গাওয়া ঘি এর উপকারিতা সম্পর্কে জানার আগে, আমাদের জানতে হবে গাওয়া ঘি আসলে কী? ছোটবেলায় মায়ের হাতে ঘি আর ভর্তা মাখানো ভাত খেয়েছেন? একদিকে ঘি এর অপূর্ব ঘ্রান ও স্বাদ, সেই সাথে মায়ের মমতায় ভরা হাতের স্পর্শে মাখানো ভাত। আহা! এই খাবারের স্বাদ কখনোই ভোলার মতো না। ছোটবেলা থেকেই ঘি আমার সবচেয়ে পছন্দের একটি খাবার। তাই মা সময় পেলেই নিজ হাতে ঘি বানাতেন।
মায়ের পাশে বসে থেকে সেই ঘি বানানোর পুরো প্রক্রিয়া দেখতাম আর অপেক্ষা করতাম কখন মজাদার ঘি খেতে পারবো। সময় বদলেছে। আম্মার ও বয়স হয়েছে। এখন আর চাইলেই আগের মতো আমাকে ঘি বানিয়ে দিতে পারেন না। তাই বাজার থেকে কেনা ঘি ই এখন আমার আস্থার জায়গা। বাজারে অনেক ভ্যারিয়েন্ট এর ঘি পাওয়া যায়। তবে গুনে মানে সেরা ঘি হলো গাওয়া ঘি। আজ আমরা এই গাওয়া ঘি কী? কীভাবে খাবেন এবং খেলে কি কি উপকারিতা পাবেন সেই সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
গাওয়া ঘি কী
ঘি হলো পৃথিবীর অন্যতম বিশুদ্ধ খাবার। আর সকল ঘি এর মাঝে ঘ্রানে ও স্বাদে সেরা ঘি হলো গাওয়া ঘি। সহজ ভাবে বলতে গেলে চুলায় দুধ জ্বাল করে সেটি থেকে স্বর সংগ্রহ করে যেই ঘি তৈরি করা হয় তাকে গাওয়া ঘি বলে। স্বর থেকে ঘি তৈরি করা হয় জন্য গাওয়া ঘি এর আরেক নাম স্বরের ঘি।
গাওয়া ঘি এর পুষ্টি উপাদান
ঘি তৈরি করা হয় খাটি দুধ থেকে। ঘি তে রয়েছে, ভিটামিন A, ভিটামিন E, ভিটামিন K, এন্টিঅক্সিডেন্ট, ব্রেইন ট্রনিক, ফ্যাটি এসিড, বাটাইরিক এসিড, ওমেগা থ্রি ফ্যাটি এসিড, কনজুগেটেড লিলোনিক এসিড, ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম, ফসফরাস, জিংক, আয়রন স্যাচুরেটেড ফ্যাট সহ আরও অনেক পুষ্টি উপাদান যা আমাদের শরীরের জণ্য অনেক উপকারি।
গাওয়া ঘি এর উপকারিতা
গাওয়া ঘি আমাদের শরীরের জণ্য অনেক উপকারি। এটিকে অনেকেই সুপারফুডের সাথে তুলনা করে থাকেন। নিয়মিত পরিমিত পরিমানে ঘি খেলে এটি আপনার শরীর কে সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করবে।
রক্ত জমাট বাধতে সাহায্য করে
ঘি তে রয়েছে ভিটামিন কে, যা আমাদের শরীরে রক্ত জমাট বাধতে সাহায্য করে এবং হাড় শক্ত করতেও সাহায্য করে।
হজমে সাহায্য করে
ঘি তে রয়েছে বাটাইরিক এসিড যা আমাদের হজম ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
দৃষ্টিশক্তি বাড়াতে সাহায্য করে
ঘি ত্তে থাকা ভিটামিন A আমাদের চোখের স্বাস্থ্য ভালো রাখে। এছাড়া ঘি তে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন A থাকার কারনে এটি আমাদের শরীরের বিভিন্ন অর্গান সুস্থ্য রাখে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে
ঘি তে রয়েছে বিউটারিক এসিড, যা আমাদের শরীরে T কোষ তৈরি করে। এই কোষ টি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে।
লিভার সুস্থ্য রাখে
ঘি তে থাকা ভিটামিন E এবং ভিটামিন A লিভার কে সুস্থ্য রাখতে সাহায্য করে। এছাড়া এটি শরীরের হরমোন কে ব্যালেন্স রাখে।
ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে সাহায্য করে
ঘি তে রয়েছে ক্যান্সার বিরোধি উপাদান, মুলত ঘি তে থাকা বিউটারিক এসিড আমাদের শরীরে এন্টি ক্যান্সার উপাদান হিসেবে কাজ করে।নিয়মিত ঘি খেলে যকৃত ক্যান্সার এর হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। মুলত যকৃতে ক্যান্সার এর কারন হলো ক্ষতিকর একটি এনজাইম। ঘি খেলে এটি আমাদের অন্ত্রে সেই এনজাইম এর উৎপাদন কমিয়ে আনে। ফলে এটি ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
থাইরয়েডের কর্মহীনতা নিয়ন্ত্রন করে
ঘি আমাদের শরীরে হরমোনের ভারসম্য বজায় রাখে। ফলে এটি থাইরয়েডের কর্মহীনতার জ্ন্য সহায়ক।
অনিয়মিত মাসিকের সমস্যা দূর করে
যেহেতু ঘি আমাদের শরীরের হরমোনের ব্যালেন্স করে থাকে তাই যারা পিএমএস এবং অনিয়মিত মাসিকের সমস্যায় ভুগছেন তারা চাইলে নিয়মিত ঘি খেতে পারেন।
খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করে
ঘি এর অপূর্ব স্বাদ ও ঘ্রানের কারনে এটি অণ্য যেনোকোনো খাবারে ব্যবহার করলে সেই খাবারের স্বাদ বহুগুনে বেড়ে যায়।
সর্দি-কাশী কমাতে সাহায্য করে
ঘি তে রয়েছে এন্টিব্যাকটেরিয়াল উপাদান। আমরা অনেকেই শীতকালে বা বর্ষাকালে সর্দি কাশির সমস্যাই ভুগতে থাকি। এক্ষেত্রে নিয়মিত এক চা চামচ ঘি খেলে এটি আপনার ঠান্ডা জনিত সমস্যা দূর করতে সাহায্য করবে।
মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে
ঘি তে রয়েছে ব্রেন টনিক। যা আমাদের মস্তিষ্কের কর্মক্ষমতা বাড়াতে সাহায্য করে।
ঘি অতিরিক্ত মেদ কমাতে সাহায্য করে
ঘি তে থাকা কনজুগেটেড লিলোনিক এসিড শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে সাহায্য করে। এক্ষেত্রে রোজ সকালে এক গ্লাস উষ্ণ গরম পানির সাথে এক চা চামচ ঘি মিশিয়ে খেতে পারেন।
জয়েন্টের ব্যাথা দূর করে
ঘি তে রয়েছে ভিটামিন ডি, যা আমাদের হাড় ও মাংস পেশি সুস্থ্য রাখে। এছাড়া ক্যালসিয়াম ও ফসফেট আমাদের হাড়ের ক্ষয় রোধ করে এবং শরীরে বিভিন্ন জয়েন্টের ব্যাথা দূর করতে সাহায্য করে।
রুপচর্চায় গাওয়া ঘি
ঘি খেলে আমাদের ত্বক ন্যাচারালি সুন্দর থাকে। তবে ঘি খাওয়ার পাশাপাশি রুপচর্চার ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যায়।
ময়েশ্চারাইজার হিসেবে
