গ্রামাঞ্চলে বিভিন্ন মাঠে ঘাটে ছোট ছোট হলুদ সরিষার ফুল দেখতে পাই। সরিষার বীজ থেকে তৈরি করা হয় সরিষার তেল। স্বাদে ঘ্রাণে যেমন অন্যন্য তেমনি রয়েছে নানাবিধ উপকারিতা। তাইতো এই তেল আমাদের ঐহিত্যের সাথেই মিশে রয়েছে। সেই সাথে সরিষার তেলের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে। মূলত অসাধারণ স্বাদ ও গুনের কারণে রন্ধনশিল্পে এর ব্যাপক সুযোগ তৈরি হয়েছে। স্বাদের যেমন বৈচিত্র্য রয়েছে তেমনি সরিষার তেলের অনেক ধরনের স্বাস্থ্য উপকারিতা রয়েছে। আমাদের আজকের আলোচনায় ত্বকে সরিষার তেলের উপকারিতা এর ব্যবহার ও সতর্কতা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ত্বকে সরিষার তেলের উপকারিতা
সরিষার তেল ওমেগা ৩, ওমেগা ৬ ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন ই ও অ্যান্টি অক্সিডেন্টে সমৃদ্ধ হওয়ার একে স্বাস্থ্যকর তেলও বলা হয়। এছাড়াও প্রোটিন, ক্যালসিয়াম এ ভরপুর এই তেল। ফলে এই তেলের ঔষধি গুণাগুলের জন্য প্রাচীন কাল থেকেই ব্যবহার হয়ে আসছে। রান্নার পাশাপাশি ত্বক ও চুলের যত্নে এই তেলের উপকারিতা বহুগুণ।
অনেকের ধারণা সরিষার তেল ত্বকে ব্যবহার করলে ত্বক কালো হয়ে যায়। এজন্য এটি ব্যবহার করতে ভয় পান। কিন্তু এটি ব্যবহারে ত্বকে স্বাস্থ্যকর আভা দেয় ও আমাদের ত্বকের ট্যান ও কালো দাগ কমায়। আজকে আমরা ত্বকের যত্নে সরিষার তেলের উপকারিতা সম্পর্কে জানবো।
প্রাকৃতিক সান্সক্রিম
সূর্যতে বিদ্যমান আল্ট্রাভায়োলেট রশ্মি (UV) বা অতি বেগুণি রশ্মি যা আমাদের ত্বকের জন্য ক্ষতিকর। এটি ক্যান্সার সৃষ্টি পর্যন্ত করতে পারে। এই ক্ষতিকর রশ্মি থেকে আমাদের ত্বককে সুরক্ষা দিতে সাহায্য করে সরিষার তেল। যাকে প্রাকৃতিক সান্সক্রিমও বলা হয়। তবে ব্যবহারের সময় অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে অতিরিক্ত তেল ত্বকে যেনো লেগে না থাকে। অন্যথায় ত্বকে ধুলাবালি জমে বিভিন্ন ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে পারে।
ঠোঁটের যত্নে
শীতকালে আমরা অনেকেই ঠোঁট ফাটার সমস্যায় ভুগতে থাকি। আবার অনেকের তো সারাবছর এই সমস্যা রয়ে যায়। বিভিন্ন কেমিক্যালযুক্ত লিপবাম ব্যবহার করলে ঠোঁটের কালো ভাব দেখা যায়। এই সমস্যা দূর করতে পারে সরিষার তেল। নিয়মিত ঘুমাতে যাওয়ার আগে এক বা দুই ফোটা সরিষার তেল দিলে ঠোঁট ফাকা রোধ হবে।
ময়েশ্চারাইজার
বাতাসের আদ্রতা কমে গেলে আমাদের ত্বক হয়ে ওঠে শুষ্ক। আর ত্বকের শুষ্কতা ভাব রোধ করতে সরিষার তেল ত্বকের ময়েশ্চারাইজার হিসেবে খুব ভালো কাজ করে। এই তেলে অনেক প্রয়োজনীয় উপাদান রয়েছে যা ত্বকের জন্য বেশ উপকারী। তাই নিয়মিত ব্যবহারে ত্বক হয়ে উঠবে আরও সতেজ ও প্রান্যবন্ত।
ঠান্ডা কাশি থেকে পরিত্রাণ
শীতকালীন মৌসুমে অনেকে ঠান্ডা জনিত সমস্যা যেমন সর্দি – কাশিতে ভোগেন। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্ক ব্যক্তিরা। সরিষার তেল সবার ত্বকের জন্য উপাকরী। তাই এই তেল ব্যবহারে মৌসুমি রোগ থেকে মুক্তি অর্থাৎ ঠান্ডা কাশি থেকে পরিত্রাণ পাওয়া যায়।
পিগমেন্টমেশন দূর করতে
বয়সের সঙ্গে সঙ্গে আমাদের ত্বকে কালো ছোপ ছোপ দাগ, বলিরেখা ও পিগমেন্টশন দেখা দেয়। সরিষার তেল হাইপারপিগমেন্টশন নিয়ন্ত্রণ করে। ফলে এটি ফেইস মাস্ক হিসেবে ব্যবহার করলে ত্বকের বলিরেখা, পিগমেন্টেশন দূর করতে সাহায্য করে। এই তেলে রয়েছে ভিটামিন এ, ই এবং ভিটামিন বি কমপ্লেক্স।
অ্যালার্জি ও র্যাশের সমস্যা সমাধানে
আমাদের অনেকেরই শরীরে চুলকানি অর্থাৎ অ্যালার্জি জনিত সমস্যা রয়েছে। এক্ষেত্রে সরিষার তেলে অ্যান্টি-ফাঙ্গাল, অ্যান্টি ব্যাক্টেরিয়াল উপাদান রয়েছে। যা আমাদের শরীরের অ্যালার্জি ও র্যাশের সমস্যা কমাতে সহায়তা করে।
ত্বক সুস্থ রাখতে
সরিষার তেলে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন ও ফ্যাটি অ্যাসিড যা ত্বককে সুস্থ ও উজ্জ্বল রাখতে বেশ কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
প্রাকৃতিক ক্লিনজার
বর্তমানে আমরা বাজারের বিভিন্ন কেমিক্যালযুক্ত ক্লিনজার ত্বকে ব্যবহার করে থাকি। দীর্ঘদিন ব্যবহারের ফলে ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। এক্ষেত্রে সরিষার তেলের বহুগুন সুবিধার মধ্যে মুখের জন্য একটি প্রাকৃতিক ক্লিনজার অন্তর্ভুক্ত রয়েছে । কারণ এটি ত্বকের ছিদ্রগুলিকে বন্ধ করে দেয়। এবং ত্বককে এক্সফোলিয়ের্টি এবং পুষ্টিকর করতে সহায়তা করে।
ব্যথা উপশম করতে
ঐতিহ্যগতভাবে বাতের ব্যথা উপশমে সষিার তেল ব্যবহার করা হয়ে আসছে। শুধু বাতের ব্যথা নয় সেই সাথে হাটু, পিঠ ও কোমড় ব্যথা কমাতে সরিষার তেলের ব্যবহার অপরিহার্য।
শরীরের প্রদাহ নিয়ন্ত্রণে
সরিষার তেল আলফা -লিনোলিক অ্যাসিড সহ ওমেগা ৩ ফ্যাটি অ্যাসিড সমৃদ্ধ। যা শরীরের প্রদাহজনক প্রকিয়াগুলি নিয়ন্ত্রণে জড়িত এবং অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এবং প্রদাহ কমাতে সাহায্য করে থাকে।
ত্বকের পরিচর্যায় সরিষার তেল যেভাবে ব্যবহার করবেন
নিয়মিত সরিষার তেল মাখলে অনেক জটিল সমস্যার মোকাবিলা করা যেতে পারে। চলুন এই তেলের কিছু ব্যবহারের উপায় জেনে নেওয়া যাক-
- ঠান্ডা-কাশি থেকে উপশম পেতে হলে সরিষার তেল হালকা করে গরম করে গলায় বুকে ও পিঠে মালিশ করতে হবে। তাহলে বেশ আরাম পাওয়া যায়।
- সামান্য পরিমানে সরিষার তেল হাতে ঘষে মুখে লাগালে আমাদের ত্বককে সূর্যের ক্ষতিকর উপাদান থেকে রক্ষা করবে।
