কেশর বা জাফরান সম্পর্কে আমরা সবাই কম বেশি অবগত আছি। দাম বেশি হওয়ায় অনেকের নাগালের বাইরে এই মশলা দিয়ে তৈরি খাবারের স্বাদ অতুলনীয়। সচরাচর জাফরান বলতে আমরা কাশ্মীরের স্যাফরনকে চিনে থাকি। তবে পৃথিবীর আরও অনেক দেশে এই মশলা উৎপাদিত হয়। আমাদের আজকের লেখায় আমরা জাফরান কি, এর উপকারিতা এবং ব্যবহারবিধি সম্পর্কে জানবো।
জাফরান কি?
জাফরান বা ইংরেজিতে স্যাফরনকে লাল সোনা হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। এটি পৃথিবীর সব থেকে দামি মশলা যা খাবারের রং এবং স্বাদ বৃদ্ধি করে। ধারণা করা হয় জাফরানের আদি জন্মস্থল হলো ইরান তবে এ নিয়ে অনেক মতভেদ রয়েছে। কারণ সে সময়ে মিসরীয় ও মেসোপটেমীয় সভ্যতায় জাফরান ব্যবহার করার নজির পাওয়া যায়।
স্যাফরনের বৈজ্ঞানিক নাম Crocus sativus যা একটি সপুষ্পক উদ্ভিদ। তবে জাফরান ফুল দিতে পারলেও এর থেকে কোনো ফল হয় না। সে কারণে এই উদ্ভিদ উৎপাদন করতে সরাসরি মানুষের হস্তক্ষেপ লাগে। তো এই উদ্ভিদের ফুলের পাপড়ি বেগুনি রঙের হয় এবং ভিতরে থাকা লাল দণ্ড হলুদ ও কমলা রঙের মিশ্রণে লাল বর্ণ ধারণ করে।
মূলত ফুলের ভেতরে থাকা এই লাল পরাগ দণ্ড যখন শুকানো হয় তখন তা জাফরান হিসেবে পরিচিতি পায়। বিশ্বব্যাপী এই মশলার কদর সব থেকে বেশি। বিশেষ করে বড় বড় অনুষ্ঠান এবং পার্টিতে খাবার রান্না ও পরিবেশন করার জন্য জাফরান ব্যবহার করা হয়।
অন্যদিকে স্যাফরন বা রেড গোল্ড খাবারের সৌন্দর্য এবং স্বাদ বৃদ্ধি করে। তবে প্রচলিত উপায়ে এটি উৎপাদন করা যায় না। এমনকি সব ধরনের মাটিতে এই উদ্ভিদ জন্মানো সম্ভব হয় না। অন্যদিকে এক কিলোগ্রাম জাফরান মশলা উৎপাদন করতে প্রয়োজন হয় প্রায় ১ লক্ষ ৫০ হাজার ফুলের যা তুলতে সময় লাগে প্রায় ৪০ ঘণ্টা। এই কারণে প্রতি কিলোগ্রাম জাফরানের দাম পরে প্রায় সারে তিন থেকে চার লক্ষ টাকা।
জাফরান ফুল মাটি থেকে প্রায় ৬ ইঞ্চি উচ্চতায় হয় এবং সূর্য উদয়ের সাথে সাথে এই ফুল সংগ্রহ করতে হয়। মোটকথা এই ফুল উৎপাদন করা থেকে মশলা তৈরি করার আগে পর্যন্ত অনেক পরিশ্রম করতে হয় এই কারণে এর দাম এত বেশি হয়ে থাকে। তাছার গোটা বিশ্বের প্রায় ২০টি দেশে জাফরান চাষ হয় যাদের মধ্যে কাশ্মীর অন্যতম। আমরা মূলত জাফরান বলতে কাশ্মীর থেকে আশা জাফরান কেই বুঝি। তবে পৃথিবীর মধ্যে সরবরাহের দিক দিয়ে ইরান থেকেই প্রায় ৮০% উপর জাফরান বাজারজাত করা হয়।
জাফরান খাওয়ার উপকারিতা
প্রাচীন কাল থেকেই জাফরানকে একটি ভেষজ মশলা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। আয়ুর্বেদিক থেকে শুরু করে প্রায় সকল ধরনের চিকিৎসা খাতে এই মশলা ব্যবহার করা হয়। আরও জানা যায় যে জাফরান মানব দেহের প্রায় ২০ ধরনের রোগ সারাতে সক্ষম। এতে বিভিন্ন ভিটামিন, খনিজ ও মিনারেল সহ প্রায় ১২০ ধরনের পুষ্টি উপাদান থাকে। নিচে এর উপকারিতা গুলো বিস্তারিত আলোচনা করা হল।
স্বাস্থ্য উন্নত করে
