পবিত্র মাহে রমজান মাস- মুসলিমদের জন্য এ যেনো এক রহমতের মাস। এই মাস আমাদের জীবনে পরিবর্তন নিয়ে আসে। সিয়াম সাধনার মাসে নিজেকে ও পরিবারের সদস্যদের সুস্থ রাখতে ইফতার ও সেহরিতের খাবারের প্রতি বিশেষ নজর রাখা জরুরী। আমাদের সামর্থ্য অনুযায়ী ইফতার ও সেহরিতে খাবারের নানান পদের আয়োজন করে থাকি।
লক্ষ্য করলে দেখা যাবে আমাদের দেশে ইফতারের সময়টাতে মুখোরচক ভাজাপোড়া আইটেমগুলোর প্রচলণ বেশি। এই ধরনের খাবারগুলো মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। অন্যদিকে স্বাস্থ্যসম্মত ব্যাক্তিরা খাবারের বিষয়ে বেশ সচেতন থাকেন। তারা ইফতার ও সেহরিতে পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবার রাখার চেষ্টা করেন। আজকের আর্টিকেলের মাধ্যমে আমরা ইফতার-সেহরিতে যেসকল খাবার রাখবো ও যেসকল খাবার এড়িয়ে চলবো সেটা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবো।
ইফতারে যা খাবেন
রোজার মাসে অনেকের কাছে ইফতারের ম্যনুতে তেলে ভাজা খাবার ছাড়া যেনো চলেই না। তবে রোজা রেখে সুস্থ রাখতে চাইলে আমাদেরকে অবশ্যই ইফতার ও সেহরির খাবারের ব্যাপারে সতর্ক থাকতে হবে। যতটা সম্ভব পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে। এবং ভাজাপোড়া খাবারগুলো এড়িয়ে চলতে হবে। সঠিক খাদ্যাভাস মেনে চললে আমরা সুস্থ থাকতে পারবো। অন্যথায় শরীর দুর্বল ও অসুস্থ হয়ে পরার সম্ভাবনা থাকে। চলুন জেনে নেওয়া যাক ইফতারের সময়ে কোন খাবারগুলো খাওয়া উচিত-
খেজুর
খেজুরের বহুগুণ উপকারিতা রয়েছে। এছাড়াও এটি দিয়ে ইফতার করা সুন্নত। এতে রয়েছে প্রাকৃতিক চিনি। যা আমাদের শরীরে তাৎক্ষণিত শক্তি জোগাতে সাহায্য করে। হজমেও বেশ সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। তাই ইফতারের সময়ে আমাদের খেজুর খাওয়া উচিত।
শরবত
সারাদিন রোজা রাখার পরে একগ্লাস শরবত আমাদের ক্লান্তি দূর করতে সাহায্য করে। শুধু তাই নয়, আমাদের শরীরের পানির অভাব পূরণ করে থাকে শরীরকে হাইড্রেটেড রাখতে সহায়ক। তাই ইফতারে পানি ও শরবত রাখার চেষ্টা করতে হবে। শরবত বিভিন্ন উপাদান দিয়ে তৈরি করে নেওয়া যায়। যেমন- লেবুর শরবতের পাশাপাশি ,ইসবগুলের ভূসি, সিয়াসিড, তেঁতুল, বেল, দই ও ফলের রস ইত্যাদি দিয়ে নিজেদের পছন্দ ও স্বাদের ওপর নির্ভর করে বাসায় শরবত বানিয়ে ফেলতে পারেন।
পানি
আমরা সারাদিন রোজা রাখি। ফলে শরীরে পানির ঘাটতি তৈরি হয়। আর এই ঘাটতি পূরণ করতে অবশ্যই পর্যাপ্ত পরিমাণে পান করতে হবে। তবে ইফরাতে একবারে অতিরিক্ত পানি পান করা অনুচিত। এতে নাড়িতে প্যাঁচ লেগে অসুস্থ হওয়ার সম্ভাবনা রয়ে যায়। তাই ইফতারের সময় থেকে সেহরি পর্যন্ত ২-৩ লিটার পানি খাওয়া উচিত। ফলে আমাদের শরীরকে হাইড্রেটেড রাখবে ও হজমে সাহায্য করবে।


তাজা ফলমূল
