ঘি হলো একটি পরিশোধিত মাখন। ইংরেজি তে ঘি কে বলা হয় ক্লারিফাইড বাটার। খাটি গরুর দুধ থেকে প্রক্রিয়াকরনের মাধ্যমে খাটি ঘি তৈরি করা হয়। আর এই খাটি ঘি শিশু থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সকলের জন্যই অনেক উপকারি। একদিকে স্বাস্থ্যকর খাবার অন্যদিকে অনন্য স্বাদ ও ঘ্রান এর জন্য দিন দিন ক্রমশই অধিক থেকে অধিকতর হচ্ছে এই ঘি এর জনপ্রিয়তা।
ঘি এর চাহিদা বেড়ে যাওয়াতে বর্তমানে বাজারে রয়েছে নানা ব্যান্ড এর ঘি। বিভিন্ন রঙের মোড়কজাতকৃত এসব ঘি ক্রমাগত চেষ্টা করে যাচ্ছে আমাদের মনোযোগ আর্কষনের। তবে মনে প্রশ্ন থেকেই যায় এই সকল ঘি এর গুনগত মান ও দাম একঈ কিনা। আজ আমরা জানবো ব্যান্ড ভেদে ঘি এর দাম ও এটির গুনগত মান সম্পর্কে।
ঘি এর দামের ভিন্নতার কারন
ঘি তৈরি হয় খাটি দুধ থেকে। তবুও এলাকা ও ব্যান্ড ভেদে ঘি এর আলাদা আলাদা মুল্য। কি কারন এটার? ঘি এর দাম আসলে বেশ কয়েকটি বিষয় এর উপর নির্ভরশীল। যেমনঃ
- ঘি এর ধরনঃ ঘি এর বিভিন্ন ধরন বা ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে। গাওয়া ঘি, ক্রিমের ঘি, মিশ্র ঘি, অর্গানিক ঘি ইত্যাদি। এই সব গুলো ঘি এর তৈরি প্রক্রিয়া ও স্বাদ আলাদা। তাই দাম ও আলাদা।
- এলাকা ভেদেঃ এলাকা ভেদেও ঘি এর দামের ভিন্নতা দেখা যায়। যেমনঃ পাবনার ঘি, সিরাজগঞ্জের ঘি, স্থানীয় ঘি ইত্যাদি।
- ওজন ভেদেঃ বাজারে বিভিন্ন ওজন বা পরিমানের ঘি পাওয়া যায়।
- কোম্পানি ভেদেঃ বাজারে ছোট বড় বিভিন্ন ব্যান্ড এর ঘি প্রস্তুতকারন ব্যান্ড আছে যারা বানিজ্যিক ভাবে ঘি তৈরি করে থাকে। তবে এগুলোর বাহিরেও বর্তমানে অনেক উদ্দোক্তা হোম মেইড ভাবে ঘি তৈরি শূরু করেছেন।
- ঘি তৈরির উৎপত্তি ভেদেঃ আমরা সবাই জানি খাটি দুধ থেকে ঘি তৈরি করা হয়। একেক দুধের ঘনত্ব বা স্বাদ একেক রকম। যেমন, দেশি গরুর দুধের ঘি, মোষের ঘি, ছাগলের ঘি ইত্যাদি।
ধরন ভেদে ঘি এর দাম
গাওয়া ঘি
সকল ঘি এর মাঝে সবচেয়ে মজাদার ও দামি ঘি হলো গাওয়া ঘি। গাওয়া ঘি কিন্তু স্বরের ঘি নামেও পরিচিত। এই পদ্ধতিতে ঘি তৈরির জন্য সরাসরি গরুর দুধ সংগ্রহ করে সেই দুধ চুলোয় জ্বাল দিয়ে সর সংগ্রহ করা হয়। এরপর সেই সর পুনরায় চুলোয় জ্বালিয়ে তৈরি করা হয় খাটি গাওয়া ঘি। আপনি যদি সঠিক পুষ্টিগুন সমৃদ্ধ ঘি খেতে চান তাহলে খাটি গাওয়া ঘি হবে আপনার জন্য বেষ্ট অপশন। কড়া জ্বালে এই ঘি তৈরি করা হয় জন্য এই কারনে ঘি গুলো বেশ দানাদার হয়ে থাকে, এবং এটার ঘ্রান এবং স্বাদ কয়েক গুন বৃদ্ধি পায় ।
- ১ কেজি- ১০০০ ৳-২০০০৳
- হাফ কেজি- ৫০০৳- ১০০০৳
ক্রিমের ঘি
ক্রিমের ঘি তৈরির জন্য কাচা দুধ থেকে মেশীনের সাহায্য দুধ থেকে ক্রিম আলাদা করে নেওয়া হয়। এরপর সেই ক্রিম কে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় ক্রিমের ঘি। ক্রিমের ঘি তৈরি পদ্ধতি খুব সহজ এবং বেশ কম সময়েই এই ঘি তৈরি করা সম্ভব হয়। তবে ক্রিমের ঘি এর চেয়ে গাওয়া ঘি এর স্বাদ তুলনামুলক কিছুটা বেশি।
- ১ কেজি- ৭০০৳-১৪০০৳
- হাফ কেজি – ৩৫০৳- ৭০০৳
মিশ্র ঘি
মিশ্র ঘি মুলত গাওয়া ঘি এবং ক্রিমের ঘি এর সংমিশ্রনে তৈরি একটি ঘি।
- ১ কেজি- ৮০০৳- ১৫০০৳
- হাফ কেজি- ৪০০৳-৭৫০৳
স্থানীয় ঘি
স্থানীয় ঘি হলো একটি নির্দিষ্ট এলাকার ঘি। যেহেতু বাংলাদেশে ঘি একটি জনপ্রিয় খাবার। তাই কম বেশি সব এলাকাতেই এখন ঘি তৈরি করা হয়। এলাকা ভেদে এসব ঘি এর দাম ও আলাদা হয়ে থাকে। স্থানীয় এলাকা থেকে ভালো মানের ঘি কিনতে চাইলে প্রথমে ভালো ভাবে খোজ খবর নিবেন। যিনি ঘি তৈরি করছেন তিনি নিজে দুধ সংগ্রহ করেন কিনা এবং সেটি গাওয়া ঘি নাকি ক্রিমের ঘি এই বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে ঘি কিনবেন ।
এলাকা ভেদে ঘি এর দামের ভিন্নতা
ঘি একটি প্রাচীন ও প্রসিদ্ধ খাবার। ঘি এর উৎপত্তি স্থল অবশ্য ভারতীয় উপমহাদেশে। সময়ের সাথে সাথে ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশেও জনপ্রিয়তা পেয়েছে এই ঘি। তাই বাংলাদেশের অনেক এলাকাতেই বানিজ্যিক ভাবে তৈরি হয় সেরা মানের ঘি।
পাবনার খাটি ঘি
বাংলাদেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো এই পাবনার ঘি। পাবনার ঘি এর ব্যাপক জনপ্রিয়তার ফলে একটি প্রচলিত প্রবাদ বাক্য ও রয়েছে “পদ্মার ইলিশ আর পাবনার ঘি জামাইয়ের পাতে দিলে আর লাগে কি!” পাবনা জেলার ঘি এর এতো জনপ্রিয়তার প্রধান কারন হলো, এখানে প্রচুর পরিমানে ফ্রেশ গরুর দুধ পাওয়া যায়।
প্রানীসম্পদ অধিদপ্তরের থেকে পাওয়া সর্বশেষ তথ্যমতো, এই জেলাতে ছোট বড় প্রায় ১২২ টি ঘি তৈরির কারখান রয়েছে। পুরো জেলা জুরেই ঘি তৈরি হলেও এই জেলার সাথিয়া, ফরিদপুর এবং বেড়া উপজেলাই রয়েছে ঘি তৈরির সব বিশাল কারখান। পাবনার তৈরি এই ঘি শূধু যে দেশের ঘি এর চাহিদা মেটায় তা কিন্তু না। বরং দেশের সীমানা ছাড়িয়ে বিদেশেও দেশের সুখ্যাতি ছড়াচ্ছে পাবনার ঘি। পাবনাতে সকল ভ্যারিয়েন্ট এর ঘি পাওয়া যায়। তবে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো গাওয়া ঘি। যেটির মুল্য কেজি প্রতি ৳১২০০-৳২০০০।
সিরাজগঞ্জের ঘি
