খাদ্যে ভেজালের ছাড়ছড়ি বেড়েই চলছে। চাষ থেকে শুরু করে বিক্রি পর্যন্ত বিভিন্ন রাসায়নিক ও কীটনাশক ব্যবহার করা হয়। খাবারে মিশ্রিত ভেজালের মধ্যে ফরমালিনের ব্যবহার অন্যতম। কিছু অসাধু ব্যবসায়ী বেশি লাভের আশায় পচনশীল দ্রব্যে ফরমালিন ব্যবহার করে থাকেন। এতে পচশীল দ্রব্য বেশিদিন পর্যন্ত তাজা থাকে। ফরমালিনযুক্ত খাবার দেখতে অনেক সুন্দর চকচকে হয় যা ক্রেতাকে আকৃষ্ট করে।
আমরা প্রতিনিয়ত ফরমালিনযুক্ত খাদ্য গ্রহণ করছি। যা আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর ও হুমকীস্বরুপ। তাই সচেতনতার জন্য আমাদের ফরমালিন মুক্ত খাবার চেনার উপায় সম্পর্কে সুস্পষ্ট ধারণা থাকা প্রয়োজন। আজকের আর্টিকেলে ফরমালিন মুক্ত খাবার চেনার সহজ কিছু উপায় সম্পর্কে আলোচনা করবো।
ফরমালিন মুক্ত খাবার চেনার উপায়
সুস্থ থাকার জন্যে পুষ্টিকর খাবার খাওয়া অপরিহার্য। পুষ্টিকর খাবারের মধ্যে ফলমূল, শাকসবজি, মাছ মাংস ইত্যাদি সুষম খাদ্য বুঝি। তবে বর্তমানে খাবারে ফরমালিন ব্যবহার করার কারণে খাবারের নিজস্ব কোনো স্বাদ ও সঠিক পুষ্টিগুণ পাচ্ছি না। তাই ফরমালিনযুক্ত খাবার খাওয়া থেকে প্রতিরোধ করতে আমাদের সর্তক হতে হবে।
বাজার থেকে খাবার দ্রব্যকেনার সময় দেখতে হবে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়েছে কিনা। এখন হয়তো মনে প্রশ্ন আসতে পারে। আমরা কিভাবে বুঝবো কোন খাবারে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়েছে আর কোন খাবারে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়নি? একটি সহজ সমাধান হলো ফরমালিন মুক্ত খাবার চেনার উপায় সম্পর্কে জানতে হবে। এতে আমরা কোনো দ্রব্য কেনার সময় নিময়গুলো মেনে চললেই ফরমালিন যুক্ত খাবার খাওয়া থেকে বেঁচে যেতে পারবো।
ফরমালিন মুক্ত আম চেনার উপায়
মৌসুমি ফল আম খেতে আমরা সকলেই পছন্দ করি। আমের সিজনে সুঘ্রাণ চারিদিকে ছড়িয়ে পরে। তাই তো আমের সিজনের অপেক্ষার প্রহর গুণতে থাকি। আমরা কম বেশি আম বাজার থেকে কিনে খাই। তবে অধিকাংশ মানুষই নিজের অজান্তে ফরমালিন যুক্ত আম ক্রয় করে থাকেন। যা খেতে একদমই গাছ পাকা আমের মতো সুস্বাদু হয়না, গন্ধহীন ও পুষ্টিহীন। সেই সাথে টাকাটাও গাচ্চা যায়। তাই ভালো আম চেনার উপায় জানতে হবে। এতে প্রকৃত গাছ পাকা সুস্বাদু আম খেতে পারবো। চলুন ভালোর আমের কিছু বৈশিষ্ট্য জেনে নেওয়া যাক-
সুমিষ্ট ঘ্রাণ
ফরমালিনমুক্ত আম চেনার একটি সহজ উপায় হলো গন্ধ শুকে দেখা। সাধারণত গাছ পাকা আমের সুমিষ্ট ঘ্রাণ থাকবে। তাই আম কেনার আগে নাকের কাছে এনে আমের গন্ধ ভালো করে শুকুন। ক্যামিকেল ব্যবহৃত আমের গন্ধ খুব বেশি থাকেনা। ঝাঁঝালো গন্ধ পাওয়া যায়।
মাছি বসছে কিনা
আম ক্রয় করার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে আমের গায়ে মাছি বসছে কিনা। যদি মাছি না বসে তাহলে বুঝতে হবে সেই আমগুলোতে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়েছে। কারণ ফরমালিনযুক্ত আমে কখনো মাছি বসবে না। অন্যদিকে গাছ পাকা আমে মাছি বসবে।
স্বাদহীন আম