নিয়মিত জাফরান খেলে তা হরমোন উদ্দীপক হিসেবে কাজ করে। অর্থাৎ আপনার শরীর যদি রোগা হয় বা সব সময় অসুখ লেগেই থাকে তাহলে জাফরান সেবন আপনার স্বাস্থ্য উন্নত করে। এতে থাকা বিভিন্ন পুষ্টি উপাদান দেহের সকল সমস্যা সমাধান করে এবং শারীরিক শক্তি বৃদ্ধি করে।
স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি করে
যেহেতু জাফরান হরমোন উদীপ্ত করে এবং রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে সেহেতু এটি মস্তিষ্কের জন্য অনেক উপকারী। বিশেষ কিছু গবেষণায় দেখা গেছে যাদের স্মৃতিশক্তি দুর্বল তারা জাফরান খেলে তাদের স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়।
অবসাদ দূর করে
অবসাদ দূর করার জন্য আমরা বিভিন্ন প্রকারের টোটকা ব্যবহার করে থাকি। তবে পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়া তেমন আশানুরূপ ফল পাওয়া যায় না। এই ক্ষেত্রে নিয়মিত জাফরান খেলে তা মস্তিষ্কের নিউরন সচল করে যা মানুষিক অবসাদ এবং দুশ্চিন্তা দূর করে দেয়।
রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে
জাফরানে পরিমাণ মত পটাশিয়াম থাকে যা শরীরে রক্ত চলাচল বৃদ্ধি করে। এতে ব্লাড সার্কুলেশন কোনো ঝামেলা ছাড়াই সম্পন্ন হয়। এতে দেহের মরা কোষ উজ্জীবিত হয়। অন্যদিকে সঠিক মাত্রায় রক্ত চলাচল হওয়ায় তা উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করে।
রক্তস্বল্পতা দূর করে
জাফরান মশলায় ব্যাপক পরিমাণ আয়রন থাকে। এই খনিজ উপাদান রক্ত পরিশুদ্ধ করে এবং রক্ত তৈরি হওয়া বৃদ্ধি করে। এতে দেহের রক্তস্বল্পতা দূর হয় এবং রক্তের কারণে সৃষ্টি হওয়া সমস্যা নিরসন হয়।
ক্যানসার প্রতিরোধ করে
মূলত শরীরে ক্যানসার হঠাৎ করেই বাসা বাঁধে না। ক্যানসার হওয়ার কিছু ভাইরাস আছে যা শরীরে থাকলে এক সময় তা ক্যানসারের সৃষ্টি করে। বিশেষ করে প্রটেস্ট ও কোলন ক্যানসার প্রতিরোধে জাফরান ব্যাপক ভূমিকা পালন করে।
অনিদ্রা দূর করে
অনিদ্রা স্বাভাবিক জীবন যাপন বিঘ্নিত করে। কারণ যখন ঘুম হয় না তখন দুশ্চিন্তা অন্তরে বাসা বাঁধে। এতে শরীর এবং স্বাস্থ্য দুটোই খারাপ হতে থাকে। এই সমস্যা সমাধানের জন্য জাফরান অনেক কার্যকরী ভূমিকা পালন করে।
হৃৎপিণ্ড সুস্থ রাখে
আমরা জানি জাফরান দেহের কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে। অন্যদিকে এতে থাকা পটাশিয়াম হার্টের স্বাস্থ্য উন্নত করতে সহায়তা করে। তাছাড়া হৃৎপিণ্ডের পেশি এবং কার্যক্রম স্বাভাবিক রাখার জন্য নিয়মিত জাফরান খাওয়া যেতে পারে। কারণ জাফরান যেমন রক্ত পরিষ্কার করে তেমনি এর পরিমাণ বৃদ্ধি করে ব্লাড সার্কুলেশন নিয়ন্ত্রণ করে।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রণ করে
অন্যান্য প্রাকৃতিক উপকারী উদ্ভিদের মত জাফরান কোলেস্টেরলের মাত্রা নিয়ন্ত্রণ করে। বিশেষ করে এই মশলা দেহের জন্য ক্ষতিকর এলডিএল কোলেস্টেরল দূর করে এবং উপকারী কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে।
জাফরানে তৈরি বাদাম শেক হতে পারে আপনার দৈনিক পুষ্টির সেরা উৎস!
