ভালো ঘুমের জন্য সঠিক সময় ও মানসিক প্রশান্তির প্রয়োজন হয়। সারাদিন পরিশ্রম করে রাতের সময়টুকু আমরা বিশ্রাম নিয়ে থাকি। তবে ঘুমের সমস্যার কারণে সারারাত এপাশ- ওপাশ করে কাটিয়ে দিয়েও দুই চোখের পাতা এক করতে না পারার বৃথা চেষ্টা আমাদের অনেকের রয়েছে । অতিরিক্ত কাজের চাপ কিংবা বিভিন্ন মানসিক চাপের ফলে ঘুমের একটা বেঘাত দেখা যায়। আপনি কি জানেন প্রতিদিনের খাদ্যাভ্যাসের প্রভাবও আমাদের ঘুমে প্রভাব ফেলে?
ঘুম ভালো হবে কিনা তা আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রা ও খাবারের ওপর নির্ভর করে। কিছু খাবার রয়েছে যা খেলে আমাদের ঘুমে প্রভাব ফেলে। খাবার ও ঘুম আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। সুস্থ থাকতে হলে যেমন সঠিক খাদ্যাভ্যাস প্রয়োজন তেমনি ভালো ঘুমের জন্য প্রয়োজন। তাই ভালো ঘুমের জন্য আমাদেরকে সঠিক খাদ্যাভাস গড়ে তুলতে হবে। আজকের আর্টিকেলে ভালো ঘুমের জন্য যেসকল খাবার খাওয়া উচিত সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
ভালো ঘুমের জন্য যা খাবেন
নিত্যপ্রয়োজনীয় কাজকর্ম ঠিকভাবে করার জন্য পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুমানো প্রয়োজন। যা আমাদের শরীর ও মনকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে। এবং পরবর্তী কাজের জন্য যথেষ্ট শক্তি পাওয়া যাবে। ভালো ঘুমের জন্য কোন খাবারগুলো আপনার খাদ্যতালিকায় রাখা উচিত তা জেনে নেওয়া যাক-
বাদাম
বাদামের উপকারিতা বহুগুণ। এত প্রচুর পরিমাণে স্বাস্থ্যকর ফ্যাট রয়েছে। এছাড়াও ভিটামিন ই, ম্যাগনেসিয়াম ও প্রোটিনের মতো প্রয়োজনীয় পুষ্টি আমাদের দেহে সরবরাহ করে থাকে। বাজারে বিভিন্ন ধরনের বাদাম পাওয়া যায় যেমন কাঠ বাদাম, কাজুবাদাম, পেস্তা বাদাম, চিনাবাদাম, আখরোট ইত্যাদি। এটি আমাদের মস্তিষ্কের বিকাশ ও কার্যক্ষমতাতে বাড়িয়ে তুলতে সাহায্য করে। ঘুম ভালোর করতে প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় এক মুঠো বাদাম রাখতে পারেন। এতে থাকা মেলাটোনিন ও ম্যাগনিয়ায় আমাদের ঘুমের সমস্যা দূর করে ঘুম ভালো হতে সাহায্য করে।
ডার্ক চকলেট
ডার্ক চকলেট সাধারণত মিষ্টিবিহীন বা তিক্ত চকোলোট নামেও পরিচিত। এর স্বাদ তেতো হলেও আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য বেশ উপকারী। তাই স্বাস্থ্যকর খাদ্য হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। এতে থাকা কোকোয়া বীজের ফ্ল্যাভানল মস্তিষ্কের রক্তপ্রবাহ বাড়াতে সাহায্য করে। আমাদের মস্তিষ্কের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও স্মৃতিশক্তি বড়িয়ে দেয়। শুধু তাই নয়, এতে বিদ্যমান ম্যাগনেসিয়াম ও অ্যান্টি অক্সিডেন্ট আমাদের বিষন্নতাকে দূর মানসিক প্রশান্তি দিয়ে থাকে।
গরম দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার
দুধের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে আমাদের সকলের জানা রয়েছে। পুষ্টিবিদদের মতে শরীরকে সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। কারণ উচ্চমানের প্রোটিন থাকায় আমাদের শরীরের জন্য উপকারী। তাই সুষম খাদ্য হিসেবে দুগ্ধজাত খাবার তালিকায় রাখা যেতে পারে। রাতে ঘুমানের আগে এক গ্লাস গরম দুধ খেতে পারেন। এতে রয়েছে ওমেগা-৩ যা আমাদের ঘুম ভালো হতে সাহায্য করবে।
মধু
প্রাকৃতিক এন্টিবায়োটিকসমৃদ্ধ মধুর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতার দিক থেকে মধু প্রথম সারিতে। অনিদ্রার সমস্যা দূর করতে মধু বেশ কার্যকরী। এতে গ্লুকোজ রয়েছে, যা আমাদের মস্তিষ্কে ওরেক্সিন নামক একটি উত্তেজনাকারী রাসায়নিকের কার্যকারিতা কমিয়ে দেয়। তাই রাতে ঘুমানোর আগে এক গ্লাস পানির সাথে দুই চা চামচ মধু মিশিয়ে খেলে আমাদের ঘুম ভালো হবে। এছাড়াও আমাদের শরীরের টক্সিক উপাদান গুলো বের হয়ে যাবে।
সামুদ্রিক মাছ
বিভিন্ন ধরনের সামুদ্রিক মাছ যেমন স্যামন, টুনা ইত্যাদিতে ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড ও ভিটামিন ডি রয়েছে। যা আমাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। বিশেষ করে হার্টের রোগীর জন্য উপযুক্ত একটি খাবার। এছাড়াও এটি সেরোটোনিন উৎপাদনকে বাড়িয়ে দেয়। তাই রাতের খাবারের সামুদ্রিক মাছ রাখতে পারেন। যা আপনার ঘুম ভালো হতে সহায়তা করবে।
ডিম
ডিমে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন রয়েছে। ঘুমের জন্য প্রতিদিন ডিম খেতে পারেন । যা আমাদের শরীরের ভিটামিনের ডি এর ঘাটতি দূর করে । মস্তিষ্কের জিএবিএজিক নিউরন ঘুমাতে সাহায্য করে।
কলা
আমাদের দেশে কলা খুবই সহজলভ্য একটি ফল। সারাবছরই বাজারে কিনতে পাওয়া যায়। কলায় প্রচুর পরিমাণে খনিজ উপাদান যেমন ম্যাগনেশিয়াম, পটাশিয়াম ইত্যাদি রয়েছে। খাবারের তালিকায় কলা রাখা যেতে পারে যা আমাদের ঘুম ভালো হতে সাহায্য করে।
চেরি বা চেরি জুস
প্রাকৃতিক মেলাটোনিনের একটি ভালো উৎস হলো চেরি। এটি আমাদের ঘুমানোর প্রক্রিয় ত্বরান্বিত করে। যাদের ঘুমের সমস্যা রয়েছে। তারা চেরি বা চেরি জুস খেতে পারেন।
ওটমিল
ওটস বা ওটমিল একটি স্বাস্থ্যকর খাবার যা আপনার খাবারের তালিকায় রাখতে পারেন।এতে প্রয়োজনীয় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে। আমাদের শরীর রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। এছাড়াও কোষ্ঠকাঠিন্য বা হজম সমস্যা দূর করতে বেশ উপকারী। এমনকি প্রাকৃতিক মেলাটোনিন উৎপন্ন করে। শরীরে শক্তি সরবরাহ করে।
হোল গ্রেইন খাবার
হোল গ্রেইন খাবার বলতে শস্যদানা খাবাকে বোঝানো হয়। যেমন ব্রাউন রাইস, কোয়িনোয়া ও হোল গ্রেইন ব্রেড। এই ধরনের খাবার পুষ্টিগুণে ভরপুর ও খুবই উপকারী। এতে থাকা ম্যাগনেসিয়াম রয়েছে। এটি স্নায়ু শিথিল করে আমাদের ঘুম ভালো হতে সাহায্য করে।
হার্বাল টি