পাবনার মতোই দিনে দিনে সুখ্যাতি ছড়াচ্ছে সিরাজগঞ্জের ঘি। সারা দেশের দুধের চাহিদার সিংহ ভাগ পুরন করে সিরাজগঞ্জ এবং পাবনা। দৈনিক প্রথম আলোর দেওয়া তথ্যমতে, সিরাজগঞ্জে ছোট বড় প্রায় ৩৩ হাজার গরুর খামার রয়েছে। অবশ্য সেই প্রাচীন কাল থেকেই গাভি পালন ও দুধ উৎপাদনে বেশি জনপ্রিয় ছিলো এই সিরাজগঞ্জ জেলা। এই জেলাতে বর্তমানে ছোট বড় অসংখ্য কারখানা এবং উদ্দোক্তা রয়েছে যারা প্রতিনিয়ত দুদ্ধজাত পন্য যেমন ঘি, বাটার, মিষ্টি ইত্যাদি তৈরি করছেন। সিরাজগঞ্জ জেলাতে গাওয়া ঘি কেজি প্রতি ৳১২০০-৳১৫০০ দরে বিক্রি করা হয়।
ওজন ভেদে ঘি এর দাম
পরিমান ভেদে আলাদা আলাদা দামে ঘি বিক্রি হয়ে থাকে। বাজারে সাধারনত ৩ টি প্যাকেজিং এ ঘি পাওয়া যায়।
- ২৫০ গ্রাম।
- ৫০০ গ্রাম।
- ১০০০ গ্রাম বা ১ কেজি।
প্রাথমিক অবস্থায় ঘি টেষ্ট করার জন্য ও কোয়ালিটি নিশ্চিত হবার জন্য আপনি বাজার থেকে ২৫০ গ্রামের ছোট ঘি নিতে পারেন। তবে অনেক কোম্পানি রয়েছে যাদের ২৫০ গ্রামের তুলনায় ১ কেজি প্যাকেজিং এর ঘি কিছুটা সাশ্যয়ী মুল্য তে বা কম দামে বিক্রি করা হয়।
কোম্পানি ভেদে ঘি এর দাম
ঘি কেনার জন্য দোকানে গেলেই দেখবেন কত কত ব্যান্ড বা কোম্পানির ঘি দিয়ে দোকানি পসরা সাজিয়েছেন। সেই মুহুর্ত্বে অবশ্যই অনেকেই দ্বিধায় পরে যাই। কোন ঘি ভালো, দাম হিসেবে কোণ ঘি সাশ্যয়ি এই বিষয়ে একটু জেনে নেই চলুন।
মিল্কভিটা ( Milk Vita)
বাংলাদেশে বেশ প্রাচীন ও সুখ্যাতি সম্পুর্ন ব্যান্ড এটি। শুধু ঘি না, বরং তরল দুধ, বাটার, মাঠা, ক্রিম সহ আরও নানা দুদ্ধজাত পন্য এর জন্য এটি অনেকের আস্থার একটি জায়গা। মিল্ক ভিটার ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্য মতে ঘি এর মুল্যঃ
- ৯০০ গ্রাম টিন (১২/৬) – ১৪২০ টাকা।
- ৪০০ গ্রাম টিন(১৭/২০) – ৬৫০ টাকা ।
- ২০০ গ্রাম টিন(৪০/২০) – ৩৫০ টাকা।
আড়ং ডেইরি( Aarong Dairy)
মোটামুটি বেশ অল্প সময়েই ভালো মানের পন্য নিশ্চিত করাতে বাংলাদেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্র্যান্ড আড়ং। সর্বশেষ তথ্য মতে বর্তমানে আড়ং ঘি এর মুল্য –
- ৯০০ গ্রাম – ১৪৫০ টাকা।
- ৪০০ গ্রাম – ৬৭০ টাকা
- ২০০ গ্রাম – ৩৫০ টাকা।
ফার্ম ফ্রেশ (Farm Fresh)
আকিজ ফুড এন্ড বেভারেজ লিমিটেডের একটি অংশ হলো ফার্ম ফ্রেশ। বাজারে আসার পর থেকেই ভোক্তাদের কাছে ক্রমশই এটির জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। বর্তমানে chaldal তে ফার্ম এর এই ঘি এর মুল্য-
- ১০০০ গ্রাম – ১৬০০ টাকা
- ৪৫০ গ্রাম – ৭৫০ টাকা।
- ২০০ গ্রাম – ৩৫০ টাকা।
প্রান (Pran)
সর্বপ্রথম রংপুরে টিউবয়েল ও কৃষিভিত্তিক যন্তপাতি তৈরির মাধ্যমে প্রান -আর এফএল তার যাত্রা শুরু করেছিলো। এরপর থেকে বিভিন্ন পন্য দিয়ে ক্রেতাদের মন জয় করছে এই কম্পানি। chaldal এবং othoba. Com এ বর্তমানে প্রান ঘি এর দাম-
- ৪০০ গ্রাম – ৬০০ টাকা।
- ২০০ গ্রাম – ৩১০ টাকা।
- ১০০ গ্রাম – ১৭০ টাকা।
উৎপত্তি ভেদে ঘি এর দাম
ঘি তৈরি হয় খাটি দুধ থেকে। তাই এই ঘি এর বেশ ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে। এগুলো সবই কিন্তু আলাদা আলাদা স্বাদের হয়ে থাকে। তবে আমাদের দেশে সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো গরুর দুধের তৈরি ঘি এবং মোষের ঘি।
গরুর দুধের তৈরি ঘি
দেশি গরুর দুধ থেকে তৈরি করা ঘি কিছুটা হলুদ কালার। এটি হলুদ ঘি নামেও পরিচিত অনেকের কাছে। গরুর দুধে রয়েছে এ২ প্রোটিন যা মহিষের দুধে নেই। তাই মহিষের দুধের তুলনায় গরুর দুধে প্রটিনের মাত্রা বেশী।এছাড়াও গরুর দুধে রয়েছে ম্যাগনেসিয়াম, খনিজ উপাদান ও ভিটামিন যা হৃদপিন্ড কে ভালো রাখতে এবং কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে।
মহিষের দুধের তৈরি ঘি
এই ঘি সাধাররনত সাদা বর্নের হয়ে থাকে।সাদা ঘি বা মহিষের দুধের তৈরি ঘি তে চর্বি এর পরিমান কম।মহিষের দুধে রয়েছে প্রচুর পরিমান আয়রন, ফসফরাস এবং ম্যাগনেসিয়াম। সাদা ঘি শরীর এর ওজন নিয়ন্ত্রনে সাহায্য করে, হাড় কে শক্তিশালি করে এবং হৃদপিন্দের পেশির কার্যকালাপ সঠিক ভাবে পরিচালনা করতে সাহায্য করে।
ঘি এর পুষ্টি উপাদান, প্রয়োজনীয়তা ও ঘি খাওয়ার সতর্কতা
দুধের দাম তো কম তাহলে ঘি এর দাম বেশী কেন?
আমাদের অনেকের মনেই এই প্রশ্ন আসতে পারে। তবে বিষয় টি হলো ঘি তৈরি হয় দুধের ফ্যাট থেকে। পশুর উপর নির্ভর করে দুধে প্রায় ৩ থেকে ৮% চর্বি থাকে।যেই দুধে ফ্যাট বেশি সেই দুধ থেকে বেশী পরিমানে ঘি পাওয়া যাবে। সাধারনত এক কেজি খাটি ঘি তৈরির জন্য দেশি গরুর ২৫-৩৫ লিটার দুধের প্রয়োজন হয়।
অন্যদিকে মহিষের দুধের ঘি তৈরি করতে চাইলে ২০-২৫ লিটার দুধ থেকে ১ কেজি ঘি পাওয়া যাবে। এছাড়া ঘি তৈরির প্রসেস ও কিন্তু বেশ সময় সাপেক্ষ্য। বিশেষ করে খাটি গাওয়া ঘি তৈরিতে অনেক শ্রম এবং সময়ের প্রয়োজন হয়। সোনা যেমন আগুনে পুড়ে খাটি হয় ঠিক তেমনি দীর্ঘক্ষন জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় খাটি গাওয়া ঘি। তাই স্বাভাবিক ভাবেই ঘি একটি পুষ্টিকর দামি খাবার।
আশা করছি আজকের এই ব্লগ থেকে আপনারা ঘি এর দাম ও প্রকারভেদ সম্পর্কে জানতে পেরেছেন। তবে মনে রাখবেন এলাকা ও সময় ভেদে ঘি এর দাম পরিবর্তনশীল। তাই ঘি কেনার সময় অবশ্যই যাছাই বাছাই করে কিনবেন এবং খাটি ঘি কিনা সেটি ও নিশ্চিত হয়ে নিবেন। সবাই ভালো খান, সুস্থ্য থাকুন।