খাবারে বিষক্রিয়া আমাদের দেশের একটি সাধারণ সমস্যা। যদিও এই সমস্যা বেশিদিন স্থায়ী থাকে না। তবে খাদ্য বিষক্রিয়া হওয়ার ফলে আমাদের শরীর দুর্বল হয়ে পরে তাই খাবার হতে আমাদের খাবারে বিষক্রিয়া রোধ করতে আমাদেরকে সচেতন হতে হবে।
খাবার গ্রহণ করা একান্ত জরুরী। খাবার খাওয়ার ফলে আমরা সুস্থ থাকি। কাজ করার শক্তি পাই। তবে খাবার গ্রহণের বিষয়ে আমাদের সর্তক হতে হবে। কারণ খাবার হতে খাবারের বিষক্রিয়া দেখা যায়। কিভাবে খাদ্য বিষক্রিয়া রোধ করবেন তা হয়তো অনেকেরই অজানা। আজকের আর্টিকেলে খাবারের বিষক্রিয়া রোধ করার কিছু সহজ উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
খাদ্য বিষক্রিয়া
খাদ্য বিষক্রিয়ার ইংরেজি শব্দ ফুড পয়েজিং (Food Poisoning)। খাদ্যজনিত অসুস্থতাকে খাদ্য বিষক্রিয়া বলা হয়। মূলত পরিষ্কার পরিচ্ছন্নভাবে, সঠিক নিয়মে ও নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় খাবার প্রস্তুত না করার ফলে খাবারে বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া সংক্রমণ হয়। এই ধরনের খাবার খেয়ে খাদ্য বিষক্রিয়া শুরু হয়ে যায়। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বাহিরের দূষিত,নোংরা পরিবেশে তৈরি খাদ্য গ্রহনের ফলে খাদ্য বিষক্রিয়া বা ফুড পয়জনিং হয়ে থাকে।
খাবারের বিষক্রিয়ার হওয়ার কিছু লক্ষণ বমি বমি ভাব দেখা যায়, পেটে ব্যাথা শুরু হয়, গ্যাসের সমস্যা দেখা দেয়, জ্বর হয়, দুর্বল ও অনেক ক্লান্ত অনুভব হয়, ডায়রিয়া বা পানিশূণ্যতা দেখা দিতে পারে। শিশু ও বয়স্কদের তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম থাকায় তাদের ক্ষেত্রে খাবারের বিষক্রিয়ার ঝুঁকি বেশি। এমনকি গর্ভবতী নারীদের ক্ষেত্রেও এটি দেখা যায়। সমস্যা বেশি হলে জটিলতাও বেশি হয়। যা কিডনির সমস্যা সৃষ্টি করে।
খাবারে বিষক্রিয়া রোধ করার উপায়
খাদ্য বিষক্রিয়া বা ফুড পয়েজিং প্রতিরোধ করতে মেনে চলুন কিছু উপায়। ফলে আপনি ও পরিবারের অন্য সদস্যরাও সুস্থ থাকবে। চলুন জেনে নেওয়া যাক-
হাত পরিষ্কার
খাবার প্রস্তুত করার আগে অবশ্যই হাত পরিষ্কার রাখতে হবে। অনেকের বাসায় পোষা প্রানী রয়েছে। তাদের ধরার পর অবশ্যই হাত সাবান দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। না হলে সেই হাত দিয়ে খাবার খেলে খাদ্য বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। টয়লেট থেকে ফিরে বা ময়লা ফেলার পরে হাত ধুয়ে নিয়ে হবে।
প্যাকেটজাত খাবার
প্যাকেটের খাবারে তারিখ দেওয়া থাকে। সেই নির্ধারিত তারিখ শেষ হওয়ার আগেই খাবার খেয়ে ফেলতে হবে। মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার খেলে ফুড পয়েজিং হতে পারে। এছাড়াও অনেক সময় দোকানে মেয়াদ উত্তীর্ণ খাবার সেল করে, তাই দোকান থেকে কেনার আগে অবশ্যই তারিখ দেখে নিতে হবে।
নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় খাবার সংরক্ষণ
খাবারের ধরন বুঝে নির্দিষ্ট তাপমাত্রায় সংরক্ষণ করতে হবে। বিশেষ করে দুগ্ধজাত খাবারগুলো অতিরিক্ত গরমে দ্রুত নষ্ট হয়ে যায়। তাই রান্না করার ১ দিনের মধ্যে খেয়ে ফেলা উচিত। খাবার রান্নার পর ৪ডিগ্রি থেকে ৬০ডিগ্রি তাপমাত্রার ভেতর রাখলে খাবারে ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা মারাত্মক আকারে বৃদ্ধি পায়।
খুব ভালো করে সেদ্ধ করা
রান্না করার সময় খাবার যেনো খুব ভালোভাবে সেদ্ধ হয় সেই বিষয়টি নিশ্চিত হতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে কোনো ভাবেই যেনো কাচা ভাব না থাকে। কারণ আধা সেদ্ধ হওয়া খাবার খাওয়া উচিত না।
ভালোকরে গরম করা
অনেক সময় আমরা খাবার ফ্রিজে রেখে দেই। পরবর্তীতে আমরা ফ্রিজ থেকে খাবার বের করে গরম করে খাই। খাবার গরম করার সময় ভালোভাবে গরম করে নিতে হবে। ঠান্ডা খাবারে ব্যাকটেরিয়া থাকতে পারে।
সুস্থ থাকা এখন আর কঠিন নয়- জেনে নিন পুষ্টিকর খাদ্য তালিকা
বাইরের খাবারের পরিবেশ
বাইরের বা রেস্টুরেন্টে খাবার খাওয়ার আগে কেমন পরিবেশে খাবার তৈরি হচ্ছে সেই বিষয়টি খোঁজ নিতে হবে। বাইরের অপরিচ্ছন্ন পরিবেশের খাবার খেলে ফুড পয়েজিং হওয়ার সম্ভবনা সবচেয়ে বেশি হয়।
রান্না ঘর পরিষ্কার
রান্নার ঘর পরিষ্কার থাকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। রান্নার ঘর থেকেই খাবারে ব্যাকটেরিয়া সংক্রামিত হয়। তাই খাবার রান্নার করার পরে সেই স্থানটি নিয়মিত পরিষ্কার করে রাখতে হবে। এছাড়াও রান্নাঘরের অন্যান্য আসবাবপত্র পরিষ্কার পরিচ্ছিন্ন রাখা জরুরী।
প্রস্তুত করার স্থান
খাবার প্রস্তুত করার স্থানটি নিয়মিত গরম পানি ও সাবান দিয়ে ধুয়ে পরিষ্কার রাখতে হবে। অন্যথায় সেই স্থানটি যদি অপরিষ্কার থাকে তাহলে খাবার প্রস্তুতের সময় ব্যাকটেরিয়ার সৃষ্টি হতে পারে।
ব্যবহৃত জিনিপত্র
খাবার প্রস্তুত করার সময় পাত্রগুলো অবশ্যই পরিষ্কার রাখতে হবে। এমনকি পরিবেশনের সময় পরিষ্কার পাত্রে খাবার পরিবেশন করতে হবে। অর্থাৎ প্রস্তুত করা থেকে পরিবেশন পর্যন্ত ব্যবহৃত জিনিসপত্র গুলো পরিষ্কার রাখা একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। অপরিষ্কার পাত্রে খাবার খেলেও হতে পারে নানার রোগ।
ফ্রিজের খাবার খাওয়ার নিয়ম
ফ্রিজে আমরা খাবার সংরক্ষণ করে থাকি। কিন্তু আমরা অনেকেই ফ্রিজে কোন খাবার কতদিন সংরক্ষণ করতে হবে সেই সম্পর্কে অবগত না। অনেকদিন ফ্রিজে রাখা খাবারে ব্যাকটেরিয়া জন্ম নেয়। আর এই ধরনের খাবার খেতে পেটে বিভিন্ন অসুখ হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
নষ্ট গন্ধযুক্ত খাবার পরিহার
