ইসবগুলের ভুসির সাথে আমরা কম বেশি সকলেই পরিচিত। এটি মানুষের শরীরের জন্য খুবই উপকারী। বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধ করতে সহায়ক। এই ভুসি নিয়মিত খাওয়ার অনেক উপকারিতা রয়েছে। সাধারণত পেটের নানান ধরনের সমস্যায় যারা ভুগছেন তারা এটি প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় রেখেছেন। ইসবগুলের ভুসি পেটের বিভিন্ন ধরনের সমস্যা সমাধান করতে সাহায্য করে থাকে। এমনকি পেটকে পরিষ্কার রাখতে ঔষধের চেয়েও অনেক বেশি উপকারী।
ইসগুলের ভুসি খাওয়ার বহুগুণ উপকারিতা রয়েছে। কোষ্টকাঠিন্য, গ্যাস্ট্রিক ও পেটের বিভিন্ন সমস্যা গুলো খুব সহজেই দূর করতে প্রতিদিন এক গ্লাস পানিতে এই ভুসি মিশিয়ে খেতে পারেন। এর কার্যকারিতা আপনি নিজেই দেখতে পারবেন। আজকের আর্টিকেলে আমরা ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
ইসবগুলের ভুসি
ইসবগুল একধরনের ডায়েটারি ফাইবার, যার কিছু অংশ পানিতে দ্রবীভূত হয় ও কিছু অংশ দ্রবীভূত হয়না। এটি খেলে অন্ত্রের মধ্যে থাকাকালীন এই ভূসি প্রচুর পরিমাণ পানি শোষণ করে, কোনো কিছুর সাথে বিক্রিয়া করে বিষ তৈরি করে না। এবং অন্ত্রের দেয়াল পিচ্ছিল করে দেয়। উইকিপিডিয়ার তথ্যানুসারে, এটি একটি গুল্ম জাতীয় উদ্ভিদ। ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোতে এর আদি বাসস্থল। ইসবগুলের ভূষির বৈজ্ঞানিক নাম হলো (Plantago Ovata)। একে রবিশস্য বলা যায়। এটি শুধু ভারতীয় উপসহাদেশে বহুল পরিচিত নয়, বর্তমানে পুরো পৃথিবীতেই জনপ্রিয়তা বেড়েই যাচ্ছে। এটি দেখতে কিছুটা ফ্লি মাছির মতো। তাই বিদেশি বাজারগুলোতে এটি সিলিয়াম হাস্ক নামেই পরিচিত লাভ করেছে। ষোড়শ শতকে বা মোঘল আমলে এটি ভারতীয় উপমহাদেশে প্রবেশ করেছে বলে ধারণা করা হয়। এটি পেটের সমস্যা রোধ করা ছাড়াও শরীরের জন্য অনেক উপকারী।
ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার উপকারিতা
ইসবুগুলের ভুসিতে অনেক পুষ্টি উপাদান রয়েছে। ১ টেবিল চামচ ইসবগুলে থাকে ৫৩ শতাংশ ক্যালোরি, ১৫ মিলিগ্রাম সোডিয়াম, ১৫ গ্রাম শর্করা, ৩০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম, ০.৯ মিলিগ্রাম আয়রন ইত্যাদি। এই ভুসির অনেক উপকারিতা রয়েছে। চলুন বিস্তারিত জেনে নেওয়া যাক-
কোষ্টকাঠিন্য প্রতিরোধ করতে
ইসবগুলের ভুসি কোষ্টকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে। কারণ এর মধ্যে রয়েছে দ্রবণীয় ও অদ্রবণীয় খাদ্য আঁশ যা কোষ্ঠকাঠিন্য রোগীদের মল নরম করতে সাহায্যে করে। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে ২ চামচ ইসবগুলের ভুসি ও ১ গ্লাস কুমুস গরম দুধ পান করতে হবে। এই কোষ্ঠকাঠিন্য রোগ থেকে কোলন ক্যান্সার হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই যতদ্রুত সম্ভব এই রোগ প্রতিরোধের উপযুক্ত সঠিক ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী।
রক্তে কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে
ইসবগুলের ভুসি আমাদের অন্ত্রে একধরনের স্তর তৈরি করে। যা কোলেস্টেরল শোষণে বাধা দান করে। এটি ক্ষতিকর কোলেস্টেরলের মাত্রা কমিয়ে দেয় ও ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে তোলে। ফলে আমাদের রক্তের কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকে। তাই নিয়মিত এই ভুসি খাওয়া যেতে পারে। যা রক্তের কোলেস্টের স্বাভাবিক রাখতে সাহায্য করবে।
ডায়রিয়া প্রতিরোধ করতে
পানিবাহিত একটি রোগের নাম হলো ডায়রিয়া। এই হলে আমাদের শরীরকে পানি শূন্য করে ফেলে। মূলত ডায়রিয়া রোগীদের জন্য ইসবগুলের ভুসি বেশ উপকারি। এটি টনিক হিসেবে দারুন কাজ করে। তাই ডায়রিয়া হলে এই ভুসি খেতে পারেন।
ওজন কমাতে
অতিরিক্ত ওজন নিয়ে দুশ্চিন্তায় অনেকেই থাকেন। সেই সাথে আমরা ডায়েট অনুযায়ী আমাদের খাদ্যতালিকায় পরিবর্তন এনে ফেলি।যেহেতু ইসবগুলের ভুসিতে ফাইবার উপস্থিত রয়েছে। যা খাওয়ার ফলে পেট অনেক্ষণ ভরা থাকে এবং ক্ষুধা অনেক কম লাগে। তাই যারা ওজন কমাতে চান তারা চাইলে এই ভুসি ডায়েটে অর্ন্তভুক্ত করতে পারেন।
ডায়াবেটিস প্রতিরোধ করতে
সাধারণত রক্তে সুগারের মাত্রা বেড়ে গেলে ডায়াবেটিস দেখা দেয়। এই ভুসিতে রয়েছে জিলাটিন নামক একটি উপাদান। যা দেহের গ্লুেকোজে শোষণ ও ভাঙার প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করে। ফলে রক্তে সুগারের পরিমাণ বাড়তে পারেনা। তাই যারা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে চান তারা নিয়মিত ভুসি খেতে পারেন। যা আপনার ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে পাশাপাশি প্রতিরোধ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে।
গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করতে
গ্যাস্ট্রিক সমস্যা আমাদের দেশে একটি পরিচিত সমস্যা। অতিরিক্ত তেলযুক্ত খাবার, নিত্যদিন ভাজা পোড়া খাবার খাওয়ার ফলে অনেকেই এই সমস্যায় ভোগেন। ইসবগুলের ভুসি গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা দূর করতে গুরুত্বপূর্ণ সাহায্য করে। তাই যারা দীর্ঘদিন যাবৎ গ্যাসের সমস্যায় ভুগছেন তারা নিয়মিত এই ভুসি খেতে পারেন। এতে ফাইবার রয়েছে যা আমাদের পাকস্থলীতে একটি স্তর তৈরি করে। ফলে নিয়মিত ভুসি খেতে আমাদের অ্যাসিডিটির হাত থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
প্রসাবের জ্বালাপোড়া দূর করতে
পানি কম খাওয়ার ফলে, এবং অতিরিক্ত গরমে এই সমস্যাটা বেশি দেখা যায়। এছাড়াও যাদের ইউরিনের ইনফেকশন রয়েছে তারা এই ভুসি নিয়মিত সকালে খেলে প্রবাবের জ্বালাপোড়ার সমস্যা অনেকাংশে কমে যাবে। প্রসাবের রং স্বাভাবিক থাকবে।
আমাশয় জীবানু থেকে রক্ষা করতে
আমাশয় এর জীবানু থেকে আমাদের রক্ষা করতে সাহায্য করে ইসবগুলের ভুসি। শিগেলা গণভুক্ত ব্যাকটেরিয়া আমাদের দেহে প্রবেশ করলে এই রোগটি হয়ে থাকে। এই ভুসি খেলে ব্যাকটেরিয়াকে দমন করতে সাহায্য করে। তাই আমাশয় জনিত সমস্যা হলে নিয়মিত ভুসি খেতে হবে।
