নারিকেলের শাস থেকে নিষ্কাশিত তরল পদার্থ হলো নারিকেল তেল। চুলের যত্নে নারিকেল তেলের ব্যবহার আমাদের কারোর অজানা নয়। তবে এই তেলের পুষ্টগুণ সম্পর্কে হয়তো আমরা অনেকেই অবগত নই। এই তেলে অনেক পুষ্টিগুন রয়েছে যা শুধু চুলের জন্যই নয়, স্বাস্থ্য ও ত্বকের জন্য বেশ উপকারী।
নারিকেল তেল আমাদের দৈন্দিন জীবনে গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদন। এই তেলকে সুপারফুড হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এতে বহুগুণ স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। এটি মস্তিষ্কের কার্যক্রম ভালো রাখতে সাহায্য করে। খাঁটি নারিকেল তেল কিটো ডায়েট করতে রান্নায় ব্যবহার করা যেতে পারে। আজকের আর্টিকেলে নারিকেল তেলের পুষ্টিগুণ ও উপকারীতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হবে। চলুন জেনে নেওয়া যাক-
নারিকেল তেলের পুষ্টিগুণ
নারিকেলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে উইকিপিডিয়া তথ্যসূত্রে পাওয়ার যায়, এই তেলের মধ্যে ৯৯% ফ্যাট যার প্রধান অংশই সম্পৃক্ত চর্বি। ১০০ গ্রাম নারিকেল তেলে ৮৯০ ক্যালোরি পাওয়া যায়। সম্পৃক্ত চর্বিকে স্যাচুরেটেড ফ্যাড বলা হয়। আর এটির অর্ধেকটা হচ্ছে লরিক এসিড। এবং অন্যান্য স্যাচুরেটেড ফ্যাটের মধ্যে থাকে মাইরিস্টোলেইক এসিড ও পামিটোলেইক এসিড। মোট ফ্যাটের ৮২% স্যাচুরেডেট ফ্যাট, ৬% মনোস্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ২% পলস্যাচুরেটেড ফ্যাট। এই তেলে ফাইটোিস্টেরল থাকে। এছাড়াও মাঝারি চেইন ট্রাইগ্লিসারাইড ও উদ্ভিজ্জ প্রোটিন রয়েছে।
১ টেবিল চামচ নারিকেল তেলের পুষ্টিগুণ
- ক্যালোরি ১১৭
- মোট ফ্যাট ১৪গ্রাম
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট ১২গ্রাম
ক্যালোরি
ক্যালোরি হলো শক্তির একক। সাধারণত খাবারের শক্তির পরিমাণ নির্দেশ করতে ক্যালোরি শব্দটি ব্যবহৃত হয়ে থাকে। একজন মানুষ কোন খাবার থেকে কি পরিমাণ শক্তি পাচ্ছে তা পরিমাপ করতেই ক্যালোরি ব্যবহার করা হয়। কেউ যদি ১ টেবিল চামচ নাারিকেল তেল গ্রহণ করেন তাহলে ১১৭ ক্যালোরি পেয়ে যাবেন।
ফ্যাট বা চর্বি
চর্বি কথা টা শুনতেই কেমন জানি ভয়ংকর শব্দ মনে হচ্ছে । তার করণ হল চর্বি বলতে আমরা সাধারণত মেয়াদ বা যাকে পাতি বাংলা ভাষায় ভূরি বলা হয় আর এইটে কেই বুঝি। তাই চর্বি কথাটা শুনলে এতো টা ভয়ংকর আমাদের কাছে। কিন্তু এই ধারণা ভুল। আমাদের দেহে প্রয়োজনীয় পুষ্টিউপাদানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ফ্যাট বা চর্বি। আমাদের মস্তিষ্কের শতকরা ৬০% ফ্যাট রয়েছে। সাধারণত চর্বি কঠিন অবস্থায় থাকে। আর চর্বি বা ফ্যাট উভয়েই ট্রাইগ্লিসেরাইড নামক পর্দাথ দিয়ে গঠিত। নারিকেলে বিদ্যামন মোট ফ্যাট ১ টেবিল চামচে প্রায় ১৪ গ্রাম পাওয়া যায়।
স্যাচুরেটেড ফ্যাট
