বাংলাদেশে বিভিন্ন এলাকায় অনন্য বৈশিষ্ট্যের খাবার পাওয়া যায়। এগুলো স্বাদে যেমন অনেক উৎকৃষ্ট হয় তেমনি সম্পূর্ণ ভেজাল মুক্ত থাকে। বিশেষ করে কোন মিষ্টি জাতীয় খাবার ছাড়া আমরা কোনো অনুষ্ঠান আয়োজন করতে পারি না। এমনকি আত্মীয় বাসায় যাওয়ার সময়েও আমাদের সবার পছন্দ মিষ্টি নিয়ে যাওয়া।
সাধারণ মিষ্টির থেকে কোন ঐতিহ্যবাহী মিষ্টির প্রতি আমাদের কৌতূহল বেশি থাকে এবং উক্ত আত্মীয় তাদের প্রতি আমাদের ভালবাসা এবং গুরুত্ব সম্পর্কে আত্মবিশ্বাসী হয়। নিচে এমনি একটি স্বনামধন্য বালিশ মিষ্টির ইতিহাস, এই মিষ্টি কেন বিখ্যাত এবং বালিশ মিষ্টি তৈরির রেসিপি সম্পর্কে বিস্তারিত বর্ননা করা হয়েছে।
নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি কেন বিখ্যাত?
নেত্রকোনার ঐতিহ্যবাহী বালিশ মিষ্টি বিখ্যাত হওয়ার কারণ এর আঁকার, ওজন, নাম এবং বৈশিষ্ট্য। বালিশ মিষ্টি অনেক মিহি, নরম ও তুলতুলে হয়। সাধারণত বাংলাদেশে নানা ধরনের মিষ্টি জাতীয় খাবার প্রচলিত আছে। যেহেতু সব মিষ্টি জাতীয় খাবার মিষ্টি স্বাদের হয় সেহেতু এত প্রকারের মিষ্টি তৈরি করার আসল উদ্দেশ্য কি?
বিভিন্ন প্রকারের মিষ্টি বিভিন্ন আকারের এবং রঙের হয়। আঁকার পরিবর্তনের সাথে সাথে যেমন নাম পরিবর্তন হয় তেমনি স্বাদ পরিবর্তন হয়। বিভিন্ন সময় মিষ্টি তৈরির কারিগর নানা ধরনের পরীক্ষার মাধ্যমে নতুন ধারার মিষ্টি তৈরি করে ফেলে। মিষ্টি জাতীয় খাবারের মধ্যে বেশ বিখ্যাত পোড়াবাড়ির চমচম, নাটোরের কাচাগোল্লা, মুক্তাগাছার মন্ডা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি, কুষ্টিয়া জেলার তিলের খাজা, বগুড়ার দই, গাইবান্ধার রসমঞ্জুরি, কুমিল্লার রসমালাই ইত্যাদি।
পরবর্তীতে সেই পরিক্ষায় তৈরি হওয়া মিষ্টি যেমন নাম পায় তেমনি মানুষের পছন্দের তালিকায় স্থান পায়। যাইহোক, বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ঐতিহ্যবাহী খাবার রয়েছে যা সেই অঞ্চলের বৈশিষ্ট্য ও স্বতন্ত্রতা রক্ষা করে। এরই ধারাবাহিকতায় নেত্রকোনার গয়ানাথের বালিশ মিষ্টি পরিচিতি লাভ করে।
বালিশ মিষ্টি দেখতে অনেক বড় হয়। শুরুর দিকে যখন এই মিষ্টি আবিষ্কার করা হয় তখন প্রতিটি মিষ্টির ওজন প্রায় ৮০০ থেকে ১০০০ গ্রাম পর্যন্ত ছিল। আকারে একেকটি মিষ্টি ১৩ থেকে ১৪ ইঞ্চি পর্যন্ত হতো। তবে বর্তমানে যুগের পরিবর্তনের কারণে বালিশ মিষ্টি বিভিন্ন আকারে তৈরি করা হয়। এমনকি ২০, ৫০ বা ১০০ টাকার মধ্যে তিন সাইজের মিষ্টি পাওয়া যায়।
প্রতিটি ওরিজিনাল বালিশ মিষ্টি অনেক নরম এবং তুলতুলে হয়। দীর্ঘ সময় চিনির রসে ডুবিয়ে রাখার কারণে তা রসে টইটুম্বুর হয়ে থাকে। এলাচ ব্যবহার করার কারণে এই মিষ্টি থেকে অনেক সুন্দর ঘ্রাণ আসে। সব মিলিয়ে স্বাদ, দাম এবং বালিশের মত দেখতে এই মিষ্টি খেতে বিভিন্ন এলাকার মানুষ নিয়মিত ভিড় করে। শুধু মাত্র কৌতূহল ছাড়াও এই অনন্য মিষ্টি খাওয়ার জন্য পর্যটক এবং দেশি বিদেশি মানুষ উদগ্রীব হয়ে থাকে।
নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টির ইতিহাস
নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টির ইতিহাস কমপক্ষে ১০০ বছরের পুরোনো। তখন পুরো ভারতীয় উপমহাদেশ শাসন করতো ব্রিটিশ সরকার। তো সেই সময় গয়ানাথ একজন মিষ্টি তৈরির কারিগর ছিলেন এবং তার বর্তমান নেত্রকোনায় একটি মিষ্টির দোকান ছিল।
সেখানে নানা ধরনের মিষ্টি পাওয়া গেলেও বিক্রিতে তিনি তেমন সফলতা লাগ করতে পারেননি। সেই সময় তিনি বর্তমান ভারতের পূর্ব বর্ধমান জেলার বিখ্যাত ল্যাংচা নামক এক ভাঁজা মিষ্টির সাথে পাল্লা দিতে এক নতুন ধরনের মিষ্টি আবিষ্কার করে ফেলেন।
তো নতুন মিষ্টি তৈরি করার নেশায় গয়ানাথ যখন দিন পার করছেন তখন তার মাথায় এই অদ্ভুত মিষ্টি তৈরি করার ধারণা জন্ম নেয়। একদিন সে তার দোকানে পরীক্ষা করার জন্য বেশি পরিমাণ ছানা নিয়ে তা দিয়ে অনেক বড় একটি মিষ্টি তৈরি করে। ছানার খামির বেশি করে নিয়ে তা প্রথমে বালিশের মত করে লম্বা এবং পেট মোটা করে নেওয়া হয়। তারপর তা ভেজে রসে ডুবিয়ে টেস্ট করার জন্য কয়েকজন ক্রেতাকে খেতে দেয়।
এভাবে এক মুখ থেকে আরেক মুখের মাধ্যমে বালিশ মিষ্টির সুনাম ছড়াতে থাকে। যেহেতু দেখতে অনেকটা বালিশের মত তাই সবাই গয়ানাথকে বলে মিষ্টির নাম যেন বালিশ মিষ্টি রাখা হয়। তো এর পর থেকে এই বিশাল আকারের মিষ্টি বা চমচমকে বালিশ মিষ্টি অথবা গয়ানাথের বালিশ মিষ্টি হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
১৯৪৭ সালের দিকে যখন ভারত বিভাগ হয় ততদিনে বালিশ মিষ্টি বাঙালিদের মনে জায়গা দখল করে নেয়। সেই সময় গয়ানাথ বাদে তার পরিবারের অনেক সদস্য ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। কিন্তু গয়ানাথ পশ্চিম পাকিস্তান বা বর্তমান বাংলাদেশের নেত্রকোনায় থেকে জান। এখানে সে ভারত বিভাগের পরেও তার দোকান পরিচালনা করতে থাকেন এবং বালিশ মিষ্টি তৈরি করতে থাকেন।
পরবর্তীতে ১৯৬৯ সালে পশ্চিম পাকিস্তানে অস্থিরতা শুরু হলে তিনি তার দোকান সেখানকার বাসিন্দা কুমুদ চন্দ্র নাগের কাছে বিক্রি করে পশ্চিম বঙ্গে চলে আসেন। এদিকে গয়ানাথ ভারতে চলে গেলেও বালিশ মিষ্টি তৈরি করার পদ্ধতি কুমুদ চন্দ্রে শেখায়নি। এতে নতুন দোকান কিনে সে পড়ে মহা বিপদে।
এভাবে কিছু সময় বালিশ মিষ্টি তৈরি করা বন্ধ থাকে এবং বেদিক দেখে কুমুদ চন্দ্র এই মিষ্টি তৈরি করার প্রধান কারিগর নিখিল মোদককে খুঁজে বের করে তার কাছে দোকান বিক্রি করে দেন। বর্তমানে নেত্রকোনায় যে বালিশ মিষ্টির এক মাত্র বিশ্বাসযোগ্য দোকান আছে তা গয়ানাথের প্রতিষ্ঠা করে যাওয়া সেই দোকান।
কালের বিবর্তনে বাংলাদেশে বর্তমানে বালিশ মিষ্টির ঐতিহ্য ধরে রাখার কাজ করে যাচ্ছে মোদক পরিবার। অর্থাৎ বর্তমানে নিখিল মোদকের ছেলে এবং তার পরিবার এই প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করছে এবং বালিশ মিষ্টি তৈরি করছে। গুণগত মান ধরে রাখার জন্য তারা নতুন কোনো শাখা খুলেনি। অর্থাৎ আপনি খাঁটি এবং ভেজাল মুক্ত বালিশ মিষ্টি খেতে চাইলে অবশ্যই নেত্রকোণা গয়ানাথের দোকানে যেতে হবে।
নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি তৈরির রেসিপি
নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি এত বিখ্যাত হওয়ার কারণ হচ্ছে তার তৈরি প্রণালি। নিচে এই মিষ্টি তৈরি করার পদ্ধতি বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
উপকরণঃ ছানা, চিনি, এলাচের দানা, ময়দা
বালিশ মিষ্টি যে ভাবে তৈরি করা হয়
তো প্রথমে গোয়ালার কাছ থেকে খাঁটি গরুর দুধ সংগ্রহ করতে হবে। তারপর সেই দুধ ভালো করে জ্বাল দিয়ে তা লালচে রঙের করে নিতে হবে। তারপর সেখানে টক জাতীয় কিছু দিয়ে ছানা তৈরি করতে হবে। ছানা তৈরি হয়ে গেলে তা থেকে পানি ঝরিয়ে নিতে হবে যা পরবর্তীতে মণ্ড তে রূপান্তরিত হবে।
এরপর সেই ছানার মধ্যে হালকা ময়দা এবং দুধ দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। মেশানো হয়ে গেলে সেই ছানার মিশ্রণ থেকে প্রয়োজন মত মিষ্টির আঁকার নির্ধারণ করে নিতে হবে। চাহিদা মত ছানার মিষ্টি তৈরি হয়ে গেলে তা আলাদা পাত্রে রেখে দিতে হবে।
এখন চিনি জ্বাল দিয়ে তা গলিয়ে রস তৈরি করে নিতে হবে। নির্দিষ্ট সময় জ্বাল দেওয়ার পর চিনি পানি ছেড়ে দেবে এবং আঠালো রসে পরিণত হবে। এই সময় সেই রসের মধ্যে তৈরি করা ছানার মিষ্টি ছেড়ে দিতে হবে। তারপর সাবধানে সেগুলো নেড়ে দিয়ে মাঝারি আঁচে ভাজতে হবে। যখন মিষ্টি গুলো লালচে রং ধারণ করবে এবং রসালো মনে হবে তখন সেগুলো নামিয়ে অন্য একটি চিনির রসের গামলায় রাখতে হবে।
সেখানে ৩০ মিনিটের মত ডুবে থাকার ফলে মিষ্টি গুলো আরও বেশি রস শোষণ করবে। এতে বালিশ মিষ্টি নরম এবং তুলতুলে হবে। এভাবেই একটু পরিশ্রম করলে নেত্রকোনার ঐতিহ্যবাহী বালিশ মিষ্টি তৈরি করা সম্ভব।