সাধারণত গাছ পাকা আম টক মিষ্টি হয়ে থাকে। অন্যদিকে ফরমালিন যুক্ত আমের কোনো স্বাদ থাকেনা। আম খাওয়ার সময় যদি মিষ্টি টক কোনো স্বাদ না পাওয়া যায় তাহলে বুঝতে হবে আমে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়েছে।
মসৃণ ও সুন্দর
অনেকেই মনে করেন মসৃন ও সুন্দর দেখতে আমগুলো অনেক তাজা হবে। কিন্তু তা সঠিক নয়। ফরমালিন দিয়ে পাকানো আম দেখতে সুন্দর দাগহীন ও মসৃণ হয়। গাছ পাকা আমে অবশ্যই দাগ থাকবে।
খোসার রঙ
আমের অনেক জাত রয়েছে যেগুলো পাকার পরেও খোসার রঙ সবুজ থাকে। এছাড়াও গাছ পাকা আমের গোড়ার দিকে একটু গাঢ় রঙ থাকে। এবং ফরমালিন দিকে পাকানো আম পুরোটাই হলদে রঙের হয়ে থাকে।
ফরমালিন মুক্ত মাছ চেনার উপায়
পচন রোধ করার জন্য মাছে সবথেকে বেশি ফরমালিন ব্যবহার করা হয়। বাজার থেকে মাছ কেনার পরে মাছের নিজস্ব ঘ্রাণ ও স্বাদ কোনোটাই যেনো আর থাকেনা। তাই মাছ ক্রয় করার সময় মাছে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়েছে কিনা লক্ষ্য রাখতে হবে। চলুন জেনে নেওয়া যাক মাছে ফরমালিন আছে কিনা তা কিভাবে বুঝবেন-
মাছি বসবে
যেসকল মাছে ফরমালিন ব্যবহার করা হয় সেকল মাছের মধ্যে মাছি বসবেনা। তাই মাছ কেনার সময় লক্ষ্য রাখতে হবে মাছে মাছি বসছে কিনা। ফরমালিন মুক্ত মাছে অবশ্যই মাছি বসবে।
মাছের চোখের রঙ
ফরমালিন যুক্ত মাছের রঙ নষ্টের হয়ে ঘোলাটে দেখা যায়। তাই মাছ কেনার সময় মাছের চোখ দেখতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই চোখের রঙ উজ্জ্বল ও সজীবতার লক্ষণ হলে বুঝতে হবে ফরমালিন নেই।
ঘরোয়া পদ্ধতিতে খাবারের ফরমালিন দূর করার নিয়ম ও সর্তকতা
মাছের আঁশ
মাছের আশঁ যদি উজ্জ্বল না হয় ঘোলাটে দেখায় তাহলে সেই মাছে ফরমালিন ব্যবহার করা হয়েছে। তাই মাছ কেনার সময় আঁশের দিকে খেয়াল রাখতে হবে।
মাছের দেহ
মরা মাছ নরম হয়ে গলে যায়। আমরা অনেকেই মনে করি মাছের দেহ শক্ত মানেই তাজা মাছ। কিন্তু ফরমালিন ব্যবহৃত মাছও শক্ত হয়ে থাকে।
ফরমালিন মুক্ত কলা চেনার উপায়
সহজলভ্য পুষ্টিকর ফলগুলো মধ্যে কলা অন্যতম। কলাতে অনেকপুষ্টি উপাদান রয়েছে যা আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। তবে বাজারে কলা কেনার সময় অবশ্যই সাবধান হতে হবে। অন্যথায় রাসায়নিকযুক্ত কলা দীর্ঘদিন ধরে খেলে কিনডিতে প্রভাব পরতে পারে। চলুন ফরমালিন মুক্ত কলা চেনার উপায় জেনে নেওয়া যাক-
- রাসায়নিক ব্যবহার করে পাকানো কলার খোসায় কালো ছোপ পরতে থাকে।
- ফরমালিনযুক্ত কলার খোসা হলুদ রঙের মাঝে সবুজ ছোপ থাকে।
- কৃত্রিমভাবে পাকানো কলা বাইরে থেকে হলদে হয়ে গেলেও ভেতরে শক্ত থাকে।
- গাছ পাকা কলা খেতে মিষ্টি হয় তবে ফরমালিন ব্যবহার করা কলার মিষ্টিস্বাদ কিছুটা কম থাকে।
- বাজার থেকে কেনা কলা বালতি ভর্তি পানির মধ্যে ফেলতে হবে। যদি ডুবে থাকে তাহলে বুঝতে হবে গাছ পাকা কলা অর্থাৎ কোনো ধরনের ক্ষতিকর ক্যামিকেল ব্যবহার করা হয়নি। অন্য দিকে যদি ভেসে থাকে, তাহলে সেটি কৃত্রিমভাবে পাকানো হয়েছে।
ফরমালিন মুক্ত মাংস চেনার উপায়
