You are currently viewing হাজি-নান্নার বিরিয়ানি-এক কামড়ে ঐতিহ্যের স্বাদ!
হাজি-নান্নার বিরিয়ানি

হাজি-নান্নার বিরিয়ানি-এক কামড়ে ঐতিহ্যের স্বাদ!

বাংলাদেশের সমৃদ্ধ এবং বৈচিত্র্যময় খাদ্যসংস্কৃতির মধ্যে হাজি নান্নার বিরিয়ানি একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। পুরান ঢাকার ঐতিহ্যবাহী এই খাবারটি শুধুমাত্র এর স্বাদের জন্যই নয়, বরং এর ইতিহাস এবং প্রভাবের জন্যও বিখ্যাত। ১৯৩৯ সালে হাজি মোহাম্মদ নান্না মিয়া কর্তৃক প্রবর্তিত এই বিরিয়ানি ঢাকার খাদ্যপ্রেমীদের কাছে দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে। 

বিশেষ মশলা এবং বিশেষভাবে মেরিনেট করা মাংসের সংমিশ্রণ এই বিরিয়ানির স্বাদকে অনন্য করেছে, যা ঢাকার খাদ্যসংস্কৃতির প্রতীক হয়ে উঠেছে। হাজি নান্নার বিরিয়ানি শুধু একটি খাবার নয়, বরং এটি ঢাকার ঐতিহ্য এবং ইতিহাসের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা আজও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক এবং জনপ্রিয়।

হাজি-নান্নার বিরিয়ানি এর উৎস

হাজি নান্নার বিরিয়ানি বাংলাদেশের ঢাকায় অবস্থিত পুরান ঢাকার এক বিখ্যাত খাবার। এর প্রবর্তক হাজি মোহাম্মদ নান্না মিয়া, যিনি ১৯৩৯ সালে ঢাকার কুতুবখালী এলাকায় এই বিরিয়ানি তৈরি ও বিক্রি শুরু করেন। সেই সময়ে, ঢাকার বিরিয়ানি সংস্কৃতি তেমন প্রসার লাভ করেনি এবং খাবারের বিভিন্ন ধরনের প্রাচীন রেসিপির মধ্যে এটি একটি নতুন সংযোজন ছিল। নান্না মিয়ার বিরিয়ানি তার অনন্য স্বাদ এবং সুগন্ধের কারণে দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে এবং ঢাকার মানুষের মনে একটি বিশেষ স্থান দখল করে।

হাজি-নান্নার বিরিয়ানি এর ইতিহাস

হাজি নান্নার বিরিয়ানির ইতিহাস মূলত পুরান ঢাকার খাবারের ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। পুরান ঢাকা বরাবরই তার খাবারের ঐতিহ্যের জন্য বিখ্যাত। এখানে খাবারের সংস্কৃতি এবং বিভিন্ন ধরণের ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রচলন বহু পুরনো। হাজি মোহাম্মদ নান্না মিয়া এই খাবারের ঐতিহ্যকে আরো সমৃদ্ধ করতে তার নিজস্ব রেসিপি দিয়ে বিরিয়ানি তৈরির সিদ্ধান্ত নেন।

প্রথমে নান্না মিয়া খুব ছোট আকারে তার বিরিয়ানি বিক্রি শুরু করেন। কিন্তু তার বিরিয়ানির স্বাদ এবং বিশেষত্বের কারণে এটি খুব দ্রুত জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। লোকেরা তার বিরিয়ানির জন্য দীর্ঘ লাইনে দাঁড়াতো এবং তার দোকানটি ঢাকার এক জনপ্রিয় খাবারের গন্তব্যস্থলে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে, হাজি নান্নার বিরিয়ানি সারা বাংলাদেশে পরিচিত হয়ে ওঠে এবং এটি ঢাকার সবচেয়ে বিখ্যাত বিরিয়ানিগুলির মধ্যে একটি হয়ে ওঠে।

মূল উপকরণ:

  • বাসমতি চাল: ১ কেজি
  • খাসির মাংস: ১ কেজি (মেরিনেট করা)
  • পেঁয়াজ: ৪-৫ টি (মাঝারি আকারের, সরু কুচি করা)
  • রসুন বাটা: ২ টেবিল চামচ
  • আদা বাটা: ২ টেবিল চামচ
  • টক দই: ১ কাপ
  • লেবুর রস: ২ টেবিল চামচ
  • ঘি বা তেল: ১ কাপ
  • জিরা: ১ টেবিল চামচ
  • এলাচ: ৫-৬ টি
  • দারুচিনি: ২-৩ টুকরা
  • লবঙ্গ: ৫-৬ টি
  • তেজপাতা: ২-৩ টি
  • লবণ: স্বাদমতো
  • কেওড়া জল: ২ টেবিল চামচ
  • গোলাপ জল: ১ টেবিল চামচ
  • জাফরান: ১ চিমটি (দুধে ভেজানো)
  • পানি: প্রয়োজনমতো

রান্নার পদ্ধতি

মাংস মেরিনেট করা

খাসির মাংস টক দই, আদা বাটা, রসুন বাটা, লেবুর রস, এবং সামান্য লবণ দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে মেরিনেট করে রাখুন। এটি কমপক্ষে ২-৩ ঘণ্টা রাখতে হবে, তবে রাতভর মেরিনেট করলে স্বাদ আরও ভালো হয়।

চাল প্রস্তুতি

বাসমতি চাল ভালোভাবে ধুয়ে কিছুক্ষণ (প্রায় ৩০ মিনিট) ভিজিয়ে রাখুন।

পেঁয়াজ ভাজা

একটি বড় পাত্রে ঘি বা তেল গরম করুন। পেঁয়াজ কুচি দিয়ে সোনালী বাদামী হওয়া পর্যন্ত ভাজুন। ভাজা পেঁয়াজের কিছু অংশ সাজানোর জন্য তুলে রাখুন।

মাংস রান্না করা

একই পাত্রে মেরিনেট করা মাংস যোগ করুন এবং উচ্চ আঁচে কষাতে থাকুন। মাংসের সাথে জিরা, এলাচ, দারুচিনি, লবঙ্গ, এবং তেজপাতা মিশিয়ে দিন। মাংস ভালোভাবে কষানো হলে, কিছুটা পানি যোগ করে ঢেকে দিন এবং মাংস নরম হওয়া পর্যন্ত রান্না করুন।

চাল সেদ্ধ করা

অন্য একটি বড় পাত্রে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি গরম করুন এবং তাতে সামান্য লবণ দিন। পানি ফুটে উঠলে ভেজানো বাসমতি চাল যোগ করুন এবং চাল আধা সেদ্ধ হওয়া পর্যন্ত রান্না করুন। এরপর চাল ছেঁকে পানি ফেলে দিন।

দম দেওয়া

মাংসের পাত্রে আধা সেদ্ধ চালের একটি স্তর দিন। এর ওপর ভাজা পেঁয়াজ, কেওড়া জল, গোলাপ জল, এবং জাফরান দুধ ছিটিয়ে দিন। পাত্রের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করে কম আঁচে দমে রাখুন প্রায় ৩০-৪৫ মিনিট।

পরিবেশন

দম শেষ হলে, পাত্রটি খোলার আগে কিছুক্ষণ অপেক্ষা করুন। এরপর হাজি-নান্নার বিশেষ মশলাদার বিরিয়ানি সাজিয়ে পরিবেশন করুন।

হাজি নান্নার বিরিয়ানি তৈরির এই পদ্ধতি এবং উপকরণের মিশ্রণই এর বিশেষ স্বাদ এবং সুগন্ধের জন্য দায়ী। তবে আপনি যদি বাসায় এই সকল পদ্ধতি অনুসরণ করে হাজি নান্নার বিরিয়ানির আসল স্বাদ উপভোগ করতে চান, তবে ক্ষেত্র বিশেষে ব্যর্থ হওয়াই স্বাভাবিক। কারণ এর জন্য প্রয়োজন পাকা হাতের ছোয়া। তাই হাজি নান্না বিরিয়ানির প্রকৃত স্বাদের তৃপ্তি পেতে হলে আপনাকে ঢাকায় আসতেই হবে। 

হাজি-নান্নার বিরিয়ানি এর স্বতন্ত্র কিছু বৈশিষ্ট্য

হাজি নান্নার বিরিয়ানি তার স্বাদের জন্য যেমন বিখ্যাত, তেমনি এর কিছু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা এটিকে অন্যান্য বিরিয়ানি থেকে আলাদা করে। নিম্নে এই বিরিয়ানির বিশেষ স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরা হলো:

মশলার নির্দিষ্ট সংমিশ্রণ 

হাজি নান্নার বিরিয়ানিতে ব্যবহৃত মশলার সংমিশ্রণ বিশেষভাবে প্রস্তুত করা হয়, যা এর স্বাদ এবং সুগন্ধকে অনন্য করে তোলে। দারুচিনি, এলাচ, লবঙ্গ, তেজপাতা, এবং জিরার মিশ্রণ এই বিরিয়ানিতে একটি গভীর এবং সমৃদ্ধ স্বাদ যোগ করে।

সুস্বাদু খাবার রান্নায় কোন মসলার কি কাজ- জেনে নিন বিস্তারিত 

খাসির মাংসের ব্যবহার

এই বিরিয়ানিতে খাসির মাংস ব্যবহার করা হয়, যা আগে থেকে টক দই, আদা-রসুন বাটা এবং লেবুর রস দিয়ে মেরিনেট করা হয়। মাংসের মেরিনেশন প্রক্রিয়া এবং রান্নার ধরণ এটিকে খুবই নরম এবং রসালো করে তোলে।

কেওড়া জল এবং গোলাপ জল

হাজি নান্নার বিরিয়ানির একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো কেওড়া জল এবং গোলাপ জল ব্যবহার, যা বিরিয়ানির সুগন্ধকে বহুগুণে বাড়িয়ে তোলে। এই বিশেষ উপকরণগুলি বিরিয়ানির স্বাদে একটি ফ্লোরাল এবং মিষ্টি নোট যোগ করে।

বাসমতি চালের ব্যবহার

বিরিয়ানিতে উচ্চ মানের বাসমতি চাল ব্যবহার করা হয়, যা এর সুগন্ধ এবং স্বাদে বিশেষ ভূমিকা পালন করে। বাসমতি চালের দীর্ঘ এবং সরু দানা বিরিয়ানির সৌন্দর্যও বাড়িয়ে তোলে।

দম পদ্ধতি 

হাজি নান্নার বিরিয়ানি দম পদ্ধতিতে রান্না করা হয়, যেখানে মাংস এবং চাল একসাথে কম আঁচে দমে রাখা হয়। এই প্রক্রিয়াটি সব উপকরণকে সমানভাবে রান্না করে এবং বিরিয়ানির স্বাদ এবং গন্ধকে সম্পূর্ণরূপে উন্নত করে।

ভাজা পেঁয়াজের ব্যবহার

বিরিয়ানিতে ভাজা পেঁয়াজ ব্যবহার করা হয়, যা এর স্বাদকে মিষ্টি এবং খাস্তা করে তোলে। এই ভাজা পেঁয়াজ বিরিয়ানির টপিং হিসেবেও ব্যবহার করা হয়, যা এর চেহারা এবং স্বাদে একটি বিশেষ মাত্রা যোগ করে।

নির্দিষ্ট রান্নার পদ্ধতি

হাজি নান্নার বিরিয়ানি তৈরির প্রক্রিয়াটি শতাব্দীর পুরনো এবং এটি বিশেষভাবে অনুসরণ করা হয়। নির্দিষ্ট রান্নার পদ্ধতি এবং উপকরণের পরিমাণ প্রতিবার একই স্বাদ নিশ্চিত করে।

এই স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যগুলির কারণে হাজি নান্নার বিরিয়ানি ঢাকার এবং বাংলাদেশের একটি আইকনিক খাবার হিসেবে পরিচিত। এটি শুধু খাবার নয়, বরং একটি ঐতিহ্যের অংশ যা প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে সংরক্ষিত হয়েছে।

জনপ্রিয় হোটেল এবং রেস্তোরাঁর শাখা

হাজি নান্নার বিরিয়ানি বাংলাদেশের বিভিন্ন জায়গায় জনপ্রিয় এবং কিছু নির্দিষ্ট হোটেল এবং রেস্তোরাঁ এর জন্য বিখ্যাত। নীচে কিছু জনপ্রিয় হোটেল এবং তাদের শাখার নাম উল্লেখ করা হলো:

হাজি নান্না বিরিয়ানি হাউস:

মুল শাখা

  • পুরান ঢাকা, কুতুবখালী, ঢাকেশ্বরী মন্দিরের পাশের গলি, ঢাকা।

অন্যান্য শাখা

  • মতিঝিল শাখা: কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন সংলগ্ন এলাকা, মতিঝিল, ঢাকা।
  • গুলশান শাখা: গুলশান ২, ঢাকা।
  • উত্তরা শাখা: সেক্টর ৪, উত্তরা, ঢাকা।

হাজি নান্না বিরিয়ানি অ্যান্ড রেস্তোরাঁ:

মুল শাখা

  • পুরান ঢাকা, নাজিমউদ্দিন রোড, চকবাজার, ঢাকা।

অন্যান্য শাখা

  • ধানমন্ডি শাখা: ধানমন্ডি ১৫ নম্বর রোড, ঢাকা।
  • বনানী শাখা: রোড ১১, ব্লক ই, বনানী, ঢাকা।
  • মিরপুর শাখা: পল্লবী, মিরপুর ১০, ঢাকা।

হাজি নান্না বিরিয়ানি সেন্টার:

মুল শাখা

  • লালবাগ শাখা: লালবাগ কেল্লার কাছাকাছি, পুরান ঢাকা।

অন্যান্য শাখা

  • মোহাম্মদপুর শাখা: মোহাম্মদপুর বাস স্ট্যান্ড, ঢাকা।
  • বাড্ডা শাখা: প্রধান সড়ক, মধ্য বাড্ডা, ঢাকা।

হাজি নান্না বিরিয়ানি রেস্টুরেন্ট:

মুল শাখা

  • গাবতলী শাখা: গাবতলী বাস টার্মিনাল, ঢাকা।

অন্যান্য শাখা

  • আজিমপুর শাখা: আজিমপুর বাস স্ট্যান্ডের কাছে, ঢাকা।
  • ফার্মগেট শাখা: ফার্মগেট বাজার এলাকা, ঢাকা।

হাজি নান্না কিচেন:

মুল শাখা

  • মিরপুর ১ শাখা: মিরপুর ১ গোল চত্বরের কাছাকাছি, ঢাকা।

অন্যান্য শাখা

  • শান্তিনগর শাখা: শান্তিনগর মোড়, ঢাকা।
  • বংশাল শাখা: বংশাল রোড, পুরান ঢাকা।

এই সব শাখাগুলি হাজি নান্নার বিরিয়ানি প্রেমীদের জন্য একটি নির্ভরযোগ্য এবং জনপ্রিয় স্থান, যেখানে তাঁরা আসল স্বাদের বিরিয়ানি উপভোগ করতে পারেন। প্রতিটি শাখা একই মানের এবং স্বাদের বিরিয়ানি সরবরাহ করে, যা হাজি নান্নার বিরিয়ানির ঐতিহ্য এবং বিশেষত্বকে বজায় রাখে।

উপসংহার

হাজি-নান্নার বিরিয়ানি ঢাকার এবং বাংলাদেশের খাবারের ইতিহাসে একটি বিশেষ স্থান দখল করে আছে। এর স্বাদের রহস্য এবং বিশেষত্বের কারণে এটি দ্রুত জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং বর্তমানে এটি বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী খাবারের মধ্যে অন্যতম হিসেবে বিবেচিত হয়। এটি বাংলাদেশের মানুষদের জন্য একটি গর্বের বিষয় এবং দেশের খাদ্যসংস্কৃতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। 

ঐতিহ্যবাহী রেসিপি, উন্নত মানের উপকরণ এবং অসাধারণ স্বাদের জন্য হাজি নান্নার বিরিয়ানি দীর্ঘদিন ধরে ঢাকার বিরিয়ানি প্রেমীদের কাছে জনপ্রিয়। ঢাকায় বেড়াতে এলে অবশ্যই হাজি নান্নার বিখ্যাত বিরিয়ানি চেখে দেখুন। ঐতিহ্যবাহী খাবারের প্রতি নান্না মিয়ার অবদান এবং তার সৃষ্টির প্রতি মানুষের ভালোবাসা আজও অব্যাহত রয়েছে।

Bornali Akter Borno

Bornali Akter Borno is a passionate food enthusiast and entrepreneur. From an early age, her love for culinary exploration led her to experiment with flavors and ingredients, ultimately inspiring her to work with Binni Food, an e-commerce brand dedicated to offering premium quality Organic Food and delectable treats to food enthusiasts in Bangladesh. Bornali's relentless pursuit of flavor and commitment to excellence have earned her recognition in the culinary world. Her journey is a testament to the power of passion and perseverance, showcasing how dedication to one's craft can lead to entrepreneurial success and culinary innovation.