আচার আমাদের একটি ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম। প্রতিটি মৌসুমি ফল দিয়ে ভিন্ন ভিন্ন স্বাদের আচার তৈরি করা বাঙালিদের একটি নেশা। তাছাড়া এসব আচার খেতে যেমন সুস্বাদু তেমনি আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য অনেক উপকারী। আজকের আলোচনায় আচার কেন এত জনপ্রিয়, এর উপকারিতা এবং জনপ্রিয় কিছু আচারের নাম বিস্তারিত বর্ণনা করা হয়েছে।
আচার আমাদের বাঙালির জন্য একটি আবেগের নাম। আচার পছন্দ করে না এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া অনেক কষ্টসাধ্য। এর পেছনে কারণ হলো আমরা বাঙালিরা অনেক ভোজন প্রিয়। আমাদের খাবের তালিকায় যেমন নিত্যনতুন আইটেম থাকে তেমনি ডেজার্ট হিসেবে থাকে আচার। বিশেষ করে মাছ আর গরম ভাতের সাথে টক ঝাল মিষ্টি আমের আচারের কোন তুলনাই হয় না। যাইহোক, আচার তৈরি করার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল খাবার সংগ্রহ করা। মাছ দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করার জন্য শুঁটকি তৈরি করা হয় তেমনি কোন খাবার দীর্ঘসময় খাবার উপযোগী করে রাখার জন্য আচার তৈরি প্রথার প্রচলন শুরু হয়।
আচার কেন এত জনপ্রিয়?
সময়ের সাথে সাথে যেমন আম, বড়ই, চালতা, আমড়া, তেঁতুল, আমলকী, জলপাই ইত্যাদি টক খাবার আরও মুখরোচক করে গড়ে তোলার জন্য আচার তৈরি করা শুরু হয়। ভারতীয় উপমহাদেশে এখন থেকে অনেক সময় পূর্বে শীতকালীন উৎপাদিত পণ্য গ্রীষ্ম সহ অন্যান্য ঋতু পর্যন্ত সংগ্রহ করার জন্য আচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। তখন থেকে যে খাবার দীর্ঘ সময় সংরক্ষণ করার প্রয়োজন ছিল সেখানে পরিমাণ মত লবণ, তেল, মরিচ সহ অন্যান্য মশলা যোগ করে মুখ বন্ধ পাত্রে রেখে দেওয়া হতো। এভাবে রাখলে খাবার যেমন সতেজ থাকতো তেমনি গন্ধ ওঠা বা ছত্রাক সমস্যা তৈরি হতো না।
তো আচার এত জনপ্রিয়তা পাওয়ার পেছনে কারণ হলো এর স্বাদ এবং গুণাগুন। সাধারণত আচার তৈরি করা হয় প্রধান উপাদান যেমন আম, বড়ই, তেঁতুল, রসুন ইত্যাদির সাথে লবণ, চিনি, মরিচ, মশলা, তেল, ভিনেগার ইত্যাদি পরিমাণ মত মিশিয়ে। এতে উক্ত আচার যেমন লম্বা সময় অক্ষত থাকে তেমনি টক, ঝাল এবং মিষ্টি স্বাদ পাওয়া যায়। তাছাড়া আচার আমাদের একটি ঐতিহ্যবাহী প্রথা। আমাদের পূর্বপুরুষগণ তাদের খাবার আরও মুখরোচক করার জন্য আচার ব্যবহার করতেন। আমড়া নিজেরা দাদি নানির বানান আচার খেতে সব সময় মরিয়া হয়ে থেকেছি।
জনপ্রিয় কিছু আচারের নাম
আম, তেঁতুল, বড়ই, জলপাই, চালতা, রসুন, আমলকী ইত্যাদি আচার তৈরি করার জন্য সব থেকে আদর্শ ফল। এগুলো ব্যবহার করে জ্যাম, জেলি, আমসত্ত্ব সহ অন্যান্য অনেক ধরনের আচার তৈরি করা যায়। নিচে কিছু জনপ্রিয় আচারের নাম দেওয়া হলো।
কাঁচা আমের মিষ্টি আচার
কাঁচা আমের মিষ্টি আচার আমাদের কার না পছন্দ। এই আচার দেখতে যেমন রসালো তেমনি খেতে অনেক সুস্বাদু। সাধারণত কাঁচা আমের এই আচার বানাতে আপনাকে আম রোদে শুকাতে হবে না। এমনকি সংরক্ষণের জন্য তৈরি করার পর রোদে না শুকিয়ে একটি এয়ারটাইট বক্সে রেখে ৩ মাস পর্যন্ত সংরক্ষণ করতে পারবেন। কাঁচা আমের মিষ্টি আচার তৈরি করতে আপনার প্রয়োজন পরবে কাঁচা আম (আঁটি হালকা শক্ত), লবণ, চিনি, সরিষার তেল, সাদা ভিনেগার, পাঁচফোড়ন মশলা, এবং গরম মসলার গুঁড়া। পরিমাণ মত এ সকল উপাদান ব্যবহার করে আপনি ঘরে বসেই সুস্বাদু আমের মিষ্টি আচার তৈরি করতে পারবেন।
গোটা জলপাইয়ের ট্রেডিশনাল আচার
জলপাইয়ের আচার একটি অনেক জনপ্রিয় আচার যা আমাদের প্রতিটি ঘরে ঘরে দেখা পাওয়া যায়। আমাদের দেশে শীতের শুরুতে জলপাই বাজারে আসে। এই সময়টাতে পরিপক্ব জলপাই দিয়ে অনেক সুন্দর ট্রেডিশনাল আচার তৈরি করা সম্ভব। তবে মনে রাখতে হবে ফ্রোজেন জলপাইয়ের থেকে টাটকা জলপাই এই ধরনের আচার তৈরি করার জন্য সব থেকে বেশি ভালো। যেহেতু এই আচার তৈরি করার পূর্বে জলপাই শুকিয়ে নিয়ে হয় সেহেতু চেষ্টা করবেন দিনের আলয় রোদে শুকিয়ে নিতে। তারপর প্রয়োজন মত হলুদ গুঁড়া, মরিচ গুঁড়া, লবণ, রসুন, আদার গুঁড়া, পাঁচফোড়ন, সরিষার তেল, শুকনা মরিচ এবং সাদা সরিষা দিয়ে ভালো মত রান্না করে তা সংরক্ষণ করতে হবে।
তেঁতুলের টক মিষ্টি আচার
তেঁতুলের কথা শুনলেই জিভে পানি চলে আসে। আসলে তেঁতুলের সাথে টক স্বাদের একটি অনন্য সম্পর্ক আছে। যাইহোক, তেঁতুলের আচার একটি বিশ্ব নন্দিত খাবার যা সবাই অনেক পছন্দ করে। তেঁতুলের অনেক ধরনের রেসিপি পাওয়া যায় যাদের মধ্যে এর টক মিষ্টি আচার অনেক জনপ্রিয়। তো তেঁতুলের আচার তৈরি করতে হলে আপনাকে তেঁতুল, লবণ, মরিচের গুঁড়া, ভিনেগার, গুড়, গোটা ধনে, গোটা জিরা, পাঁচফোড়ন, এবং সরিষার তেল পরিমাণ মত নিতে হবে। এতে তৈরি হবে মুখরোচক অসাধারণ স্বাদের তেঁতুলের আচার।
আমড়ার টক ঝাল মিষ্টি আচার
আমড়া একটু ভাঁজা লবণ দিয়ে খেতেই অনেক মজা লাগে। একে যদি আচারে পরিণত করা হয় তাহলে তো আর কোনো কথাই থাকবে না। আমড়ার আচার তৈরি করা যদিও একটু কষ্ট সাধ্য তবে এর ফলাফল আপনাকে বিস্মিত করে তুলবে। যাইহোক, আমড়ার আচার তৈরি করার জন্য আপনার প্রয়োজন পরবে আমড়া, সাদা সরিষা বাটা, রসুন কোয়া, সরিষার তেল, গুড়, তেঁতুল, তেজ পাতা, পাঁচফোড়ন, রসুন বাটা, আদা বাটা, মরিচের গুঁড়া, ভিনেগার, মৌরি গুঁড়া, শুকনো মরিচ এবং লবণ। এই সকল উপাদানের সঠিক ব্যবহারে তৈরি হবে আমড়ার টক ঝাল মিষ্টি আচার।
বরই এর মিষ্টি আচার
বরই আমাদের দেশের অনেক জনপ্রিয় একটি ফল। এ দেশের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে অনেক বড় বড় বরই গাছ আছে। ছোটবেলায় এসব গাছ থেকে আমরা কাঁটার ফোরা সহ্য করে বড়ই পেরে খেতাম। এগুলো যখন পেকে ঝরে যায় তখন সেগুলো কুড়িয়ে রোদে দিয়ে শুঁটকি তৈরি করা হয়। পরবর্তীতে সেগুলো ব্যবহার করে অনেক সুস্বাদু আচার তৈরি করা যায়। বরই এর মিষ্টি আচার তৈরি করার জন্য আমাদের প্রয়োজন পরবে শুকনো বড়ই, শুকনো মরিচ, গুড়, রসুন, আদা বাটা, মরিচ গুঁড়া, পাঁচফোড়ন, ভাঁজা জিরা, লবণ, ভিনেগার, তেজপাতা, সরিষার তেল। এ সকল উপাদান দিয়ে অনেক সুস্বাদু মিষ্টি আচার তৈরি হবে।
খেজুর ও তেঁতুল দিয়ে টক ঝাল মিষ্টি যুগলবন্দি আচার
আমরা ইতিমধ্যে তেঁতুল আচারের সম্পর্কে ধারণা লাভ করেছি। এখানে কোন সন্দেহ নেই তেঁতুলের আচার সব থেকে বেষ্ট তবে এর সাথে যদি খেজুর মেশানো হয় তাহলে স্বাদ আরও দ্বিগুণ হয়। এই আচার তৈরি করা অপেক্ষাকৃত কম ঝামেলার কাজ। তাছাড়া তৈরি করার পর ঠান্ডা করেই খেতে পারবেন বা ফ্রিজে রেখে অনেকদিন ব্যাপী খেতে পারবেন। এই যুগলবন্দি আচার তৈরি করতে হলে প্রয়োজন পরবে খেজুর, তেঁতুল, চিনি, বিট লবণ, মরিচের গুঁড়া, সরিষার তেল, জিরা গুঁড়া ইত্যাদি উপাদান।
আচারের উপকারিতা
আচারের উপকারিতা হলো বহুমুখী। অর্থাৎ নিয়মিত আচার খাওয়ার ফলে আপনার স্বাস্থ্য বিষয়ক কি কি উপকার পাবেন তা নিচে দেওয়া হলো।
- আচারে উচ্চমাত্রার অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট থাকে যা আমাদের শরীরে জমা হওয়া ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ নিষ্কাশন করে কোষের ক্ষতি হওয়া থেকে সুরক্ষা দেয়।
- অতিরিক্ত ওজন কমানোর জন্য আচার অনেক ভালো ও কার্যকরী মাধ্যম। আচারে খুব অল্প পরিমাণে ক্যালোরি থাকে এবং এতে থাকা অন্যান্য উপাদান অতিরিক্ত চর্বি জমা রোধ করে।
- আচার ভিটামিন সি এর পাশাপাশি ভিটামিন কে এর অনেক ভালো একটি উৎস। নিয়মিত আচার খেলে দেহের ভিটামিনের তারতম্য স্বাভাবিক হয়।
- হজম সমস্যা দূর করার জন্য আচার একটি অভেদ্য প্রক্রিয়া। এটি দেহের মেটাবোলিজম নিয়ন্ত্রণ করে।
- গর্ভ অবস্থায় পরিমাণ মত আচার খাওয়া ভালো কাজে দেয়। বিশেষ করে আমের এবং লেবুর আচার শারীরিক দুর্বলতা দূর করতে সাহায্য করে।
আচার খাওয়া একটি ভালো অভ্যাস। এতে বিভিন্ন ধরনের উপাদান থাকায় স্বাদ যেমন ভিন্ন হয় তেমনি উপকার পাওয়া যায়। এই লেখায় আচার সম্পর্কিত সকল বিষয় আলোচনা করা হয়েছে।