ঘি একটি পুষ্টিগুণে ভরপুর দুগ্ধজাত খাবার। ঘি এর স্বাস্থ্য উপকারিতা ও স্বাদের দিক দিয়ে চিন্তা করলে একে আপনি সবার উপরে রাখবেন। শরীরে খুব অল্প পরিমাণ ক্ষতিকর প্রভাব বিস্তার করার পাশাপাশি এটি খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করে। আমাদের আজকের লেখায় আমরা ঘি কিভাবে তৈরি করে এবং ঘি খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা লাভ করবো।
ঘি কীভাবে তৈরি করা হয়
ঘি তৈরির জন্য সাধারণত দুইটি পদ্ধতি অনুসরণ করা হয়। একটি হলো আধুনিক পদ্ধতি এবং অন্যটি সনাতন পদ্ধতি। যেহেতু দুধের সর এবং ক্রিম দুইটা দিয়েই মজাদার ঘি তৈরি করা যায়, তাই আজ আপনাদের দুইটি পদ্ধতিতেই ঘি বানানোর রেসিপি শেয়ার করবো।
দুধের সরের ঘি বা গাওয়া ঘি তৈরি পদ্ধতি
সরের ঘি তৈরি প্রসেস কিছুটা সময়সাপেক্ষ হলেও এই ঘি খেতেই সবচেয়ে বেশী মজাদার। প্রাচীন কাল থেকেই এই সরের ঘি এর ব্যাপক চাহিদা। এমনকি আপনি সহজ কিছু পদ্ধতি মেনেই বাসায় বসে নিজ হাতে বানিয়ে নিতে পারবেন এই মজাদার ঘি। চলুন তাহলে গাওয়া ঘি তৈরি পদ্ধতি জেনে নেওয়া যাক।
- ঘি তৈরির জন্য প্রথমে ফ্যাটযুক্ত দুধ বাছাই করে নেওয়া হয়। যেই দুধে ফ্যাটের পরিমাণ যতো বেশী সেই দুধ থেকে ততো বেশী ঘি তৈরি করা সম্ভব হয়। সাধারণত গরুর দুধের ফ্যাটের পরিমাণ সবচেয়ে বেশি। তাই ঘি তৈরি এর জন্য দেশি গরুর খাটি তরল দুধ সংগ্রহ করতে হবে।
- দুধ সংগ্রহ এর পর দুধগুলোকে পর্যাপ্ত সময় ধরে জ্বাল দিতে হবে। নির্দিষ্ট সময় যাবত জ্বাল করার ফলে দুধের উপর হালকা লাল বর্ণের সর জমা হতে থাকবে।যেহেতু এই সর জমা হতে বেশ সময় লাগে তাই আপনারা যারা বাসায় ঘি বানাতে চান তারা চাইলে, সারা সপ্তাহ দুধ জ্বাল করে সেই সর ফ্রিজে সংরক্ষণ করতে পারবেন।
- সর জমা হয়ে গেলে এবার সরগুলোকে প্রসেসিং করার পালা। সরগুলোকে হাতের সাহায্য ভালো ভাবে চটকে নিতে হবে অথবা মিহি করে বেটে নিতে হবে যাতে সরের কোনো অংশ শক্ত বা জমাট বাধা অবস্থায় না থাকে। সরগুলোকে মেশানোর সময় এতে ঠান্ডা পানি ব্যবহার করতে হবে।
- ঠান্ডা পানি ব্যবহার করার ফলে সর থেকে মাখনের অংশ উপরে ভেসে উঠবে এবং নিচে ঘোলের অংশ জমা হবে। এরপর সর থেকে পাওয়া মাখন পাতলা সুতি কাপড়ে রাখতে হবে যাতে মাখনে থাকা এক্সট্রা পানি ঝরে যায়। অবশ্যই মাথায় রাখতে হবে মাখনে কোনো এক্সট্রা পানি না থাকে।
