বর্তমান সময়ে ছোট থেকে বড় সকলের মধ্যে মানসিক চাপের লক্ষণ দেখা যায়। মানসিক চাপে আক্রান্ত ব্যাক্তিদের অবস্থা ভয়াবহ হতে পারে। দীর্ঘদিন যাবৎ মানসিক চাপের ফলে অনেকেই আত্মহননের পথ বেছে নেন। তারা মানসিক ভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়ে পরেন। বাংলাদেশ মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের গবেষণা থেকে জানা যায় ২০২৩ সালের গবেষনা প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে প্রায় ৫০ শতাংশ মানুষ মানসিক চাপে ভুগছেন।
সময়ের সাথে সাথে আমাদের জীবনযাত্রা পরিবর্তন হয়ে যায় এবং স্ট্রেসের পরিমাণ বেড়ে যায়। মানসিক চাপ বাড়ার ফলে আমরা স্বাভাবিক ভাবে ভেঙে পরে যাই। এতে আমাদের জীবন জটিল হতে শুরু করে। মানসিক চাপ মোকাবিলার একটি পদক্ষেপ হচ্ছে, কী কারণে মানসকি চাপে ভুগছেন তা খুঁজে বের সমাধান করা। আজকের আর্টিকেলে আমরা মানসিক চাপ মোকাবিলা করার উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
মানসিক চাপ কি
মানসিক চাপ বলতে আমরা যখন কোনো কাজ করতে চাই কিন্তু পরিস্থিতির কারণে সেই কাজটি করতে পারিনা তখন মানসিকভাবে একধরনের চাপ অনুভব করতে থাকি। ফলে একজন মানুষের মানসিক স্বাস্থ্যের উপরে যেমন নেতিবাচক প্রভাব ফেলে তেমনি শারীরিক স্বাস্থ্যের উপরে ক্ষতিকর প্রভাব পরে। যেমন একজন ব্যক্তি চাকরি হারানোর কারণে মানসিক চাপের শিকার হতে পারে। শুধু তাই নয় ঋণের বোঝা বা অতিরিক্ত কাজরে চাপ থাকার ফলেও মানসিকভাবে চাপ অনুভব করতে থাকে। পরর্তীতে তাদের মধ্যে উদ্বেগ ও হতাশার লক্ষণ দেখা যায়। অন্যদিকে একজন মা তার সন্তানের অসুস্থতার কারণে মানসিক চাপের শিকার হন। তাদের মধ্যে হতাশ ও ভীত কাজ করতে থাকে। অতএব, মানসিক চাপ পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী ভিন্নতা দেখা যায়।
মানসিক চাপের কারণ
মানসিক চাপের কারণ পরিবশে ও ব্যক্তিভেদে আলাদা হয়েছে থাকে। চলুন মানসিক চাপের কারণগুলো এক নজরে দেখা যাক-
- বিভিন্ন ধরনের দুশ্চিন্তা থেকে মানসিক চাপ হতে পারে।
- আমাদের মন খারাপের কারণেও মানসিক চাপ বেড়ে যায়।
- অনেক সময় আমরা নিজেকে ছোট করে দেখি যার কারণেও মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়।
- শারীরিক অসুস্থতা ফলেও মানসিক চাপ বেড়ে যায়।
- পারিবারিক কলহ, দ্বন্দ ও ঝগড়া কারণে মানসিক চাপের সৃষ্টি হয়।
- কর্মক্ষেত্রে অরিতিরিক্ত কাজের চাপের কারণেও অনেক সময় মানসিক চাপ দেখা যায়।
- বেকারত্বের দুশ্চিন্তা মানসিক চাপের অন্যতম একটি কারণ।
- অর্থনৈতিক অসচ্ছলতা কারণেও মানসিক চাপ সৃষ্টি হয়।
- খারাপ অভিজ্ঞতা স্মৃতিচারণ হলে মানসিক চাপের সৃষ্টি হতে পারে।
- অপ্রত্যাশিত ঘটনাগুলো আমাদের মানসিক চাপ বাড়িয়ে দেয়।
- অস্বস্তিকর জীবনযাত্রার কারণেও স্ট্রেস সৃষ্টি হয়।
- স্বাস্থ্য সমস্যা বা পরিবারের অসুস্থ্য সদস্যের যত্ন নেওয়ার কারনেও মানসিক চাপ দেখা যায়।
মানসিক চাপ মোকাবিলা
