কৎবেল বা কদবেল যে নামেই ডাকা হোক না কেনো টক স্বাদযুক্ত হওয়ায় সব বয়সের মানুষের কাছে ফলটি বেশ প্রিয়। দেশীয় মৌসুমি ফল হিসেবে এর জুড়ি মেলা ভার। বর্ষার শেষে এই ফলটি পথেঘাটে হরহামেশাই চোখে পরে আমাদের। পাকা কদবেলের ঘ্রাণ অসাধারণ হয়ে থাকে। বিটলবন দিয়ে কদবেল খেতে পছন্দ করেন না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া মুশকিল।
কদবেলের শাঁস দিয়ে জ্যাম, ফলের রস তৈরি করার পাশাপাশি অসাধারণ স্বাদের জিভে পানি আনার মতো আচার তৈরি করা যায়। যারা কদবেল খেতে পছন্দ করে তারা চাইলে খুব সহজেই বানিয়ে ফেলতে পারেন মজাদার এই আচার। তবে কদবেল দিয়েও যে আচার তৈরি করা যায় তা হয়তো অনেকের জানা নেই। তাই কদবেলের আচার তৈরির প্রসেস সম্পর্কে আজকের আর্টিকেলে আমরা জানবো।
কদবেলের আচার
আচারের প্রসংগ উঠতেই বরাবরই আমাদের মুখে পানি চলে আসে। পাকা কদবেলের ভর্তা মাখিয়ে খেয়েছেন নিশ্চয়ই। এটি খেতে যেমন মুখোরচক তেমনি এটি থেকে তৈরি আচারটিও অনেক দুর্দান্ত স্বাদের হয়ে থাকে। অনেকের কাছে আচারটি অপরিচিত হতে পারে। তবে বাজার বা গাছ থেকে কদবেল সংগ্রহ করে ঘরেই ঝামেলা ছাড়া খুব সহজেই তৈরি করা যায়। ঘরে থাকা উপকরণ দিয়ে তৈরি করা যায় আজকে আচারের দুটো রেসিপি নিয়ে হাজির হলাম।
রেসিপি ১
উপকরণ
- পাকা কদবেল ৩টি
- সরিষার তেল হাফ কাপ
- রসুন কুচি ১ টেবিল চামচ
- শুকনো মরিচ ২টি কুচি করে নেওয়া
- সাদা ভিনেগার ১/৩ কাপ
- চিনি হাফ কাপ
- লবন হাফ চা চামচ
- বিট লবন ১ চা চামচ
- আধা ভাঙা শুকনো মরিচ গুড়ো ১ চা চামচ
- পাঁচফোড়ন গুড়ো ১ চা চামচ
প্রস্তুতপ্রণালী
আচার তৈরির জন্য একদম গাছপাকা কদবেল ব্যবহার করলে সবথেকে ভালো হবে। তারপরে কদবেল ফাটিয়ে নিতে হবে। ভিতরের শাঁস একটি চামচের সাহায্যে বের করে নিয়ে একটি পাত্রে রাখতে হবে। এবার হাত দিয়ে আলুর ভর্তা তৈরির মতো করে মথে নিতে হবে।
চুলার একটি প্যানে সরিষার তেল, রসুন কুচি দিয়ে নেড়ে চেড়ে হালকা ভেজে নিতে হবে। কুচি করে রাখা শুকনো মরিচ দিয়ে হালকা ব্রাউন কালার চলে এলে মথে রাখা কদবেল দিতে হবে।
দুই থেকে ৩ মিনিটের মতো চুলার আচঁ মিডিয়ামে রেখে নেড়ে নিতে হবে। সাদা ভিনেগার ও চিনি (স্বাদ অনুযায়ী চিনির পরিমাণটি কমিয়ে বা বাড়িয়ে দেওয়া যাবে) মিশিয়ে কিছুক্ষণ জ্বাল দিয়ে ঘন হয়ে এলে চুলার আচঁ লো ফ্রেমে রাখতে হবে। এরপরে লবন, বিট লবন (অবশ্যই বিট লবন দিতে হবে), টেলে নেওয়া শুকনো মরিচ গুড়ো, পাঁচফোড়ন গুড়ো দিয়ে ভালো করে জ্বাল দিতে হবে। আচারের তেল ওপরে উঠে এলে চুলা থেকে নামিয়ে অন্য পাত্রে সংরক্ষণ করতে হবে।
রেসিপি ২
উপকরণ
- পাকা কদবেল ৪টি
- সরিষার তেল ১ কাপ
- চিনি দেড় কাপ
- পাঁচ ফোঁড়ন ১ টেবিল চামচ
- শুকনো মরিচ ৭/৮টি
- শুকনো মরিচের গুড়ো ১ টেবিল চামচ
- বিট লবন ১ চা চামচ
- ধনে গুড়ো ১ চা চামচ
- রসুন বাটা ১ চা চামচ
- জিরা গুড়ো ১ টেবিল চামচ
- ভিনেগার হাফ কাপ
প্রস্তুতপ্রণালী
পাকা কদবেল ভেঙে চামচ দিয়ে শাঁসগুলো বের করে নিতে হবে। সবগুলো শাঁস আলতো হাতে চটকিয়ে নিতে হতে হবে। চুলায় একটি প্যানে সরিষার তেল ভালো করে গরম করে নিয়ে পাঁচফোড়ন ও লাল শুকনো মরিচ দিয়ে একটু নেড়ে নিতে হবে। এরপরে কদবেল দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। ভিনেগার, লাল মরিচের গুড়ো, ধনে গুড়ো, বিটলবন, রসুন বাটা এইসকল উপকরণ দিয়ে ভালোভাবে নেড়ে নিতে হবে। তারপরে চিনি দিয়ে মিশিয়ে দিতে হবে। চিনির পানি শুকিয়ে গেলে ভাজা জিরে গুড়ো ও প্রয়োজন অনুযায়ী লবন দিতে হবে। কিছুক্ষণ জ্বাল দিয়ে চুলা থেকে নামিয়ে নিতে হবে।
কদবেলের পুষ্টি উপাদান
কলবেলের গুণাগুণ মানব দেহের জন্য খুবই উপকারী। দেহের রোগ প্রতিরোধ ও সুস্থ সবল দেহ গঠনে করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এতে প্রচুর পরিমাণে প্রোটিন, শ্বেতসার, আয়রন, স্নেহ পদার্থ, ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি ও সি রয়েছে। প্রতি ১০০ গ্রাম কদবেলে খনিজ পদার্থ ২.২ গ্রাম, খাদ্যশক্তি ৪৯ কিলো ক্যালরি, আমিষ ৩.৫গ্রাম, শর্করা ৮.৪ গ্রাম, ক্যালসিয়াম ৫.৯ মিলিগ্রাম, ভিটামিন বি ০.৮০ মিলিগ্রাম, ভিটামিন সি ১৩ মিলিগ্রাম।
কদবেলের আচারের উপকারিতা
নিচে কদবেলের আচারের উপকারিতা বর্ণনা করা হলো।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে
কদবেল শক্তিশালী অ্যান্টি অক্সিডেন্ট সমৃদ্ধ হওয়ায় মানব দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলে। কদবেল আচার খেলে সুস্বাস্থ্য গঠনে সহায়তা করে।
রক্ত স্বল্পতা দূর করে
দেহে হিমগ্লোবিনের পরিমানে বাড়িয়ে রক্ত উৎপাদন করতে সাহায্য করে। ফলে রক্ত স্বল্পতা দূর হয়। যাদের এই সমস্যা রয়েছে তারা চাইলে কদবেলের আচারটি খেতে পারেন।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে
কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যায় অনেকে ভুগছেন। এই সমস্যা থেকে রক্ষা পেতে কদবেলের আচারটি খাওয়া যেতে পারে। কারণ এতে প্রচুর পরিমাণে আশঁ রয়েছে। যা পেটে গ্যাসের সমস্যা রোধ করে কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে।
হাড় মজবুত করতে
হাড়কে মজবুত করতে ক্যালসিয়াম ও ফসফরাস উপকারী খনিজ উপাদান। যেহেতু কদবেলের মধ্যে প্রচুর ক্যালসিয়াম রয়েছে তাই এই আচারটি খেলে হাড় মজবুত করতে সাহায্য করে।
ক্যান্সার প্রতিরোধে
কদবেলে ক্যান্সোর প্রতিরোধের উপাদান রয়েছে। ফলে ক্যান্সার প্রতিরোধ করতে কদবেলের আচার বেশ কার্যকরী। বিশেষ করে স্তন ও জরায়ুর ক্যান্সার প্রতিরোধক হিসেবে কাজ করে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে
কদবেলে বিদ্যমান খনিজ উপাদনগুলো ডায়াবেটিস রোগ নিয়ন্ত্রণ করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সেই সাথে রক্তে সুগারের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে।
কোলেস্টরল নিয়ন্ত্রণে
কদবেলে থাকা উপাদান রক্তের ক্ষতিকর কোলেস্টরল কমিয়ে কোলেস্টরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সহায়ক। খাদ্য তালিকায় পরিমিত পরিমানে কদবেলের আচারটি খাওয়া যেতে পারে।
স্কার্ভি প্রতিরোধে
ভিটামিন সি এর অভাব জনিত রোগের নাম হলো স্কার্ভি। যেহেতু কদবেলে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি রয়েছে তাই এই আচারটি খেলে স্কার্ভি রোগটি প্রতিরোধ করা সম্ভব।
অন্ত্রের কৃমি ধ্বংস করতে
ট্যানিন নামের একটি উপাদান বিদ্যমান। যা অন্ত্রের কৃমি ধ্বংস করে। যাদের কৃমির সমস্যা রয়েছে তারা কদবেলের আচারটি খেতে পারেন।
মুখরোচক আচার তৈরিতে প্রয়োজনীয় আচার তৈরির মসলা ও এর ব্যবহার
শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে
কদবেলের মধ্যে এমন উপাদান রয়েছে, যা শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। শরীরের তাপমাত্রা স্বাভাবিক রাখতে খাদ্য তালিকায় কদবেলের আচারটি রাখতে পারেন।
আলসারের চিকিৎসায়
কদবেলে ফেনোলিক এসিড উচ্চমাত্রায় অ্যান্টিঅক্সিডডেন্ট পাওয়া যায়। কদবেলের আচারটি পেটের যেকোনো রোগ প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করে। পেপটিক আলসারের ক্ষত দূর করতে সাহায্য করে।
রুচি বাড়িয়ে তোলে
খাবারের রুচি ফিরিয়ে আনতে কদবেলের আচার বেশ দারুন ভূমিকা পালন করে। যাদের খাবারের প্রতি অনিহা রয়েছে, কোনো খাবার ঠিকভাবে খেতে পারছেন না। তারা চাইলে আচারটি খেতে পারেন। এতে অরুচি দূর করতে রুচি বাড়াতে সাহায্য করবে।
কদবেলের আচার খাওয়ার সর্তকতা
যারা কিডনির সমস্যায় ভুগছেন তারা অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে কদবেলের আচারটি খাবেন। এছাড়াও জটিল রোগে আক্রান্ত রোগীরা ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী এই আচারটি খেতে পারেন। অন্যথায়, ঔষধের সাথে প্রতিক্রিয়া করতে পারে। হতে পারে নানান অসুখ। যেকোনো ফল ও আচার খাওয়ার পরে চা খাওয়া যাবে না। কারণ চায়ের ক্যাপিন খাদ্যের আয়রণ শোষণ করতে বাধা দেয়। অতিরিক্ত কদবেলের আচার খাওয়া যাবেনা। এতে গ্যাস, মাথা ব্যাথা দেখা দেওয়া সম্ভাবনা থাকে।
উপরোক্ত আলোচনায় কদবেলের আচার কি, কীভাবে বানাবেন এবং এর দুইটি সহজ রেসিপি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশাকরি লেখাটি পড়ে আপনি কদবেলের গুণাগুন, বিভিন্ন উপকারিতা ও আচার খাওয়অর সর্তকতা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পেরেছেন।