমে অল্প অল্প করে সর সংগ্রহ করা হয়। এটি বেশ সময় সাপেক্ষ্য বিষয়।
সর থেকে মাখন সংগ্রহ
সর সংগ্রহ এর পরে সর গুলোকে হাতের সাহায্যে ভালো ভাবে চটকে নেওয়া হয়, অনেক সময় এগুলো পাটা তেও পিষে নেওয়া হয়। এরপর বাটা সর গুলোকে একটি পরিষ্কার পাত্রে রেখে এতে অল্প অল্প করে ঠান্ডা পানি মেশানো হয়। এতে করে সর থেকে মাখনের অংশ টুকু অপরের দিকে ভেসে উঠে এবং বাকি অংশ ঘোল হিসেবে পাত্রের নিচের দিকে জমা হতে থাকে। এভাবেই সর থেকে মাখন সংগ্রহ করা হয়।
মাখন থেকে ঘি তৈরি
মাখন সংগ্রহ এর পরে এগুলকে পাতলা সুতি কাপড়ে বেধে রাখা হয় মাখনের এক্সট্রা পানি টা ঝরানোর জন্য। পানি ঝরানো শেষে আবারো মাখন গুলোকে কড়া আঁচে জ্বাল করা হয়। একটা সময় মাখন গুলো তেলের মতো তরল পদার্থে পরিনত হয়। এই অবস্থায় চুলার আঁচ কিছুটা কম রেখে আবারো ঘি গুলোকে জ্বাল করা হয়। কড়া জ্বালে ঘি জ্বাল দেওয়ার বিশেষ সুবিধা হলো এতে ঘি এর ঘ্রান টা বেশী পাওয়া যায় এবং ঘি এর মাঝে অনেক দানা তৈরি হয়। ঘি জ্বাল করার সময় ও ধরন টা নির্ভর করে কারিগর কোন ঘি তৈরি করতে চাচ্ছে সেটির উপরে। সাধারনত গাওয়া ঘি দুই ধরনের হয়।
- মিষ্টি জ্বালের ঘি।
- কড়া জ্বালের ঘি।
মিষ্টি জ্বালের ঘি অপেক্ষা কড়া জ্বালের ঘি অধিক সময় নিয়ে জ্বাল করা হয়। এরপর ঘি তৈরি হয়ে এলে চুলা থেকে নামিয়ে এটির উপরে ঢাকনা রেখে বেশ লম্বা সময়ের জন্য রেস্টে রাখা হয়। পরবর্তিতে ঘি গুলোকে বিভিন্ন পাত্র / বয়ামে মোড়কজাত করা হয়।
সিরাজগঞ্জের গাওয়া ঘি এর দাম
সিরাজগঞ্জে প্রচুর ঘি তৈরি করা হয়। এই জেলার তৈরি ঘি সারা বাংলাদেশ সহ বিদেশের মাটিতেও ঘি এর চাহিদা মিটিয়ে থাকে। যেহেতু সিরাজগঞ্জে সুলভ মুল্যে দুধ পাওয়া যায় এবং প্রচুর ঘি উৎপাদন করা হয় তাই এখানে মোটামুটি কম দামেই ভালো মানের ঘি পাবেন। অবশ্য কোয়ালিটি ভেদে ঘি এর দাম ও আলাদা আলাদা। তবে সিরাজগঞ্জে ভালো মানের গাওয়া ঘি আনুমানিক ১২০০ টাকা থেকে ১৫০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করা হয়ে থাকে। আর হ্যা ঘি এর দাম কিন্তু পরিবর্তনশীল। উৎপাদন খরচ বেড়ে গেলে সেক্ষেত্রে ঘি এর দামেও ও পরিবর্তন হয়ে থাকে।
প্রতিদিন কি পরিমান ঘি খাওয়া উচিত ও কখন খাওয়া ভালো?
ঘি এর উপকারিতা
বাংলাদেশের বিখ্যাত ঘি এর সম্পর্কে তো অনেক কিছুই জানলাম। চলুন এবার ঘি খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে জানা যাক-
- ঘি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমরা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত ঘি খেলে হজমের সমস্যা কমে যায়।
- ঘি শরিরের জয়েন্টের ব্যাথা দূর করতে সাহায্য করে।
- ঘি আমাদের ত্বক ও চুল সুন্দর রাখতে সাহায্য করে।
- নিয়মিত ঘি খেলে এটি আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
- চোখের জ্যোতি বাড়াতে সাহায্য করে।
- ঘি আমাদের হার্টের সমস্যা কমাতে অনেক উপকারি।
- ঘি তে থাকা স্বাস্থ্যকর ফ্যাট আমাদের লিভার কে সুস্থ্য রাখে।
- পরিমিত পরিমানে ঘি খেলে এটি আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে।
উপরিউক্ত আলোচনায় খাঁটি দুধ দিয়ে তৈরি সিরাজগঞ্জের গাওয়া ঘি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এখানে গাওয়া ঘি তৈরি করার পদ্ধতি, এই ঘি খাওয়ার উপকারিতা ইত্যাদি সম্পর্কে ধারনা দেওয়া হয়েছে। আশাকরি লেখাটি পড়ে আপনি ঘি এর দাম সহ অন্যান্য বিষয়ে জানতে পেরেছেন।