ইফতারিতে তাজা ফলমূল খাওয়া উচিত। কারণ তাজা ফলমূলে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন ও মিনারেল থাকে। যা আমাদের শরীরের প্রয়োজনীয় পুষ্টি সরবরাহ করে থাকে। বাজারে কলা বেশ সহজলভ্য হলেও শরীর, মস্তিষ্ক ও স্নায়ুকোষ খাবারের মাধ্যমে তাৎক্ষণিক শক্তির যে জোগান চায়, কলা সেটি পূরণ করতে পারে। ইফতারে কলা বেশ ভালো একটি ফল হতে পারে। এছাড়াও পেপে, তরমুজ, পেয়ারা, আপেল, কমলা, আনারস ইত্যাদি ফলগুলো রাখা যেতে পারে।
স্বাস্থ্যকর শর্করাজাতীয় খাবার
রোজা রাখার কারণে আমাদের শরীর কিছুটা দুর্বল হয়ে পরে। তাই ইফতারে স্বাস্থ্যসম্মত শর্করা রাখা যেতে পারে। যেমন লাল চালের ভাত, গমের রুটি, ওটস, চিড়া, মিষ্টি আালু ইত্যাদি। এসমস্ত খাবার আমাদের শরীরে শক্তি জোগাতে সাহায্য করে।
ইফতারিতে যা খাবেন না
ভাজাপোড়া খাবার
ইফতারির মেন্যুতে পেঁয়াজু, বেগুনি, পুরি ইত্যাদি ভাজাপোড়া খাবার খুবই কমন। অনেকের কাছে এসকল ভাজাপোড়া খাবার না হলে যেনো চলেই না। তবে সারাদিন রোজা রেখে তৈলাক্তযুক্ত খাবার খাওয়া আমাদের স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। অতিরিক্ত ভাজাপোড়া খাবার খেলে হজমে সমস্যা দেখা দেয়। এছাড়াও গ্যাস্ট্রিকের সমস্যা হতে বুক জ্বালাপোড়া করে। তাই আমাদের উচিত যতটা সম্ভব ইফরাতে ভাজাপোড়া জাতীয় আইটেমগুলো এড়িয়ে চলা।
অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার
ইফতারিতে কখনোই অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার বেশি পরিমাণে খাবেন না। আমরা সকলেই জানি চিনি শরীরের জন্য কতটা ক্ষতিকর। যা খাওয়ার ফলে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয় এমনকি ওজন বৃদ্ধি করে ফেলে।
ক্যাফেইনযুক্ত পানীয়
চা কিংবা কফি প্রিয়মানুষদের সারাদিনে একবার চা কফি ছাড়া যেনো চলেই না। সাধারণত রোজার মধ্যে ইফতারির সময়টি অনেকেই চা-কফি পান করে থাকেন। যা মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। কারণ ক্যাফেইনপুক্ত পানীয় আমাদের শরীরকে পানি শূন্য করে ফেলে। সারাদিনের রোজা রাখার ফলে শরীরে পানির ঘাটতি তৈরি হয়। এরপরে চা কফি খেলে শরীরকে আরও ডিহাইড্রেটেড করে তুলবে। তাই যতটা সম্ভব ইফতারিতে ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় এড়িয় চলা উচিত।
অতিরিক্ত মসলাযুক্ত ও ভারি খাবার
ইফতারে কখনোও অতিরিক্ত খাবার গ্রহণ করা উচিত নয়। সারাদিন রোজা রাখার ফলে আমাদের পাকস্থলী সংকুচিত হয়ে যায়। ইফতারে ভারি ও অতিরিক্ত খাবার খেলে পাকস্থলীতে চাপ পড়ে। ফলে আমরা অস্বস্তিতে ভুগতে থাকি। তাই যতটা সম্ভব হালকা ও পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে।
সাহরিতে যা খাবেন
সাহরিতে সহজপাচ্য ও স্বাস্থ্যসম্মত খাবার খাওয়া উচিত। যা আমাদের সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে। খাদ্যতালিকায় সাহরিতে যেসকল রাখা উচিত চলুন জেনে নেওয়া যাক –
আঁশ জাতীয় খাবার গ্রহণ
আমাদের শরীরের চাহিদা ও সামর্থ্য অনুযায়ী আঁশজাতীয় খাবার গ্রহণ করা উচিত। যা খাওয়ার ফলে আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় শক্তি জোগান দেয়। ধীরে হজম হওয়ার কারণে ক্ষুধা অনুভব কম হয়। ফলে রোজার সময় সারাদিন সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখতে সাহায্য করবে। আঁশযুক্ত খাবারের মধ্যে ভাত, লাল আটা, বাদাম, বিনস, ছোলা, ডাল ইত্যাদি খেতে পারেন।
সুবজ শাকসবজি
শাকসবজির উপকারিতা সম্পর্কে আমাদের সকলেরই জানা রয়েছে। সাহরিতে সবুজ শাকসবজি রাখা যেতে পারে। সবজির হিসেবে লাউ, চালকুমড়ো, চিচিঙ্গা, ঢেরস, পটল প্রভৃতি। ও সবুজ শাক হিসেবে পুঁইশাক, কচুর শাক, লাউ শাক ইত্যাদি। এগুলো আমাদের শরীরে প্রয়োজনীয় শক্তি সরবরাহ করে থাকে। এছাড়াও হজম শক্তি বাড়িয়ে তোলে। যারা কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যায় ভুগছেন তারা বেশি বেশি সবুজ শাকসবজি খাবেন।
প্রোটিন জাতীয় খাবার
আমিষ কিংবা প্রোটিনের চাহিদা পূরণ করতে সাহরিতে দুধ, ডিম, মাছ মাংস রাখা যেতে পারে। এ ধরনের খাবারে ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, জিংক আয়রন ইত্যাদি পুষ্টি উপাদান রয়েছে। যা আমাদের দেহের ক্ষয়পূরনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তাই যতটা সম্ভব আমিষ জাতীয় খাবার গ্রহণ করা।


সাহরিতে যা খাবেন না
চা-কফি
সাহরিতে কখনোই চা-কফি পান করা উচিত না। কারণ এতে বিদ্যমান ক্যাফেইন তৃষ্ণার সৃষ্টি করে ও শরীরকে পানিশূন্য করে। ফলে রোজার দিনগুলোতে অনেক বেশি পানি পিপাসা অনুভূত হতে পারে। শুধু তাই নয়, ক্যাফেইনযুক্ত পানীয় খাদ্যের পুষ্টি পরিশোষণে বাধা দেয়।
অতিরিক্ত তেল ও মসলাযুক্ত খাবার
সাহরিতে মসলা ও তেলযুক্ত খাবার এড়িয়ে চলা উচিত। যেমন তেহারি, বিরিয়ানি ইত্যাদি। এই ধরনের খাবার হজম হতে অনেক সময় লাগে ও হজম করতে দেহে প্রচুর পানি পরিশোষিত হয়। পরবর্তীতে আমাদেরকে আরও তৃষ্ণার্ত করে তোলে। এছাড়াও পেটে গ্যসের সমস্যা দেয়া দিতে পারে।
অতিরিক্ত মিষ্টি জাতীয় খাবার
সাহরিতে মিষ্টি জাতীয় খাবার না খাওয়ায় উত্তম। কারণ মিষ্টি জাতীয় খাবারগুলো আমাদের ক্ষুধা বাড়িয়ে দেয়। ফলে দিনের বেলাতে ক্ষুধা অনুভব করে থাকি। ফলে শরীরে ক্লান্তি চলে আসে।
উপসংহার
রমজান মাসে আমাদের দেশে মানুষের মধ্যে যে খাদ্যাভ্যাস লক্ষ করা যায় তা মোটেও স্বাস্থ্যসম্মত নয়। ইফতারি কিংবা সাহরিতে আমরা তেলে ভাজা ও উচ্চ চর্বিসমৃদ্ধ খাবার খেয়ে থাকি। এই ধরনের খাবারগুলো হজম হতে বেশ সময় লাগে। শরীরে তাপ সৃষ্টি হয়। ফলে একধরনের অসস্তি অনুভব করে থাকি। অনেক সময় বদহজমের মতো সমস্যা দেখা দেয়। তাই আমাদের উচিত বয়স, ওজন ও শরীরের প্রয়োজানুসারে সুষম খাদ্য তালিকা তৈরি করা। যা আমাদের দেহের প্রয়োজনীয় পুষ্টিউপাদান সরবরাহ করে আমাদের সুস্থ রাখতে সাহায্য করবে।