বাজার থেকে কখনই কেটে রাখা মাংস কেনা যাবেনা। অনেক আগে কেটে রাখা বাসি মাংসতেও রাসায়নিক ব্যবহার করা হয়। মূলত চোখের সামনে কাটা হচ্ছে এমন মাংস কিনতে হবে। মুরগির মাংস কেনার চেয়ে মুরগি কিনে সেটা জবাই করে কেটে নেওয়াটাই ভালো। যদি সেরকম সুযোগ না থাকে তাহলে মুরগির মাংস কেনার আছে লক্ষ রাখতে হবে কেটে রাখা মাংসের নিচে তরলের আধিক্য আছে কিনা, যদি থাকে তাহলে সেই মাংস না কেনাই ভালো।
ফরমালিন মুক্ত মুড়ি চেনার উপায়
রমজান মাসে মুড়ির চাহিদা অনেক বেড়ে যায়। আমরা মুড়ি কিনে খাই, তবে দুঃখের বিষয় হলো, বর্তমানে মুড়িতে ইউরিয়ার সাথে হাইড্রোজ মেশানো হচ্ছে। আর এই মুড়ি খেয়ে আমাদের শরীরের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যাচ্ছে। ভেজাল মুড়ি খাওয়া থেকে রক্ষা পেতে একটু সর্তক হতে হবে আমাদের। বাজার থেকে মুড়ি ক্রয় করার মুড়ির রং যদি ধবধবে সাদা ও অসংখ্য ছিদ্র থাকে তাহলে এই মুড়ি কেনা যাবে না। এতে ইউরিয়ার সাথে হাইড্রোজ ব্যবহার করা হয়। এর স্বাদ অনেকটা পানসে হয়।
খাবারে ফরমালিন মুক্ত করার সহজ কিছু টিপস
বর্তমানে খাদ্যদ্রব্যের ভেজালের সমারোহ চলছে। আর বাজার থেকে আমরা বিভিন্ন ফলমূল ও শাক সবজি, মাছ মাংস কিনে থাকি। তাই রান্নার আগে কিভাবে ফরমালিন দূর করবো সেই সম্পর্কে সহজ উপায় জেনে নেওয়া যাক-
- লবন পানিতে ফলমূল ও শাকসবজি ভিজিয়ে রাখতে হবে। এতে ক্ষতিকর রাসায়নিকের পরিমাণ প্রায় ৯০ শতাংশ কমে যায়।
- সবজি ভিনেগার মিশ্রিত পানিতে ১৫ মিনিটের মতো ভিজিয়ে রাখলে ফরমালিন দূর করা সম্ভব।
- ফল ও সবজি হালকা গরম পানি দিয়ে ধোয়ার পরে আবার পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে।
- মাছ ঠান্ডা পানিতে ভিজিয়ে রাখতে হবে প্রায় ১ ঘন্টার মতো এতে করে প্রায় ৬১শতাংশ ফরমালিন দূর হয়ে যায়।
- মাছ রান্নার আগে লবন পানিতে ডুবিয়ে রাখলেও প্রায় অনেকাংশে ফরমালিনের পরিমাণ কমে যায়।
- চাল ধোয়া পানি দিয়ে মাছ ধুয়ে নিয়ে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুতে হবে, এতে প্রায় ৭০ শতাংশ ফরমালিন কমে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকবে।
- যেসকল ফলের খোসা ছাড়ানো যায় সেগুলো ফলের খোয়া ফেলে দিতে হবে। তারপরে ধুলে নিতে হবে।
- যেসকল ফলের খোসা ছাড়ানো যায় না সেগুলো পানি দিয়ে ভালো করে ধুয়ে পরিষ্কার কাপড় দিয়ে মুছে তারপরে খেতে হবে।
- শুঁটকি মাছ থেকে ফরমালিন দূর করার একটি সহজ উপায় হলো, রান্নার আগে প্রথমে ১ ঘন্টা লবন মিশ্রিত হালকা গরম পানিতে ডুবিয়ে রাখতে হবে। তারপর ঠান্ডা পানি দিয়ে ধুয়ে ফেলতে হবে।
উপসংহার
আমাদের দেশে ফরমালিন মুক্ত খাবার পাওয়া কষ্টসাধ্য ব্যাপার হয়ে গিয়েছে। আমরা নিজেদের অজান্তে ফরমালিন যুক্ত খাবার খেয়ে দস্বাস্থ্যঝুঁকিতে পরছি। এই বিষয়ে আমাদের অবশ্যই সর্তক হতে হবে। বাজার থেকে খাদ্য কেনার আগে ফরমালিন মিশ্রিত আছে কিনা তা ভালো করে যাচাই করতে হবে। আজকের এই আর্টিকেল পড়ে আশা করছি ফরমালিন মুক্ত খাবার কিভাবে চিনবেন তা বুঝতে পেরেছেন। ফরমালিন মুক্ত খাবার খান, নিজে ও পরিবারসহ সুস্থ্য থাকুন।