- মাখন সংগ্রহ এর পর এই মাখন কে এইবার জ্বাল দিয়ে নিতে হবে। প্রথম দিকে চুলার আঁচ থাকবে হাই হিটে। এরপর মাখন গুলো যখন গলতে শুরু করবে এবং তেলের আকার ধারণ করবে তখন চুলার আঁচ কিছুটা কমিয়ে রাখতে হবে। ঘি এর ক্ষেত্রে যতো জ্বাল ততো স্বাদ।
- কড়া জ্বালে দীর্ঘক্ষণ সময় নিতে তৈরি করা ঘি এর স্বাদ বেশি ভালো এবং এটি দানাদার ও হয়। দীর্ঘক্ষণ সময় নিয়ে জাল দেওয়ার ফলে ঘি গুলো উপরে উঠতে শুরু করে এবং পাত্রের একবারে নিচে অবশিষ্ট মাখন পুড়ে কালো আকার ধারণ করে। এই অবস্থায় এটি চুলা থেকে নামিয়ে রাখতে হবে। কয়েক ঘণ্টা রেস্টে রাখার পরে সাবধানে চামচের সাহায্য উপর থেকে জমাট বাধা ঘি সংগ্রহ করতে হবে।
ব্যাস এভাবেই তৈরি করা যায় খাটি ও দানাদার গাওয়া ঘি
ক্রিমের ঘি তৈরি পদ্ধতি
ক্রিমের ঘি তৈরি পদ্ধতি বেশ সহজ। ক্রিমের ঘি তৈরি এর জন্য দুধ সংগ্রহ করে সেটিকে ব্লেন্ডারে ব্লেন্ড করে নেওয়া হয়, এতে করে তরল কিন্তু কিছুটা শক্ত ক্রিম পাওয়া যায়। এরপর সেটিকে চুলাতে জ্বাল দিয়ে তৈরি করা হয় ক্রিমের ঘি।
১ কেজি ঘি তৈরিতে কত কেজি দুধ লাগবে?
আমরা অনেকেই বাসায় ঘি তৈরি করতে চাইলে প্রথমে মাথায় প্রশ্ন আসে যে ঘি তৈরি করতে কত কেজি দুধ লাগতে পারে! আসলে ঘি এর পরিমাণ নির্ভর করে দুধের ফ্যাট এর উপর। যেই দুধে ফ্যাট বেশি সেই দুধ থেকে বেশী পরিমাণে ঘি পাওয়া যাবে।
সাধারণত এক কেজি খাটি ঘি তৈরির জন্য দেশি গরুর ২৫-৩৫ লিটার দুধের প্রয়োজন হয়। অন্যদিকে মহিষের দুধের ঘি তৈরি করতে চাইলে ২০-২৫ লিটার দুধ থেকে ১ কেজি ঘি পাওয়া যাবে।
ঘি খাওয়ার নিয়ম
ঘি খাওয়ার আসলে বিশেষ কোনো নিয়ম নেই। আপনি যেকোনো খাবারের সাথে এই ঘি মিশিয়ে খেতে পারবেন। আবার শুধু ঘি ও খেতে পারবেন। তবে ঘি এর কিছু জনপ্রিয় ব্যবহারবিধি হলো-
- তেল হিসেবে ।
- গরম ভাত অথবা খিচুড়ির সাথে।
- সবজি ও মাংস রান্নায়।
- মিষ্টি তৈরিতে।
- সেমাই বা বিভিন্ন ডেজার্ট তৈরিতে।
- নান রুটি অথবা পরোটা তৈরিতে।
- বিরিয়ানি বা পোলাও রান্নাতে।
খাটি ঘি যেভাবে চিনবেন