সাধারণত ফ্যাট দুই ধরনের হয়ে থাকে, স্যাচুরেটেড ও আনস্যাচুরেটেড। স্যাচুরেটেড ফ্যাটকে সম্পৃক্ত চর্বি বলা হয়। এবং আনস্যাচুরেটেড ফ্যাটকে অসম্পৃক্ত চর্বি বলা হয়।
নারিকেল তেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের উপস্থিতি অনেক। ১ টেবিল চামচ নারিকেল তেল থেকে প্রায় ১২গ্রাম স্যাচুরেটেড ফ্যাট পাওয়া যায়।
নারিকেল তেলের উপকারিতা
নানান পুষ্টিউপাদান সমৃদ্ধ নারিকেল তেলের উপকারিতা অনেক। চলুন নারিকেল তেলের পুষ্টি উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
ওজন কমাতে
লরিক এসিড এক ধরনের স্যচুরেটেড ফ্যাট যা নারিকেল তেলের মধ্যে পাওয়া যায়। এই তেলে সর্বোচ্চ মাত্রায় লরিক এসিড থাকে। যা লিভারে যায় ও শরীরের শক্তিতে রুপান্তরিত হয়। সরাসরি ওজন না কমালেও অতিরিক্ত ফ্যাট বার্ন করে দেহের ওজন নিয়ন্ত্রণ করতে বেশ কার্যকরী।
দেহে শক্তি জোগায়
নারিকেল তেলে বিদ্যমান মাঝারি চেইন ট্রাইগ্লিসারাইড দেহের শক্তি জোগাতে সাহায্য করে। এটি সরাসরি লিভারে যায় এবং কার্বোহাইড্রেটের মতোই দেহের শক্তিতে পরিণত হয়। তাই দেহের শক্তি জোগাতে এই তেলটি খাবারের ব্যবহার করতে পারেন।
ত্বকের যত্নে
খাঁটি নারিকেল তেল খাওয়ার পাশাপাশি ত্বকের যত্নে ব্যবহার করা হয়। এতে ত্বকের আর্দ্রতাকে ধরে রাখতে সাহায্য করে। ত্বককে কোমল ও নরম রাখতে আপনিও খাঁটি নারিকেল তেল ব্যবহার করতে পারেন।
চুলের যত্নে
আদিমকাল থেকেই চুলের যত্নে নারিকেল তেলের ব্যবহার বেশ জনপ্রিয়। এটি চুলের গভীরে পৌঁছে চুলকে মজবুত করতে সাহায্য করে। যাদের চুল পড়ার সমস্যা আছে তারা খাঁটি নারিকেল তেল ব্যবহার করতে পারেন। যা আপনার চুল পড়া রোধ করে চুলকে ঝলমলে করে তুলবে।
ত্বকের বলিরেখা কমাতে
বয়সের সাথে সাথে আমাদের ত্বকে বলিরেখা দেখা যায়। অর্থাৎ মুখের বয়সের একটা ছাপ পরতে শুরু করে। নারিকেল তেলে উচ্চ মাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিন ই রয়েছে যা ত্বকের বলিরেখা কমাতে সাহায্য করে এবং ত্বকের তারুণ্য ও লাবন্য ধরে রাখতে বেশি উপকারী।
ক্ষুধা কমাতে সাহায্য করে
নারিকেল তেলে মাঝারি চেইন ট্রাইগ্লিসারাইড থাকে। এটি খেলে দীর্ঘসময় ধরে পেট ভরা রাখতে সাহায্য করে। যারা ডায়েট করেন তাদের জন্য এই তেল অনেক উপকারী। এটি খাওয়ার পরে সহজকে ক্ষুধা লাগে না। এবং বাড়তি খাবার গ্রহণের ইচ্ছা হয়না। এই তেল আপনার ক্ষুধা কমিয়ে দিতে সাহায্য করবে। পাশাপাশি ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে ভূমিকা রাখে।
সংক্রমন প্রতিরোধ করে
নারিকেল তেলের ফ্যাটি এসিডে অর্ধেক লরিক এসিড থাকে। যা বিভিন্ন ধরনের ব্যাকটেরিয়fর ও ভাইরাসকে দূর করে সংক্রমন প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে।
হৃদরোগর ঝুঁকি কমাতে
নারিকেলে স্যাচুরেটেড ফ্যাটের উপস্থিতি বেশি হওয়ায় অনেকেই মনে করেন এটি হার্টের জন্য ভালো নয়। কিন্তু গবেষকরা বলছেন এই তেল হার্টের জন্য ক্ষতিকর নয়। এতে লরিক এসিড রয়েছে যা হার্টকে সুস্থ রাখে এবং হৃদরোগ হওয়া থেকে প্রতিরোধ করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়
এতে থাকা লরিক, ক্যাপরিক, ক্যাপরিলিক, অ্যান্টিমাইক্রোবাই এসিড যার মধ্যে অনেক রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। তাই প্রতিদিন পরিমিত পরিমাণে নারিকেল তেল খেলে শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়তে পারে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে
রক্তে শর্করার মাত্রা বেড়ে গেলে ডায়াবেটিস রোগটি দেখা হয়ে থাকে। নারিকেল তেল রক্তের শর্করা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। তাই যাদের ডায়াবেটিস রয়েছে তারা নিময় করে তেলটি রান্নায় ব্যবহার করে খেতে পারেন।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণে
ক্ষতিকর কোলেস্টেরলে কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরলে বাড়াতে নারিকেল তেল খেতে পারেন। যা আপনার কোলেস্টেরল মাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখতে সাহায্য করবে। এবং হৃদরোগের ঝুঁকি কমাতে বেশ সহায়ক।
নারিকেল তেলের ব্যবহার
এই তেল বাহ্যিক ব্যবহারের পাশাপাশি সরাসরি খাওয়াও যায়। তবে খাঁটি নারিকেল তেল বা ভার্জিন গ্রেট নারিকেল তেল বাছাই করে গ্রহন করতে হবে। বাজারের সাধারণ তেল ভুলেও খাওয়া যাবেনা। নারিকেল তেলের কিছু ব্যবহার সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো-
- প্রতিদিন খাবারে ২ টেবিল চামচ নারিকেল তেল যোগ করা যাবে। যা আপনার অতিরিক্ত ফ্যাট বার্ন করতে সাহায্য করবে। এমনকি হজমে সাহায্য করবে।
- নারিকেল তেল দিয়ে ডিম পোচ করতে পারেন, এছাড়াও চকলেট তৈরিতে ব্যবহার করা যাবে।
- এই তেল ঠোঁটে লিপবাম হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। এতে ঠোঁট ফাকা দূর হয়।
- বেকিং করার সময় এই নারিকেল তেল ব্যবহার করতে পারেন। যেমন কেক।
- মেকআপ রিমুভার হিসেবেও এই নারিকেল তেল ব্যবহার করতে পারেন। তবে ত্বকে ব্যবহারের আগে অবশ্যই প্যাচ টেস্ট করে নিতে হবে।
- পায়ের গোড়ালি ফাটার সমস্যা দূর করতে এই তেল গোড়ালিতে ব্যবহার করতে পারেন।
- ঘামের দুর্গন্ধ দূর করতে নারিকেল তেল কিছু পরিমাণে বগলে লাগাতে পারেন। এতে বিদ্যমান উপাদান ঘাম শুষে নিয়ে দুর্গন্ধ হওয়া রোধ করতে সাহায্য করে।
- চোখের ভ্রু ঘন ও কালো করতে এই তেল ব্যবহার করলে উপকার পাওয়া যায়।
- মুখের দুর্গন্ধ দূর করতে মাউথওয়াশের মতো কুচকুচি করা যেতে পারে।
উপরিক্ত আলোচনায় নারিকেল তেলের পুষ্টিগুণ, উপকারিতা ও ব্যবহারের উপায় সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করছি এই তেলের পুষ্টিগুণ সম্পর্কে জানার পরে আপনার নিত্যদিনের সঙ্গি হিসেবে এই তেলটিকে বেছে নিতে পারেন। যা আপনার অনেক উপকারে আসবে।