ঘি তে রয়েছে ভিটামিন এবং ফ্যাটি এসিড যা আমাদের ত্বককে সুন্দর রাখে এবং ত্বকের শুষ্কতা দূর করে ত্বক কে ময়েশ্চাইরাইজ রাখে। শীতকালে কেউ যদি অতিরিক্ত রুক্ষ্য ত্বকের সমস্যায় পড়েন তাহলে হাতের তালুতে সামান্য ঘি ও পানি মিশিয়ে ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন।
ত্বকের উজ্বলতা বাড়াতে
ত্বকের উজ্বলতা বাড়ানোর জণ্য ঘি বেশ উপকারি। সপ্তাহে একদিন বেসন, ঘি ও হলুদের গুড়া মিশিয়ে ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন।
ত্বক কে মসৃন রাখে
ঘি আমাদের ত্বক কে সফট এবং মসৃণ রাখে। পাকা কলা ও ঘি একসাথে মিশিয়ে ত্বকে ব্যবহার করতে পারেন।
শরীর কে ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করে
রোজ সকালে এক গ্লাস কুসুম গরম পানির সাথে ১ চা চামচ ঘি মিশিয়ে খেতে পারেন। এটি আপনার শরীর কে ন্যাচারালি ডিটক্সিফাই করতে সাহায্য করবে। এতে আপনার ফেস গ্লো করবে এবং মুখের ব্রনের সমস্যা কমাতেও সাহায্য করবে।
চুলের আগা ফাটা দূর করতে সাহায্য করে
চুলের আগা ফেটে যাওয়া যেনো আমাদেওর অনেকের ই খুব পরিচিত একটি সমস্যা। চুলের আগা ফেটে দুই ভাগে বিভক্ত হওয়ার ফলে চুল গুলো লম্বা হয়না এবং দেখতেও খারাপ দেখায়। মুলত চুলের আগা ফাটার প্রধান কারন হলো চুলে মশ্চারাইজের অভাব। শ্যাম্পু করার পর চুলের আগা তে কন্ডিশনার এর সাথে ঘি মিশিয়ে ব্যবহার করুন। ৫ মিনিট পর চুল ধুয়ে ফেলুন। দেখবেন চুলের আগা ফাটার সমস্যা অনেক টাই কমে যাবে।
প্রতিদিন কি পরিমান ঘি খাওয়া উচিত ও কখন খাওয়া ভালো?
চুলের উজ্বলতা বৃদ্ধি করে
উজ্বল ও প্রানবন্ত চুল কে না চায়! তবে সঠিক যত্নের অভাবে অনেক সময় চুল তার স্বাভাবিক উজ্বলতা হারিয়ে ফেলে। এক্ষেত্রে সপ্তাহে অন্তত একদিন একটি ভালো হেয়ার প্যাক ব্যবহার করতে পারেন। একটি পাকা কলা, মেথি গুড়া ও সামান্য ঘি মিশীয়ে চুলে ব্যবহার করুন। এলোভেরা তে এলার্জি সমস্যা না থাকলে ১ চামচ এলোভেরা জেল ও মিশিয়ে নিতে পারেন। ২০/২৫ মিনিট পরে চুল শ্যাম্পু করে ধুয়ে ফেলুন। চুলের জ্বেল্লা দেখে নিজেই চমকে যাবেন।
সতর্কতা
- ত্বকে ঘি ব্যবহার করার আগে অবশ্যই চেক করে নিবেন এটি আপনার ত্বকে সুট করছে কিনা।
- অতিরিক্ত সংবেদনশীল ত্বক কিংবা ব্রনের সমস্যা থাকলে ঘি ব্যবহার করা যাবে না।
- তৈলাক্ত ত্বকের অধিকারি রা ঘি ব্যবহার থেকে দূরে থাকবেন।
- ঘি খাওয়ার জন্য অথবা ত্বকে ব্যবহার করার জণ্য অবশ্যই খাটি ঘি বেছে নিবেন।
- ত্বকে ঘি ব্যবহার করলে অবশ্যই ভালো মানের ক্লিনজার দিয়ে ত্বক পরিষ্কার করে নিবেন।
- চুলে ঘি ব্যবহার করলে ভালো মানের শ্যাম্পু ব্যবহার করে চুল ধুয়ে ফেলবেন।
আশা করছি আজকের এই লেখা থেকে আপনারা ঘি এর ব্যবহার ও উপকারিতা ও স্বচ্ছ ধারনা পেয়েছেন। খাটি ঘি আপনার ত্বক ও স্বাস্থ্য সুন্দর রাখে। তাই নিয়মিত খাবারে ১ চা চামুচ ঘি রাখুন।