অন্য সাধারণ চা-কফি খাওয়ার ফলে ঘুম আসেনা। তবে হার্বাল টি যেমন পেপারমিন্ট বা ল্যাভেন্ডার টি আমাদের ঘুম আনতে সাহায্য করে। চা ছাড়া যারা থাকতে পারেন না। তাদের জন্য হার্বাল টি দারুণ হবে।
যা খাওয়া যাবেনা
নিজেরে সুস্থ রাখতে ঘুম পর্যাপ্ত পরিমাণে ঘুম অপরিহার্য। তবে মানসিক চাপ কিংবা বিভিন্ন সমস্যার কারণে অনেক সময় ঘুম ভালো হয়না। দীর্ঘদিন ঘুমের সমস্যা হলে আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা কমে যায়। ঘুম ভালো না হওয়ার কারণগুলো মধ্যে অন্যতম হলো খাবার। অনেকেই ঘুমের আগে এমন কিছু খাবার খেয়ে থাকেন যা আপনার মস্তিষ্ককে জাগ্রত রাখতে সাহায্য করে। তাই ঘুমানোর আগে যেসকল খাবার পরিহার করতে হবে তা সংক্ষেপে জেনে নেওয়া যাক-
ক্যাফেইন: ঘুমের আগে কখনোই চা কফি কিংবা সফট ড্রিঙ্কস খাওয়া যাবেনা। কারণ চা-কফিতে ক্যাফেইন থাকে। যা আমাদের ব্রেইনকে জাগ্রত রাখে। ফলে রাতে ঘুম আসতে চায়না।
মশলাদার খাবার: অনেক সময় মশলাদার খাবারের কারণে হজমে সমস্যা দেয়া যায়। বুক জ্বালাপোড়া করে। ফলে আমাদের ঘুম ভালো হয়না। তাই মশলাদারযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলার চেষ্টা করুন।
ভারী খাবার, চর্বিযুক্ত খাবার: রাতের খাবারের ভারী চর্বিযুক্ত খাবারগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। কারণ এই ধরনের খাবারগুলো আমাদের ঘুমকে হালকা করে দেয়। অর্থাৎ একবার ঘুম ভেঙে গেলে সহজে আর ঘুম আসেনা।
মিষ্টিজাতীয় খাবার: অতিরিক্ত মিষ্টিজাতীয় খাবার খেতে ঘুমের ব্যাঘাত সৃষ্টি হতে পারে। তাই পরিমাণমতো মিষ্টিজাতীয় খাবার খেতে হবে।
উপকারী কিছু টিপস
- ঘুমানোর ২ ঘণ্টা আগে রাতের খাবার খেতে হবে।
- রাতের খাবারে যতটা সম্ভব হালকা ও সহজপাচ্য খাবার রাখার চেষ্টা করুন।
- আরামদায়ক বিছানা নির্বাচন করতে পারেন। যা আপনার ঘুম ভালো হতে সাহায্য করবে।
- যতটা সম্ভব নিরিবিলি পরিবেশে ঘুমের ব্যবস্থা রাখতে হবে।
- নিয়মিত ব্যয়াম করার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। যা আমাদের সুস্থ রাখতে ও মানসিক অবদাস দূর করতে সাহায্য করবে। ফলে রাতে ঘুম ভালো হবে।
উপসংহার
উপরিক্ত আলোচনায় ঘুম ভালো রাখতে যেসকল খাবার খাওয়া উচিত তা বিস্তারিত দেওয়া হয়েছে। যাদের ঘুমের সমস্যা বা অনিদ্রায় ভুগছেন তারা অবশ্যই খাবারের দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। কারণ ভালো ঘুমের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবার নির্বাচন খুব গুরুত্বপূর্ণ। কিছু খাবার এমন রয়েছে যা মস্তিষ্কে সেরোটোনিন এবং মেলাটোনিন উৎপাদনে সাহায্য করে। তাই চেষ্টা করুন এ ধরনের খাবার নিয়মিত গ্রহণ করার। নিজেকে সুস্থ রাখতে ঘুম ভালো হওয়া জরুরী। এতে আমাদের মানসিকভাবে সুস্থ থাকতে পারবো। তাই প্রতিদিন ভালো ঘুমের জন্য স্বাস্থ্যকর খাবারের পাশাপাশি একটি স্বাস্থ্যকর জীবনযাপনের অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে।