সাধারণত মায়ের কাছ থেকেই শিশুর শরীরে রোগ প্রতিরোধের শক্তি সরবরাহ হয়। অর্থাৎ শিশু যখন মায়ের গর্ভে থাকে, তখন শরীরে অ্যান্টিবডি সরবরাহ হয়। ফলে বাচ্চার জন্ম গ্রহনের পর কিছুদিন পর্যন্ত নানান রোগ জীবাণু থেকে রক্ষা পেয়ে থাকে। মূলত মায়ের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্তরের ওপর নির্ভর করেই শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লাভ করবে। এবং ভূমিষ্ট হওয়ার পর থেকেই বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা উন্নত হওয়ার প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায়।
সন্তান অসুস্থ হয়ে পরলে মায়ের অনেক দুঃশ্চিন্তা হয়। কোনো মা শিশুকে অসুস্থ অবস্থায় দেখতে চান না। তাই শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে বাড়ানোর জন্য অবশ্যই সতর্ক হতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমণে ভিটামিন, মিনারেল ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে এমন সকল খাবার খাওতে হবে। শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার দিকে বিশেষ নজর দিতে হবে। অন্যথায় বিভিন্ন রোগজীবাণু শরীরের বাসা বাধতে শুরু করবে। এতে শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাশে বাধাগ্রস্থ হয়ে যাবে। আজকের আর্টিকেলে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর কিছু কার্যকারী উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কি
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যাকে ইমিউনিটি সিস্টেম বলা যায়। এটি আমাদের শরীরকে বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা করতে সাহায্য করে। সহজে শরীরে রোগ বাসা বাধতে পারেনা। এই ইমিউনিটি সিস্টেম ক্যান্সারের মতো রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা পালন করে। তাই একটি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর জন্য আমাদের পদক্ষেপ নিতে হবে।
শিশুর রোগ প্রতিরোধ
শিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। তাই শিশুর খাবারের প্রতি যত্নশীল হতে হবে। এবং সঠিক পরিমাণে পুষ্টি নিশ্চিত করতে হবে। খাবারের পাশাপাশি শিশুর বাহ্যিক দিকগুলোতে বিশেষভাবে গুরুত্ব দিতে হবে। চলুন শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উপায়গুলো জেনে নেওয়া যাক-
স্তন্যপান
মায়ের বুকের দুধে এমন কিছু উপাদান রয়েছে যা একটি শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। শিশু স্তন্য দুধ পান করার ফলে প্রয়োজনীয় প্রোটিন, ফ্যাট, শর্করা, অ্যান্টিবড়ি পেয়ে থাকে। মূলত, শিশুর শরীরের প্রয়োজনীয় সকল ভিটামিন স্তন্যপানের মাধ্যমে পেয়ে থাকে।
ভ্যাকসিন
একটি শিশু জন্ম গ্রহণ করার পরে বিভিন্ন ধরনের টিকা/ ভ্যাকসিন দেওয়া হয়। ফলে জটিল কঠিন রোগ মোকাবিলার জন্য শিশু শরীরের প্রয়োজনীয় অ্যান্টিবড়ি গড়ে ওঠে। তাই শিশুকে যথাসময়ে ভ্যাকসিন দিতে হবে।
পর্যাপ্ত ঘুম
একটি শিশুর ঘুমের ঘাটতি থাকার ফলে সাইটোকিন্স নামক প্রোটিনের উৎপাদন কমে যায়। তাই শিশুকে পর্যাপ্ত ও ভালো ঘুমের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিদিন ৮-১০ ঘন্টা যথেষ্ট একটি শিশুর জন্য। এতে তাদের শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পাবে। এবং লক্ষ্য রাখতে হবে যেনো ঘুমানোর ২ ঘন্টা আগে কোনো ধরনের ডিভাইস ব্যবহার না করা।
খাদ্যাভ্যাস
শিশু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা পরিবর্তন হতে থাকে। এবং পুষ্টির চাহিদা বেড়ে যায়। এই সময়ে শিশুর সঠিক খাদ্যাভ্যাস থাকা প্রয়োজন। প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় সুষম খাবার রাখতে হবে। যা বাচ্চার শরীরে প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটাতে সাহায্য করবে। বিভিন্ন সংক্রমণের হাতে থেকে রেহায় পাবে।
মানসিক চাপ কমানো
শিশুর মানসিক স্বাস্থ্যের দিকেও বিশেষ নজর দিতে হবে। কারণ মানসিক চাপে থাকার কারণে তাদের স্বাস্থ্য খারাপ হতে শুরু করে। এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। তাই শিশু যেনো কোনোভাবে মানসিক চাপে না থাকে সেদিকটি নিশ্চিত করতে হবে।
সক্রিয় রাখতে হবে
একটি শিশুকে বিভিন্ন কর্মকাজে সক্রিয় রাখা জরুরী। যেমন খেলাধুলা করানো, হাঁটা বের হওয়া ইত্যাদি। নিয়মিত খেলাধুলা করলে তাদের শরীরের রক্ত চলাচল স্বাভাবিক থাকবে। যেসকল শিশুরা খেলাধুলা করে তাদের জন্য অবশ্যই পুষ্টিকর খাবার রাখতে হবে। এবং তাদের ঘুম ঠিক রাখতে হবে।
স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখতে হবে
একটি শিশুর বয়স বাড়ার সাথে সাথে যেনো সঠিক ওজন থাকে সেই দিকটি নিশ্চিত করতে হবে। কারণ বয়সের তুলনায় ওজন কম বা বেশি হলে বিভিন্ন রোগ বাসা বাধতে পারে।
পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা
শিশুকে সবসময় পরিষ্কার পরিবেশে রাখতে হবে। অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে রাখার ফলে শিশু দ্রুত অসুস্থ হয়ে পরতে পারে। শিশুর খেলার জায়গা, পোষাক ইত্যাদি যেনো পরিষ্কার থাকে সেই বিষয়ে সতর্ক হওয়া প্রয়োজন।
শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে খাবার
শিশুদের পুষ্টির বিষয়টি আমাদের অনেকের একটু বিপাকে পরতে হয়। যেমন অনেক বাচ্চারা দুধ ডিম খেতে চায় না। অথচ এসকল প্রোটিন খাবার না খাওয়ার ফলে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা লোপ পায়। তাই শিশুর খাবারের প্রতি বিশেষ নজর রাখতে হবে। এমন সব খাবার খাওয়াতে হবে যাতে রোগ প্রতিরোধ বেড়ে যায়। চলুন কিছু খাবার সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
সতেজ ফলমুল
আমাদের দেশে বিভিন্ন ধরনের মৌসুমি ফল পাওয়া যায়। যেমন আম, কাঠাল, কলা, পেয়ারা ইত্যাদি। এই ধরনের ফল থেকে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন পাওয়া যায়। যা খাওয়ার ফলে শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। শিশুর শরীর থাকে সুস্থ। তাই বাড়তি যত্নে খাবারের তালিকায় ফল ও রাখা যেতে পারে।
বাদাম
বাদাম রয়েছে স্বাস্থ্যকর চর্বি, অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ওমেগা -৩ ফ্যাটি অ্যাসিড। যা শিশুর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে। এমনকি শিশুর মস্তিষ্কের বিকাশে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে। তাই বাচ্চাদের তিন বেলা খাবারের পাশাপাশি বাদাম খাওয়ানো যেতে পারে।
সবুজ শাকসবজি
বাচ্চারা সাধারণত সবুজ শাকসবজি খেতে চায়না। তবে শাকসবজি শরীরের জন্য অনেক উপকারি। তাই ছোটথেকেই শিশুদের শাকসবজি খাওয়ার অভ্যাস করতে হবে। শিশুর প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় শাকসবজি রাখলে তাদের রোগপ্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।
দই
আমরা সকলেই জানি দই প্রোবায়োটিক সমৃদ্ধ একটি খাবার। এটি খেলে বাচ্চাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যায়। এবং দেহে উপস্থিত ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াগুলোকে ধ্বংস করে দেয়।
প্রোটিন
প্রোটিন জাতীয় খাবারগুলো মাংসপেশী বাড়াতে সাহায্য করে। একটি শিশুর দৈহিক বৃদ্ধির জন্য প্রোটিনযুক্ত খাবার প্রয়োজন হয়। কারণ প্রোটিনের ঘাটতি হলে বাচ্চাদের শিশুর শারীরিক ও মানসিক বিকাস সাধিত হয়না। প্রোটিন খাবারের মধ্যে ডিম দুধ মাছ মাংস অন্যতম।
ডিম
ডিমে প্রচুর প্রোটিন, ভিটামিন ও মিনারেলস পাওয়া যায়। এটি নিয়মিত শিশুকে খাওয়ানো উচিত। এতে তাদের শরীর সুস্থ থাকবে এবং রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে তুলবে।
মসলা
তরকারি স্বাদ বাড়ানোর জন্য রান্নায় আমরা মসলা ব্যবহার করে থাকি। যেমন আদা, হলুদ, রসুন ইত্যাদি। এই মসলাগুলো সংক্রমনের বিরুদ্ধে লড়াই করে। তাই শিশুর খাবারের অল্প মসলা ব্যবহার করে খাওয়ানো উচিত।
আয়রন
আয়রন সমৃদ্ধ খাবার শিশুদের শরীরে ইনফেকশনের বিরুদ্ধে লড়াই করতে সাহায্য করে। তাই শিশুকে অবশ্যই আয়রন সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ানো উচিত। যেমন ডিম, কলা ইত্যাদি।
ভিটামিন সি
ভিটামিন সি আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ভিটামিনের সি অভাব জনিত সমস্যা সমাধানের জন্য কমলা, লেবু ইত্যাদি খাবার শিশুকে দিতে হবে।
ভিটামিন বি৬
শিশুর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশারী করার জন্য ভিটামিন বি৬ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই যেসকল খাবারের ভিটামিন বি৬ রয়েছে। সেসকল খাবার শিশুকে খাওয়ানো উচিত।
জিঙ্ক
শরীরের নতুন কোষ ও এনজাইম তৈরি করাতে সাহায্য করে জিঙ্ক। সেই সাথে হজমশক্তি বাড়িয়ে তোলে। দুগ্ধজাত পন্যের প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক থাকে। তাই শিশুকে পর্যাপ্ত পরিমাণে জিঙ্ক সমৃদ্ধ খাবার দিতে হবে।
উপরোক্ত আলোচনায় শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারলাম। শিশুর রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এমন ভাবে বাড়ানো প্রয়োজন যাতে বারবার অসুস্থ না হয়। সেক্ষেত্রে সঠিক পুষ্টি সরবরাহ করা অন্যন্ত জরুরি। পরিবারের শিশুদের ইউমিনিটি সিস্টেম বৃদ্ধি করতে আমাদের সকলের বিশেষ নজরে রাখতে হবে। ফলে একটি শিশুর স্বাভাবিক বিকাশ উন্নত হবে।