আমাদের প্রত্যেকের দৈনন্দিন জীবনে বিভিন্ন ধরনের চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। যদিও বর্তমান সময়ে খুবই স্বাভাবিক বিষয় হয়ে ওঠেছে। এসকল চিন্তা ভাবনার কারণে আমরা নিজেদের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলছি। ফলে আমাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপরে বিরুপ প্রভাব ফেলছে। দীর্ঘদিন যাবৎ মানসিক চাপের কারণে ভয়ংকর পরিস্থিতির সম্মুখীন হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই মানসিক চাপ মোকাবিলার জন্য দ্রুত ব্যবস্থা নেওয়া প্রয়োজন। এতে আমরা সুস্থ স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারবো। মানসিক চাপ মোকাবেলার জন্য কার্যকরী উপায় সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশ করা
আমাদের প্রত্যেকের উচিত নিজ নিজ ধর্ম অনুযায়ী বিশ্বাসের সাথে প্রার্থনা করা। নিয়মিত নামাজ পড়া, কুরআন তেলাওয়াত ও তাকদিরের উপর বিশ্বাস রেখে ইবাদত পালন করার ফলে মানসিক শান্তি পাওয়া যায়। তাই মানসিক চাপ থেকে দূরে থাকার জন্য ধর্মীয় কাজে মনোনিবেশন করা উচিত।
প্রিয় মানুষদের সাথে যোগাযোগ করা
মানসিক চাপ কমানোর জন্য একটি কার্যকরী উপায় হলো প্রিয় মানুষদের সাথে সময় কাটানো। এছাড়াও আমরা অনেক সময় বিভিন্ন সমস্যার মধ্যে পরে যাই। সেক্ষেত্রে পরিবারের সদস্য বা বিশ্বস্ত বন্ধুদের কাছে যেকোনো সমস্যার কথাগুলো খুলে বললে নিজের মধ্যে হালকা অনুভব হয়। এবং মাথা থেকে মানসিক চাপ কমে যায়।
যোগব্যায়াম বা ধ্যান করা
প্রাচীন কাল থেকেই ধ্যান বা যোগব্যায়াম করার প্রচলন রয়েছে। এটি শারীরিক সুস্থতার পাশাপাশি আমাদের মানসিক সুস্থতা রক্ষা করতে অনেক উপকারী একটি উপায়। যোগব্যায়াম করলে দুশ্চিন্তা দূর হয়, নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাস বেড়ে যায়। এমনকি আমাদের শরীরের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করে।
ডিজিটাল ডিভাইস থেকে বিরতি
বর্তমানের এই আধুনিক যুগে ডিভাইসের ব্যবহার দিন দিন বেড়েই চলছে। ছোট শিশু থেকে শুরু করে বয়স্ক মানুষরা ডিভািইসের প্রতি আশক্ত হয়ে পরছেন। বেশি সময় ধরে সোস্যাল মিডিয়ায় সক্রিয় থাকার কারণে আমাদের মূল্যবান সময়গুলো নষ্ট হচ্ছে। এতে করে আমাদের মানসিক চাপ বেড়ে যাচ্ছে। তাই মানসিক চাপ মোকাবেলার জন্য ডিজিটাল ডিভাইস থেকে যতটা সম্ভব দূরে থাকা।
ভ্রমণে বের হওয়া
ট্রাভেলিং বা ভ্রমণের মাধ্যমে আমরা নতুন পরিবেশন ও মানুষের সাথে পরিচিত হতে পারি। প্রকৃতির সৌন্দর্য উপভোগ করার ফলে আমাদের মন প্রফুল্ল ও সতেজ হয়ে ওঠে। এবং মানসিক দুশ্চিন্ত থেকে দূরে থাকা যায়। তাই সারাদিনের কর্মব্যস্ততার মাঝে একটু সময় বের করে পরিবারের সাথে ভ্রমণে বের হওয়া উচিত। এতে প্রিয় মানুষদের সাথে সুন্দর সময় কাটানো যাবে। অন্যদিকে আমাদের মন সতেজ থাকবে।
পছন্দের কাজগুলো করা
পছন্দের যেকোনো কাজ করার ফলে একধরনের ভালোলাগা কাজ করে। ব্যাক্তিভেদে পছন্দের বা শখের কাজ ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। যেমন কেউ গান শুনতে পছন্দ করেন, বই পড়তে বা খেলাধুলা করতে বেশ পছন্দ করেন। এই কাজগুলো করার মাধ্যমে নিজেকে আনন্দ দেওয়া যায়। ফলে মানসিক চাপ থেকেও রেহায় পাওয়া যায়।
পোষা প্রানীর সাথে সময় কাটানো
প্রানীদের সাথে সময় কাটানোর ফলে মানুষের শরীরে কর্টিসোল নামক হরমোন নিৎসৃত হলে মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। বিড়ালের সাথে থাকলে মানুষের একাকিত্ব ও অবসাদ কমে বলে ধারণা করা হয়। তাই যদি সম্ভব হয় বাসায় পোষা প্রানী রাখতে পারেন।
পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রাম নেওয়া
দিনের পর দিন ঠিকমতো ঘুম ও বিশ্রামের অভাবে মানসিক চাপের সৃষ্টি হতে পারে। ঘুম আমাদের সারাদিনের ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে। তাই ব্যস্ততার মাঝেও আমাদেরকে প্রতিদিন একটি নির্দিষ্ট সময়ে পর্যাপ্ত সময় ঘুমানো উচিত। নিরিমিলি ও শান্ত পরিবেশে বিশ্রাম ও ঘুমের ব্যবস্থা করতে হবে।
কিছুক্ষনের জন্য বিরত নিন
অনেক সময় অরিতিক্ত কাজের চাপের ফলে অবসাদ চলে আসে। দৈনন্দিন কাজে বাধাগ্রস্ত করে হতাশা সৃষ্টি করে। ফলে মানসিক চাপ অনুভব করতে থাকি আমরা। এক্ষেত্রে নিজেকে সময় দিতে হবে। কিছুক্ষনের জন্য ব্রেক নেওয়া নেওয়া যেতে পারে। যা আমাদের মানসিক চাপ কিছুটা হলেও দূর করতে সাহায্য করবে।
স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া
আমাদের সকলের উচিত স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়া। একটি পুষ্টিকর ডায়েট অনুসরণ করতে হবে। এবং সঠিক পরিমাণে পুষ্টিকর খাদ্য গ্রহণ করা উচিত। এতে আমাদের মনকে স্থিতিশীল রাখতে সাহায্য করে। খাবারের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
বিশেষজ্ঞের পরামর্শ
মানসিক চাপের শেষ পর্যায়ে যাওয়া আগ মুহূর্তে যদি কোনো ভাবেই মোকাবিলা করা সম্ভব না হয়। সেক্ষেত্রে যতদ্রুত সম্ভব বিশেষজ্ঞের পরামর্শ নেওয়া। কারণ এই মানসিক চাপ আমাদের মস্তিষ্ক বিকাশে ক্ষতি সাধন করে।
সময় ব্যবস্থাপনা
আমাদের সময়কে কার্যকরভাবে পরিচালনা করলে মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করতে পারে। আমাদের জীবনে সময় খুবই মূল্যবান তাই সময়কে যথাযথ ব্যবহার করা উচিত।
শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম
গভীর শ্বাস প্রশ্বাসের ব্যায়াম আমাদের শরীরকে আরাম দেয়। প্রতিদিন কয়েকমিনিট এই ব্যায়াম করা যেতে পারে। এতে আমাদের মানসিক চাপ কমাতে সাহায্য করে। পাশাপাশি প্রশান্তি বাড়িয়ে দেয়। এছাড়াও আমাদের স্নায়ুতন্ত্র সক্রিয় থাকবে। এবং কঠিন রোগ থেকেও দূরে থাকা যাবে।
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনায় মানসিক চাপের মোকাবিলা সম্পর্কে তুলে ধরা হয়েছে। মানসিক চাপ আমাদের দৈনন্দির জীবনের একটি অংশ। মানসিক চাপ থেকে মুক্তি থাকলে আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করা সহজ হয়ে ওঠে। যেহেতু এটি বর্তমানে খুবই সাধারণ একটি সমস্যা। তাই এই সমস্যা সমাধানের জন্য সঠিক পদক্ষেপ নিতে হবে। যার ফলে আমরা চাপ এড়িয়ে যেতে পারি।