বাজারে ঘি কিন্তু এখন বেশ সহজলভ্য। তবে বাজার থেকে কেনা ঘি কতটুকু অর্জিনাল বা স্বাস্থ্যসম্মত! ভেজালের এই ভিড়ে কেমিক্যাল যুক্ত প্রডাক্ট খেয়ে নিজের এবং প্রিয়জনকে স্বাস্থ্যঝুঁকি তে ফেলতে না চাইলে সবসময় চেষ্টা করবেন অর্জিনাল খাটি গাওয়া ঘি কেনার জন্য।
চলুন জেনে নেওয়া যাক কীভাবে বুঝবেন আপনার ক্রয়কৃত ঘি সেরা এবং খাটি-
একটি পাত্র চুলো তে বসিয়ে তাতে এক চামচ ঘি দিন। যদি আগুনের তাপে ঘি তৎক্ষণাৎ গলে যায় এবং বাদামি বর্ণ ধারণ করে তাহলে এটি অর্জিনাল ঘি। আর যদি ঘি গলতে সমোয় বেশি লাগে বা কালারের মাঝে পার্থক্য দেখেন তাহলে বুঝে নিবেন এই ঘি ভেজাল মিশ্রিত। সহজ পরীক্ষা এর জন্য আপনি হাতের তালুতে এক চা চামচ ঘি নিন।শরীরের তাপেই যদি এই ঘি গলে যায় তাহলেও এটি খাটি ঘি।
ঘি পরীক্ষার জন্য ঘি বোতল সহ ফ্রিজে রেখে দিবেন। এর পর যদি দেখেন ঘি একদম জমে গিয়েছে, তাহলে এটি খাটি,অন্যদিকে ভেজাল মিশ্রিত ঘি তে তেলের আলাদা আলাদা স্তর দেখা যাবে।
ভেজাল মিশ্রিত তেলে পাম তেল এবং ডালডা বা অন্যান্য ভোজ্য তেল মিশ্রণ থাকে। তাই ঘি থেকে কিছুটা আর্টিফিশিয়াল গন্ধ পাবেন। এবং ঘি এর বর্ণ টাও কিছুটা হলদেটে ভাব থাকবে।
ঘি এর দাম কত?
ঘি এর নানাবিধ উপকারিতার কথা শুনে নিশ্চই ঘি খেতে ইচ্ছে করছে তাই না? কিন্তু কোন ঘি খাবেন, সেই ঘি এর দাম ই বা কত এমন হাজার টা প্রশ্ন নিশ্চই আপনার মন এসেছে।
আমি মনে করি সবচেয়ে মজাদার ঘি হলো খাটি গাওয়া ঘি। এই গাওয়া ঘি এর পুষ্টিগুণ ও সর্বাধিক। ঘি এর কোয়ালিটি এর উপরে নির্ভর করে এটির দাম। অনেক সময় ব্যান্ড ভেদে দাম ভিন্ন হয়ে থাকে।
বাংলাদেশে ঘি এর সেরা কিছু ব্যান্ড হলো আড়ং, ফ্রেশ, তীর ইত্যাদি। তবে এসব ব্যান্ডেড ঘি না খেতে চাইলে আরও ভালো মানের ঘি কিন্তু আপনি পাবেন বিভিন্ন ফ্রেশ ও অর্গানিক ফুড নিতে কাজ করা উদ্যোক্তাদের কাছে। বর্তমানে অনেক তরুণ-তরুণী উদ্যোক্তা, স্বাবলম্বী হওয়ার জন্য নিজ বাড়িতেই এমন সব অগার্নিক খাবার তৈরি করে থাকেন এবং সেগুলো ফেসবুকের মাধ্যমে সেল করে থাকেন।
যেহেতু ঘরোয়া পরিবেশে এই খাবার গুলি যত্ন সহকারে তৈরি করা হয় তাই যাচাই বাছাই করে কিনলে অবশ্যই ভালো মানের ঘি পাবেন। ঘি সহ অন্যান্য আরও অর্গানিক আইটেম পেতে আজই ভিজিট করুন ফেসবুক পেইজ “ বিন্নি ফুড”।