আমলকি ভিটামিন-সি সমৃদ্ধ শীতকালিন দেশীয় ফল। এই ফলটি অনেক জনপ্রিয় ও সহজলভ্য। ফলটি খেতে সাধারণত টক-মিষ্টি স্বাদের হয়ে থাকে। আমরা সকলেই আমলকির সাথে পরিচিত। কম বেশি সবাই আমলকি খেয়েছি। এছাড়াও চুলের যত্নে ব্যবহার করা হয় আমলকি। এটি চুলের দেওয়ার ফলে চুল অনেক কালো হয়। শুধু তাই নয় চুল কালো করার পাশাপাশি চুলকে করে মজবুত ও ঘন।
আমলকি শুধু ফল হিসেবে নয়, আচার হিসেবেও খাওয়া যায়। অন্যান্য সকল ফলের মতোই আমলকী দিয়ে সহজেই মুখোরচক আচার ঘরোতেই বানানো যায়। আজকে আমরা আমলকির আচার সম্পর্কে জানবো।
আমলকির আচার
আচার তো আমরা সকলেই পছন্দ করে থাকি। আমলকির দিয়েও যে মজাদার আচার বানোনো যায়, এটি হয়তো অনেকেই জানেন না। ঘরে থাকা উপকরণ দিয়ে ঝামেলা ছাড়াই খুব সহজে আপনি বানাতে পারবেন। চলুন সহজ রেসিপি জেনে নেওয়া যাক-
রেসিপি ১
উপকরণ
- আমলকি ১ কেজি
- চিনি হাফ কাপ
- সরিষার তেল ১ কাপ
- চিলি ফ্লেগস পরিমাণমতো
- বিটলবন পরিমাণমতো
- এলাচ ৩/৪টি
- দারুচিনি ২টি
- তেলপাতা ১টি
- মরিচের গুড়ো ১ চামচ
- হলুদের গুড়ো হাফ চামচ
আচারের মসলা তৈরির উপকরণ
- সরিষা ১ টেবিল চামচ
- রসুনের কোয়া ৪/৫টি
- কাচা মরিচ ৪/৫টি
- পাঁচফোড়ন হাফ টেবিল চামচ
- ভিনেগার ১ টেবিল চামচ
প্রস্তুত প্রণালী
প্রথমে আমলকি পানি দিয়ে ভালো ভাবে পরিষ্কার করে ধুয়ে নিতে হবে। এরপরে একটি পাত্রে আমলকি গুলো সিদ্ধ করে নিতে হবে। চুলার মিডিয়াম আচে ৫-১০ মিনিটের মতো সিদ্ধ হয়ে এলে কালারটি চেঞ্জ হয়ে আসবে। এবং একটি কাঠি দিয়ে চেক করে নিতে হবে। চুলা থেকে পানিয়ে পানি ঝারিয়ে নিতে হবে। এতে আমলকির মধ্যে যে কষ থাকে সেটি আর থাকবেনা। আমলকির ভিতরের বিচি আলাদা করে অন্য পাত্রে রেখে দিতে হবে। এরপরে সিদ্ধ করা আমলকি ডাল ঘুটনি দিয়ে ভালো করে চেপে ভেঙে নিতে হবে। আচারের জন্য একটি মসলা তৈরি করে নিতে হবে। আচারের মসলার জন্য উপকরণ রয়েছে সেগুলো একটি বাটিতে দিয়ে ভালো করে পেস্ট করে নিতে হবে।
মুখরোচক আচার তৈরিতে প্রয়োজনীয় আচার তৈরির মসলা ও এর ব্যবহার
আচার তৈরি করতে সরিষার তেল, শুকনো মরিচ, দারুচিনি, এলাচ ও তেজপাতা দিয়ে ভালো করে নেড়ে নিতে হবে। এই গরম মসলা আচারের মধ্যে ব্যবহার করলে এর স্বাদ বেড়ে যায়। কিছুক্ষণ ভেজে নেওয়ার পরে মসলা তৈরির জন্য রেডি করা পেস্ট দিয়ে দিতে হবে। এরপরে আরও কিছুক্ষণ নেড়ে ভেজে নিতে হবে। ভাজা হয়ে গেলে মরিচের গুড়ো, হলুদের গুড়ো দিতে হবে। এগুলো দিলে আচারের রং খুব সুন্দর হবে।
ম্যাশ করে নেওয়া আমলকি গুলো দিতে হবে। কেউ চাইলে আটি বা বিচিগুলো ফেলে না দিয়ে আচারের সাথে দিতে পারেন। চিনি দেওয়ার পরে চুলার আচ লো টু মিডিয়ামে রেখে সময় নিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। বেশ কিছুক্ষণ পরে আচারের রং চেঞ্জ হতে থাকলে বুৃঝতে হবে আচারটি প্রায় হয়ে এসেছে। চুলা থেকে নামানোর আগে একটু চিলি ফ্লেগস ও অল্প একটু বিটলবন দিয়ে নেড়ে নামিয়ে নিতে হবে। এরপরে ঠান্ডা করে সংরক্ষণের জন্য কাচের পাত্রে নামিয়ে নিতে পারেন।