শ্বাস-প্রশ্বাসের সমস্যা দূর করে
সর্দি এবং কাশির যে ধরনের সমস্যা হয় যেমন অ্যাজমা ও পারটুসিস দূর করতে জাফরান খাওয়া যেতে পারে। কারণ সর্দি-কাশির সমস্যা দূর করতে এই মশলা অনেক ভালো কাজ করে।
মাসিকের ব্যথা উপশম করে
মেয়েদের মাসিকের ব্যথা উপশম করতে জাফরান ব্যবহার করা হয়। এটি মাসিকের পূর্ববর্তী সময়ে সেবন করলে তা সম্ভাব্য ব্যথা কমিয়ে দেয়।
চোখের ছানি রোধ করে
জাফরান নিয়মিত খেলে তা চোখের বিভিন্ন সমস্যা যেমন ছানি পরা ও দুর্বল দৃষ্টি শক্তি নিরাময় করতে সহায়তা করে।
আসিডিটি দূর করে
এই মশলা হজম সমস্যা দূর করে এবং পেটের পিরা এবং অনাকাঙ্ক্ষিত গাস দূর করে। এতে আসিডিটি হওয়ার সম্ভাবনা কমে যায়।
জাফরান ব্যবহারের নিয়ম
জাফরানের বিভিন্ন রকমের ব্যবহার রয়েছে। তার মধ্যে ত্বকে ব্যবহার, খাদ্য হিসেবে গ্রহণ এবং খাবারের সৌন্দর্য বর্ধন অন্যতম। এখানে জাফরান খাওয়া এবং ব্যবহারের নিয়ম সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো।
খাওয়ার নিয়ম
জাফরান খাওয়ার সব থেকে উৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে রাতের বেলা। বিশেষ করে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে দুধের সাথে মধু ও কিশমিশ মিশিয়ে তাতে জাফরান দিয়ে খাওয়া সব থেকে বেশি উপকারী। এগুলো বাদেও বিভিন্ন বাদাম বা অন্যান্য পুষ্টি উপাদান যোগ করে জাফরান দুধের শোভা বৃদ্ধি করা যায়।
ত্বকের যত্নে
সাধারণত জাফরান ত্বকের যত্ন নেওয়ার জন্য ব্যাপকভাবে ব্যবহার করা হয়। এদের মধ্যে চন্দন কাঠ দুধ ও জাফরানের ফেসপ্যাক এবং মধু ও জাফরান ফেসপ্যাক ইত্যাদি হলো উল্লেখযোগ্য পদ্ধতি।
খাবারের সৌন্দর্য বর্ধন
বিভিন্ন মুখরোচক খাবার যেমন আইসক্রিম, মিষ্টি, সন্দেশ ইত্যাদির সৌন্দর্য বৃদ্ধি করার জন্য জাফরান ব্যবহার করা হয়। এছাড়া এই মশলা খাবারের রং, স্বাদ বৃদ্ধি করে ও সুগন্ধ ছড়ায়।
এখানে জাফরান সম্পর্কে অনেক তথ্যবহুল বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। আশা করি লেখাটি পরে আপনি স্যাফরন বা জাফরান সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা লাভ করেছেন।