বাসি খাবার যতটা সম্ভব পরিহার করা উচিত। কারণ বাসি খাবারগুলো নষ্ট হয়ে গন্ধ হয়ে যায়। এই খাবার খেলে অবশ্যই ফুড পয়েজিং হবে। তাই নষ্ট গন্ধযুক্ত খাবার পরিহার করা উচিত।
সঠিক ভাবে খাবার সংরক্ষণ
কাচা শাক সবজি ও রান্না করা খাবার ফ্রিজে সংরক্ষণে করার সময় অবশ্যই আলাদাভাবে রাখতে হবে। একসাথে রাখলে খাবারের জীবাণু তাড়াতাড়ি ছড়িয়ে পরতে পারে। তাই ফ্রিজে খাবার সংরক্ষনের সময় ফ্রিজের তাপমাত্রার দিকেও বিশেষ নজর রাখতে হবে। খাদ্য বিষক্রিয়া এড়াতে সবচেয়ে সহজ উপায়গুলো মধ্যে অন্যতম হলো সঠিক ভাবে খাবার সংরক্ষণ করা।
মাছ মাংস
বাজার থেকে মাছ মাংস আনার পরে ভালোভাবে দ্রুত ধুয়ে নিতে হবে। তারপরে ফ্রিজে রাখতে হবে সংরক্ষনের জন্য অথবা রান্নার করে ফেলতে হবে। রান্নার সময় ভালো করে সেদ্ধ করে রান্না করতে হবে।
রান্না করা খাবার
রান্না করা খাবার তাড়াতাড়ি খেয়ে নেওয়া ভালো। তবে সংরক্ষন করতে চাইলে অবশ্যই ফ্রিজে ঢাকনাযুক্ত পাত্রে সংরক্ষন করতে হবে। অন্যথায় খাবারে জীবাণু ছড়াতে পারে।
শাক সবজি ও ফলমূল পরিষ্কার
বাজার থেকে শাক সবজি ও ফলমূল কিনে বাসায় এসে খুব ভালোভাবে পরিষ্কার করতে হবে। পানি ভর্তি বালতি বা বড় গামলাতে রেখে ভালো করে ঘষে ঘষে ধুয়ে পরিষ্কার করে নিতে হবে। অনেক সময় ফলমূলে মাটি লেগে থাকে, এতে ভাইরাস থাকতে পারে যা খাবারে বিষক্রিয়ার কারণ হতে পারে।
খাদ্য বিষক্রিয়া হলে ঘরোয়া প্রতিকার-
ফুড পয়েজনিং হলে ঘরোয়াভাবে প্রতিকার করা সম্ভব। চলুন জেনে নেওয়া যাক-
- আদা কুঁচি করে খেতে পারেন। সাথে কয়েকফোঁটা মধু দিয়ে এই আদা কুঁচি খাওয়া যাবে। এতে পেট ফাপা কমে পেট ব্যাথা দূর হয় ও হজমশক্তি বৃদ্ধি পায়।
- কাঁচা খাবারে সর্তক থাকতে হবে। কম সেদ্ধ হওয়া খাবার পরিহার করতে হবে।
- খাবার খাওয়ার আগে হাত ধুয়ে নিতে হবে।
- কলা খাওয়া যেতে পারে, কারণ এতে প্রচুর পটাশিয়াম থাকে যা খাদ্য বিষক্রিয়া কমাতে সাহায্য করে।
- তুলসীপাতার রসের সাথে মধু মিশিয়ে খেলেও প্রতিকার পাওয়া যায়।
- লেবুর রস ব্যাকটেরিয়ার প্রভাব নষ্ট করতে সাহায্য করে। সেক্ষেত্রে লেবুর রস খাওয়া যেতে পারে।
- খাদ্য বিষক্রিয়া হলে ডিহাউড্রেশনের সমস্যা দেখা দিতে পারে। তাই প্রচুর পরিমানে পানি পান করতে হবে।
- ফুড পয়েজনিং এর প্রভাব খুব বেশি দেখা দিলে অবশ্যই বিশেষজ্ঞ এর সাথে পরার্মশ নিতে হবে।
- খাদ্য বিষক্রিয়া হলে সুস্থ না হওয়া পর্যন্ত যথেষ্ট বিশ্রাম নিতে হবে।
- নরম, তরল পুষ্টিকর খাবার গ্রহণ করতে হবে। কঠিন খাবারগুলো এড়িয়ে চলাই ভালো।
উপরোক্ত আলোচনায় খাদ্য বিষক্রিয়া রোধ করার উপায় ও ঘরোয়াভাবে প্রতিকারের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত তুলে ধরা হয়েছে। খাদ্য বিষক্রিয়া পরিচিত একটি সমস্যা। এই সমস্যা থেকেও জটিল সমস্যা হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই আমাদের সকলকে খাবার গ্রহনের বিষয়ে সচেতন হতে হবে।