রেসিপি ২
টক ঝাল মিষ্টি আস্ত আমলকির আচারের রেসিপি
উপকরণ
- ২৫০ গ্রাম আমলকি
- শুকনো মরিচ ৮টি
- পাঁচফোড়ন ১ চা চামচ
- সাদা সরিষা ১ চা চামচ
- তেঁতুল ২ টেবিল চামচ
- ভিনেগার ৩-৪ টেবিল চামচ
- সরিষার তেল হাফ কাপ
- হলুদের গুড়ো হাফ চা চামচ
- চিনি ১/৪ কাপ
প্রস্তুতপ্রাণালী
প্রথমে একটি প্যানে ৪টি শুকনো মরিচ, পাঁচফোড়ন দিয়ে একটু ভেজে নিতে হবে। ঠান্ডা করে টেলে নিতে হবে। অর্থাৎ একেবারে মিহি গুড়ো করা যাবে না। ২৫০গ্রাম ফ্রেশ আমলকি ধুয়ে একটি প্যানে পানি বসিয়ে সামান্য পরিমাণ লবন দিয়ে বলক তুলে নিতে হবে। তারপর আমলকি দিয়ে ৮০% সিদ্ধ করতে হবে। সেদ্ধ করার সময় লবন এড করলে আমলকির কষভাব দূর হয়ে যায়। চুলা থেকে নামিয়ে পানি ছেকে বা ঝরিয়ে নিতে হবে।
এবার আচার বানানোর জন্য ৪টি শুকনো মরিচ, ১ চা চামচ সাদা সরিষা( লাল সরিষা ব্যবহার করলে পরিমানে কমিয়ে দিতে হবে। ১ চা চামচ পাঁচফোড়ন, বড় দেখে ৪ কোয়া রসুন, ভিনেগার দিয়ে মসলা বেটে নিতে হবে। কখনোই পানি ব্যবহার করা যাবেনা। এতে আচারটি নষ্ট হয়ে যাবে তাড়াতাড়ি। তেতুলের কাঁথ তৈরির জন্য একটি বাটিতে তেঁতুল ও ভিনেগার একসাথে ভিজিয়ে নিতে হবে।
চুলায় একটি প্যান বসিয়ে হাফ কাপ সরিষার তেল দিতে হবে। একটু গরম হলে আচার তৈরির জন্য বেটে রাখা মসলা দিয়ে সামান্য একটু লবন এড করতে হবে। হলুদের গুলো। চুলার আঁচ মাঝারি করে মিনিট কয়েক মসলা কষিয়ে নিতে হবে। বেশি কষাতে গেলে মসলা পুড়ে যাবে। এর মধ্যে সেদ্ধ করে রাখা আমলকি গুলো দিতে হবে। (আমলকির আচার সেদ্ধ ছাড়াও তৈরি করা যায় তবে কষ ভাবটি থাকার কারণে আচারের স্বাদ অন্যরকম লাগতে পারে) এরপরে ৩-৪ মিনিট রান্নার করে নিতে হবে। ১/৪ কাপ পরিমান চিনি দিয়ে আবারও জ্বাল দিতে হবে। চিনির পানি শুকিয়ে গেলে, তেঁতুলের কাঁথ দিতে হবে। ভালোভাবে নেড়ে গুড়ো করে রাখা মসলা আচারের মাঝে দিতে হবে। ব্যস রেডি হয়ে গেলো আস্ত আমলকির টক ঝাল মিষ্টি স্বাদের আচার।
টক ঝাল মিষ্টি স্বাদের মজাদার কামরাঙার আচার ও এর রেসিপি
আমলকির পুষ্টিগুণ
পুষ্টিবিদদের মতে,
- আমলকীতে পেয়ারা ৩ গুণ
- কাগজি লেবুর চেয়ে ১০ গুণ
- আপেলের চেয়ে ১২০ গুণ
- আমের চেয়ে ২৪ গুণ
- কলার চেয়ে ৬০ গুণ
- বেশি ভিটামিন সি রয়েছে।
উইকিপিডিয়া তথ্য অনুসারে, একজন বয়স্ক লোকের প্রতিদিন ৩০ মিলিগ্রাম ভিটামিন সি দরকার হয়। প্রতিদিন দুইটি আমলকি খেয়ে এই ভিটামিন সি পাওয়া যায়।
আমলকির উপকারিতা