- সরিষার তেল ফেইস মাস্কের সাথেও ব্যবহার করা যেতে পারে।
- মুখে সরিষার তেল ও নারিকেল মিশিয়ে মালিশ করে ফেইসওয়াশ দিয়ে মুখ ধুলে ত্বকের উজ্জ্বলতা ফিরে পাওয়া যায়।
সরিষার তেলের ফেসপ্যাক তৈরির পদ্ধতি
সরিষার তেলের ফেইসপ্যাকটি তৈরির জন্য প্রথমত ২ চামচ সরিষার তেল, ১ চামচ বেসন, ১ চামচ দই এবং আধা চামচ লেবুর রস একটি বাটিতে নিয়ে একসঙ্গে সবগুলো উপকরণ মিক্সড করতে হবে। এর পরে একটি ঘন পেস্ট তৈরি হলে মুখে ১০-১৫ মিনিটের জন্য লাগিয়ে রাখতে হবে। তারপরে ঠান্ডা পানি দিয়ে মুখ ধুলে ফেলতে হবে। ত্বকের পোড়া দাগ ছোপ দূর করতে এটি দারুন কাজ করে। সপ্তাহে ১ বার করে ব্যবহার করলেই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে।
ত্বকে সরিষার তেল ব্যবহারে সর্তকতা
সরিষার তেলে প্রাকৃতিকভাবে ক্যাপসাইসিন, ইউরিকিক অ্যাসিড এবং অ্যালাইল থায়োসায়ানেট নামক একটি সালফারের মতো যৌগ রয়েছে। যা সবার ত্বকে ব্যবহারের জন্য উপযোগী নয়।
লাইকেন প্ল্যানাস
সরিষার তেল খাওয়া বা ত্বকে লাগালে কিছু মানুষের ত্বকে ফুসকুড়ি হতে পারে। এই ধরনের ফুসকুড়ি বেগুনি ক্ষত বা সাদা ফোস্কা সৃষ্টি করে।
ত্বক ও চোখের জ্বালা
মাথার ত্বকে অরিতিক্ত সরিষার তেল ব্যবহার করা এড়িয়ে চলতে হবে। এতে থাকা প্রাকৃতি রাসায়নিক ত্বক বা চোখের জন্য জ্বালা সৃষ্টি হতে পারে।
আটকে থাকা ছিদ্র
অন্যান্য তেলের মতো সরিষার তেলটিও ত্বকে রেখে দিলে আমাদের ত্বকের ছিদ্র আটকে বা পোরস ক্লোগ হয়ে যেতে পারে। ফলে ত্বকে বিভিন্ন সমস্যা দেখা যেতে পারে। তাই সরিষার তেল ব্যবহারের আগে অবশ্যই প্যাচ টেস্ট করে নিতে হবে। অর্থাৎ শরীরের একটি অংশে সরিষার তেল ব্যবহার করে দেখতে হবে ত্বকে জ্বালা ভাব সৃষ্টি বা অ্যালার্জি সংবেদনশীলতা দেখা দিয়েছে কিনা।
যদি কোনো সমস্যা দেখা না যায় তাহলে নিয়মিত সরিষার তেল ব্যবহার করা যেতে পারে। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সরিষার তেলটি অবশ্যই খাঁটি হতে হবে। কারণ ভেজালযুক্ত তেল ব্যবহারের ফলে হিতে বিপরীত হওয়ার সম্ভাবনায় বেশি।
উপরিউক্ত আলোচনায় সরিষার তেল কীভাবে আমাদের শরীরের জন্য স্বাস্থ্য উপকারিতা বয়ে আনে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। সাধারনত আমাদের দেশে এই তেলের উৎপাদন যেমন অনেক বেশি হয় তেমনি সরবরাহ স্বাভাবিক মাত্রায় থাকে। যে কারণে সকল বয়সি মানুসের কাছে এর সহজলভ্যটা নিশ্চিত হয়। অর্থাৎ মানুষ ত্বকের জত্ন নিতে জত ধরনের প্রোডাক্ট ইউজ করে সরিষার তেল তার মধ্যে অন্নতম। আমাদের আজকের লেখা পরলে আপনি ত্বকে সরিষার তেলের উপকারিতা ও কীভাবে এটি আমাদের উপকার করে সে সম্পর্কে পরিষ্কার ধারনা লাভ করবেন।