খাদ্য মানুষের মৌলিক চাহিদার মধ্যে অর্ন্তভুক্ত। বেঁচে থাকার জন্য আমরা দৈনিক খাবার গ্রহন করে থাকি। তবে শুধু খাদ্য খেলেই হবেনা। সু্স্থ জীবনযাপন করার জন্য প্রয়োজন পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ। এই পুষ্টি চাহিদা বয়সের সাথে পরিবর্তিত হতে থাকে। তাই বয়স অনুযায়ী মানুষের সঠিক পুষ্টিসমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহনের জন্য প্রয়োজন খাদ্য তালিকা। আজকের আর্টিকেলে শিশু, কিশোর-কিশোরী, প্রাপ্ত বয়স্ক ও বয়স্ক মানুষের খাদ্য তালিকা নিয়ে আলোচনা করবো।
শিশুর খাদ্য তালিকা
নিচে শিশুর খাদ্য তালিকা বর্ণনা করা হলো।
প্রথম ৬মাস
নবজাতক হতে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুদের জন্য মায়ের বুকের দুধ সর্বোত্তম। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) জন্মের এক ঘন্টা থেকে শুরু করে প্রথম ছয় মাস বয়স পর্যন্ত শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ানোর পরামর্শ দেয়। মায়ের বুকের দুধ ব্যতিত অন্য খাবার খাওয়া যাবে না।
শিশুরা বুকের দুধ থেকে প্রয়োজনীয় সকল পুষ্টি উপাদান পেয়ে থাকে। এজন্য দুধের উৎপাদন বজায় রাখতে বিভিন্ন ধরনের খাদ্য গ্রহন করা উচিত যাতে শিশু সকল পুষ্টি উপাদান সরবরাহ করতে পারে।
খাবারের ধরন
- শস্য: ভাত, রুচি, ওটমিল, যবের ছাতু ইত্যাদিতে শর্করা রয়েছে।
- দুগ্ধজাত খাবার: দই, দুধ, পনির।
- ফল ও শাকসবজি: বিভিন্ন ধরনের সবুজ শাকসবজি ও ফলমূল খেতে হবে।
- স্বাস্থ্যকর চর্বি: বাদাম, বীজ ও অ্যাভোকডোতে স্বাস্থ্যকর চর্বি রয়েছে।
- বিশুদ্ধ পানি: পর্যাপ্ত পরিমাণে নিরাপদ পানি পান করতে হবে। প্রতিদিন ৮-১০ গ্লাস
যেসকল খাবার খাওয়া যাবেনা
- ফাস্টফুড: বার্গার, পির্জা, স্যান্ডউইচ, পেস্ট্রি, কেক, বিস্কুট, শিঙাড়া, সমুচাসহ মুখরোচক খাবারগুলো এড়িয়ে চলা উচিত। এই ধরনের ফাস্টফুড খাবার গ্রহণ করার ফলে মায়ের স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলতে পারে। এতে দুধ পান করার ফলে শিশু পর্যাপ্ত পুষ্টি উপাদান সরবরাহে বেঘাত ঘটাতে পারে।
- কোমল পানীয়: এতে বিভিন্ন ধরনের রাসায়নিক ও কৃত্রিম চিনি ব্যবহার করা হয়। যা খাবার হজমে সাহায্য করে। হজমের জন্য ভালো মনে হলেও এটি প্রকৃত পক্ষে পাকস্থলী ভারসাম্য নষ্ট করে। তাই কোমল পানীয় খাওয়া খেতে বিরত থাকা উচিত।
আরও গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
- প্রতিদিন ৭-৮ ঘন্টা ঘুমাতে হবে।
- দিনে তিনবার খাবার গ্রহনের পাশাপাশি নাস্তা রাখা যেতে পারে।
- খাবার রান্নায় স্বাস্থ্যকর তেল ব্যবহার করতে হবে।
শিশুর ৬ মাস বয়স থেকে ১ বছর পর্যন্ত
একটি শিশুর ৬ মাস বয়স থেকে মায়ের দুধের পাশাপাশি বাড়তি খাবার খাওয়ানো শুরু করতে হবে। এভাবে ১ বছর পর্যন্ত সময়কালে শিশুর খাবারের প্রতি বিশেষ যত্ন নেওয়া প্রয়োজন।
বাচ্চাদের কি ঘি খাওয়া উচিত? ঘি এর উপকারিতা ও কোন ঘি ভালো?
স্বাস্থ্যকর খাবারের ধরনসমূহ
- সবজি: আলু, লাল শাক, মিষ্টি আলু, লাউ, শসা, ব্রকলি, পালং শাক, কুমড়ো ইত্যাদি।
- ফল: কলা, পেঁপে, আম, মাল্টা ইত্যাদি।
- মাংস: মুরগির মাংস, গরুর মাংস, মাছ ইত্যদি ।
- ডাল: মসুর ডাল, মুগ ডাল, ছোলা ডাল ইত্যাদি।
- শস্য: ভাত, গম, জাউ ইত্যাদি।
- ডিম: সপ্তাহের ২-৩টি ডিমের কুসুম।
- দুগ্ধজাত খাবার: দই, দুধ ইত্যাদি।
খাবার তৈরির পদ্ধতি
- এই সময়ে শিশুর খাবার নরম করে রান্নার করতে হবে।
- সবজি এবং ফল খুব ভালো করে ধুয়ে সেদ্ধ করে নিতে হবে। এরপরে ব্লেন্ড করে শিশুকে খাওয়াতে হবে।
- মাংস খাওয়ানোর ক্ষেত্রে অবশ্যই শিশুকে হাড় ছাড়া মাংস দিতে হবে। খুব নরম করে সেদ্ধ করতে হবে। তারপরে ব্লেন্ড করে শিশুকে খাওয়াতে হবে। কেউ চাইলে মসৃণ করে পিষে নিতে পারবেন।
- ভাত ও ডাল প্রথমে ধুয়ে সেদ্ধ করে বেল্ড করে নিতে হবে। অথবা ডাল ঘুটনি দিয়ে পিষে নিতে পারবেন। দানা যেনো না থাকে সেদিকটি নিশ্চিত হতে হবে।
- দুগ্ধজাত খাবারগুলো সরাসরি খাওয়ানো যাবে। এবং ডিম সিদ্ধ করে শুধু কুমুস অংশটি শিশুকে খাওয়াতে হবে।
১ থেকে ৫ বছর পর্যন্ত
এই সময় শিশুদের দৈহিক পরিবর্তন দেখা যায়। তাদের ওজন বাড়ে, উচ্চতা বৃদ্ধি পায়, হাড় শক্ত হয়, দাঁত উঠতে শুরু করে। এই সময়ে শিশুদের পুষ্টিকর খাবার দেওয়ার পাশাপাশি শারীরিক পরিশ্রম করতে শেখাতে হবে। যেমন লাফালাফি করা, দৌড়ানো, কোনো কিছু ধরতে শেখা ইত্যাদি।
পুষ্টিকর খাদ্যসমূহ
- মাছ মাংস দুধ ডিম সপ্তাহে ২ থেকে ৩ বার খাওয়াতে হবে।
- বিভিন্ন ফলমূল যেমন আম, কলা, পেয়ারা, আপেল ইত্যাদি প্রতিদিনের খাবার তালিকায় রাখা প্রয়োজন।
- ভাত, রুটি, পাউরুটি, ওটমিল খাওয়াতে হবে।
দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার
- মায়ের বুকের দুধ: ডক্টররা সাধারণত শিশুর ২ বছর বয়স পর্যন্ত মায়ের দুধ পান করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
- গরুর দুধ: একদম খাঁটি গরুর দুধ শিশুর ১২ মাস বসয় থেকে শুরু করা যেতে পারে।
- দুধ থেকে তৈরিকৃত খাবাকে দুগ্ধজাতীয় খাবার বলা হয়। যেমন দই, ছানা, পনির ইত্যাদি।
৬ থেকে ১২ বছর পর্যন্ত
এই সময় শিশুদের শরীরের গঠন বিকাশ হয়। মাংস পেশী শক্তিশালী করতে শুরু করে। তবে প্রচুর পুষ্টির প্রয়োজন হয়। তাদের জন্য খাবার তালিকায় যেসকল খাদ্য রাখা জরুরী।
শিশু থেকে বৃদ্ধ সকল বয়সীদের জন্য খুরমা খেজুরের উপকারিতা
- প্রোটিন: ডিম, মুরগী, দুধ, মাছ, ডাল। প্রোটিন যুক্ত খাবার দেহের মাংস পেশী শক্তিশালী করতে সাহায্য করে।
- ফলমূল ও সবজি: বিভিন্ন প্রকারের ফলমূল ও সবজি প্রতিদিন খেতে হবে। এতে প্রচুর ভিটামিন পাওয়া যায়।
কিশোর বয়সের খাদ্য তালিকা
নিচে কিশোর বয়সের ছেলে-মেয়েদের খাদ্য তালিকা দেওয়া হলো।
১৩-১৮ বছর বয়স পর্যন্ত
এই সময়কালকে কিশোর কিশোরীদের বিকাশেরর জন্য বিভিন্ন ধরনের পুষ্টিকর খাবার খাওয়া প্রয়োজন। প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, আয়রন, ভিটামিন ও খনিজ সমৃদ্ধ খাবার খাদ্যতালিকায় যুক্ত করতে হবে।
- বিভিন্ন ধরনের শাকসবজি ও ফল খেতে হবে।
- গরুর মাংস, মুরগির মাংস, হাঁসের মাংস, খাসির মাংস ইত্যাদি
- প্রতিদিন ১টি করে ডিম।
- দুধ ও দুগ্ধজাত খাবার যেমন দই, ছানা, পনির, মাখন ইত্যাদি খেতে হবে।
- বাদাম ও বীজ যেমন কাঠ বাদাম, কাজুবাদাম, পেস্তা বাদাম, চিনাবাদাম, আখরোট, সূর্যমুখী বীজ ইত্যাদি পরিমাণ মতো খেতে হবে।
- রুই মাছ, কাতলা, বোয়াল, চিংড়ী, তেলাপিয়া, ইলিশ, পুঁটি মাছ ইত্যাদি খেতে হবে।
কিছু নির্দেশনা
- প্রতিদিন নিয়ম করে ৩ বেলা খাবার গ্রহন করতে হবে।
- প্রচুর পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
- পুষ্টিকর খাবারের পাশাপাশি নিয়মিত ব্যায়াম করা প্রয়োজন।
- অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার ও ফাস্টফুড খাবার এড়িয়ে চলা উত্তম।
- পর্যাপ্ত ঘুমাতে হবে। রাত জাগা থেকে বিরত থাকতে হবে।
প্রাপ্তবয়স্কদের খাদ্য তালিকা
নিচে প্রাপ্তবয়স্কদের খাদ্য তালিকা বর্ণনা করা হলো।
১৯ থেকে ৫৯ বছর পর্যন্ত
- একজন প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তির দৈনিক ক্যালরি চাহিদা নির্ভর করে বয়স, লিঙ্গ, শারীরিক কার্যকলাপ ও স্বাস্থ্যের অবস্থার ওপর। সাধারণত পুরুষদের জন্য ২৫০০ থেকে ৩০০০ ক্যালরি ও মহিলাদের ২০০০-২৫০০ ক্যালরি খাবার গ্রহন করা প্রয়োজন।
- শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট শরীরের শক্তি যোগাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। দৈনিক খাবার থেকে আমরা শর্করা প্রায় ৪৫-৬৫শতাংশ পেয়ে থাকি। বাঙালি ৩ বেলা ভাত খেতে থাকেন। মূলত এই ভাত থেকে শর্করা পাওয়া যায়। এছাড়াও রুটি, গম, ওটমিল থেকেও পেয়ে থাকি।
- প্রোটিন জাতীয় খাদ্য আমাদের দেহের টিস্যু তৈরি করতে সাহায্য করে। মাংসপেশী বৃদ্ধি করে। দৈনিক খাবারের তালিকায় ১৫-৩৫শতাংশ প্রোটিন রাখা উচিত। প্রোটিনের মধ্যে ডাল, বাদাম, ডিম, মাছ, মাংস ইত্যাদি রয়েছে।
- আমাদের দেহে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যকর চর্বি থাকা দরকার। এটি শরীরের শক্তি জমা করে। তৈলাক্ত মাছ, বাদাম বীজ ও তেল থেকে স্বাস্থ্যকর চর্বি পাওয়া যায়।
- ক্যালসিয়াম হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে। সাধারণত দুধ ও দুগ্ধজাত খাবারে উচ্চমাত্রায় ক্যালসিয়াম রয়েছে।
- ভিটামিন ও খনিজ আমাদের শরীরের জন্য বেশ উপকারী উপাদান। দৈনিক খাবারের ভিটামিন ও খনিজ যুক্ত করা উচিত।
- এবং ৬০ বছর ও তার বেশি বয়স্কব্যাক্তিদের খাবারের তালিকা কিছুটা ভিন্ন। কারণ তাদের শরীরের কার্যকলাপ ও বিপাক কমে যায়। ফলমূল, সবুজ শাকসবজি, দুগ্ধজাত খাবার, শর্করা ইত্যাদি খাদ্য গ্রহন করতে হবে।
উপসংহার
সুস্থ ও সবল থাকার জন্য সঠিক পুষ্টি ও খাদ্যাভ্যাস থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বয়স অনুযায়ী খাদ্য তালিকা গ্রহণ করলে শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টিচাহিদা পুরণ হবে। শরীর সুস্থ থাকলে মনও ভালো থাকবে। এবং কাজে মনোযোগ বৃদ্ধি পাবে। এই আর্টিকেল পড়ার পড়ে আপনিও পরিবারের সদস্যদের বয়স ও পছন্দ অনুযায়ী সঠিক খাদ্যাভ্যাস গড়ে তোলতে পারবেন।