আমলকির অনেক স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। এটি নানান পুষ্টি ও ঔষধি গুণে ভরপুর। প্রতিদিন ১টি করে আমলকি খাওয়ার মাধ্যমে আমাদের শরীরকে সুস্থ রাখতে সাহায্য করে। রক্ত পরিশোদ্ধ ও ত্বকের ডিটক্স দূর করতে আমলকির জুড়ি নেই। আমলকি খেলে যেসকল পুষ্টিগুণ পাওয়া যায়, এটি আচার খেতেও কিছুপরিমানে পুষ্টিগুণ পাওয়া যাবে।
সর্দি-কাশি দূর করতে
সিজনাল সময় ও আবহাওয়া পরিবর্তনের কারণে সর্দি কাশিতে ভুগতে থাকেন অনেকে। আমলকির আচার খেতে সর্দি কাশির প্রকোপ থেকে রেহাই পাওয়া যাবে।
হজম ক্ষমতা বাড়াতে
আমলকী পেটের সমস্যা দূর করে, হজম শক্তি বাড়িয়ে তোলে। হজমের সমস্যা প্রতিরোধ করতে আমলকী বা এই আচারটি খেতে পারেন। এতে থাকা ফাইবার পেটের গোলযোগ দূর করে হজম ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সহায়তা করবে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে
আমলকিতে ভিটামিন সি রয়েছে, সেই সাথে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ার আমাদের শরীরকে রোগের হাতে থেকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করে। আমাদের দেহের ইমিউনিটি সিস্টেমকে শক্তিশালী করে তোলে। তাই নিয়ম করে এই আচারটি খাওয়া যেতে পারে।
ত্বকের স্বাস্থ্যে
নিয়মিত আমলকি খেলে আমাদের ত্বক হয়ে ওঠে উজ্জ্বল ও তারুন্যময়। কারণ এতে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে, যা আমাদের ত্বককে রক্ষা করতে সাহায্য করে।
চুলের স্বাস্থ্যে
শুরুতেই বলেছিলাম, চুলের পুষ্টির জন্য আমলকি কতটা কার্যকরী। আমলকির হেয়ার মাস্ক বা তেল ব্যবহারে চুলের বিভিন্ন সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়। এছাড়াও এই আচারটি খেলেও উপকারীতা পাওয়া যাবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে
আমলকিতে পলিফেনল ও ফ্ল্যাবোনয়েড নামক যৌগ রয়েছে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করতে সাহায্য করে। যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তারা চাইলে এটি নিয়মিত খেতে পারেন। এতে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে।
ওজন কমাতে সাহায্য
আমলকিতে উচ্চ ফাইবার থাকে যা আমাদের ক্ষুধা কমায়। বিপাক ক্রিয়া বাড়িয়ে তোলে। শরীরের ক্যালরি বার্ন করতে সাহায্য করে। তাই ওজন কমাতে নিয়মিত আমলকি খেতে পারেন।
কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে
আমলকি আমাদের শরীরের খারাপ কোলেস্টেরল কমিয়ে ও ভালো কোলেস্টেরল বাড়িয়ে কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। ফলে হৃদরোগের সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যায়।
উপরোক্ত আলোচনায় আমলকির আচার কি, আমলকির পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। যারা কাচা আমলকি খেতে পারেন না তারা সহজেই বাসায় তৈরি করতে পারেন সুস্বাদু আচার। যা সংরক্ষণ করতে পারবেন সারা বছর।