আইবিএস চিকিৎসায়
আইবিএস চিকিৎসার ক্ষেত্রে ভুসি অনেক উপকারী একটি খাবার। মূলত এই সমস্যা হলো পরিপানালির একটি ক্রিয়ামূলক ব্যাধি। এই সমস্যায় আক্রান্ত ব্যাক্তিদের পায়খানা কখনো কষা আবার কখনো পাতলা হয়ে থাকে। স্বাস্থ্যকর খাবারের পাশাপাশি নিয়মিত ইসবগুলের ভুষি খেলে বেশ উপকার পাওয়া যায়।
পেট ঠান্ডা রাখতে
প্রচন্ড গরমে আমাদের পেট ঠান্ডা রাখতে বিভিন্ন শরবত খেয়ে থাকি। পাশাপাশি এই ইসবগুলের ভুসি খাওয়া যেতে পারে। যা খেলে শুধু পেট নয়, শরীরকেও ঠান্ডা সতেজ ও ফেশ রাখতে সাহায্য করে। এছাড়াও রমজান মাসে ইফতারের সময় এই ভুসি খেতে পারি।
ইসবগুলের ভুসি যেভাবে খাবেন
ইসবগুলের ভুসি যেভাবে খাওয়া যেতে পারে তা হলো-
- প্রতিদিন ৫ থেকে ১০ গ্রাম ইসবুগলের ভুসি খাওয়া যথেষ্ট। খাবার খাওয়ার আগে বা পরে ১গ্লাস পানিতে ১ চা চামচ ভুসি ভিজিয়ে রেখে খাওয়া যেতে পারে।
- এই ভুসিতে ফাইবার থাকার কারণে খাবার খাওয়ার ৩০ মিনিট আগে এই ভুসি খেলে পেট ভরা থাকে। ফলে বেশি পরিমাণে খাবার খাওয়া খেতে বিরত রাখতে সাহায্য করবে। যারা ওজন কমাতে চান তারা এইভাবে খেতে পারেন যা দারুণ কাজে দিবে।
- কোষ্টকাঠিন্য সমস্যায় যারা ভুগছেন তারা ইসবগুলের ভুসির সাথে দই খেতে পারেন। কোষ্টকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করবে। সেই সাথে পেট ও শরীরকে ঠান্ডা রাখবে।
- আমরা অনেক সময় ভারি খাবার খাওয়ার পরে কোমল পানীয় খেয়ে থাকি। যা আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। তাই কোমল পানীয় খাওয়ার পরিবর্তে ইসবগুলের ভুসি খেলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে। এটি শরীরের অতিরিক্ত ফ্যাট বা চর্বি জমতে বাধা দেয়।
- লেবুর শরবতের সাথেও ইসবগুলের ভুসি মিশিয়ে খাওয়া যাবে। যেহেতু এই ভুসির নিজস্ব কোনো স্বাদ বা গন্ধ নেই। তাই স্বাদ অনুযায়ী মধু বা গুড় মিশিয়ে খেতে পারেন।
- ইসবগুলের ভুষি কখনোই দীর্ঘসময় পানিতে ভিজিয়ে খাওয়া যাবেনা। ১০-১৫ মিনিটের মতো ভিজিয়ে তারপরে খেতে হবে।
- হাত পায়ে জ্বালাপোড়া ও মাথা ঘুরানো সমস্যা হলে ইসবগুলের সাথে আখের গুড় মিশিয়ে খেলে অনেক উপকার পাওয়া যাবে।
উপরিক্ত আলোচনায় ইসবগুলের ভুসি খাওয়ার উপকারিতা ও যেখানে খাওয়া যাবে সেই সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। অনেকেই আছেন নিয়মিত এই ভুসি খেলেও উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে অবগত ছিলেন না। তারা এই আর্টিকেলের মাধ্যমে সুষ্পষ্ট ধারণা পেয়ে যাবেন। ইসবগুলের ভুসি ঔষধের বিকল্প হিসেবে দারুন কার্যকরী এবং এর বহুগুণ স্বাস্থ্যউপকারিতার জন্য খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। নানান উপকারিতার কারণে আমাদের দেশের মানুষজন শরীর সুস্থ্য রাখতে বেছে নিচ্ছেন এই ভুসি। মূলত এই ভুসি খাওয়ার ফলে আমাদের প্রাকৃতিকভাবে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে।