অতি পরিচিত একটি বিশেষ কার্যকরী প্রাকৃতিক উপাদান হলো নারিকেল তেল। নারিকেল থেকে এই তেল সংগ্রহ করা হয়। নারিকেল একটি পুষ্টিকর ফল বলা যায়। নারিকেল চিংড়ি মাছের তরকারিসহ বিভিন্ন ডেজার্ট আইটেম ও পিঠা তৈরিতে ব্যবহার করে হয়। এছাড়াও শুধু নারিকেল খেতেও ভিষণ মজাদার। এটি যেমন খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে তোলে তেমনি রয়েছে স্বাস্থ্য উপকারিতা।
চুলের যত্নে এই তেলের ব্যবহার আমাদের কারোরই অজানা নয়। সময়ের সাথে সাথে অন্যান্য ভোজ্য তেলের মতো নারিকেল তেলও স্বাস্থ্যকর ভোজ্য তেলে পরিণত হয়েছে। কোনো ব্যক্তির খাবারের পরিমিত নারিকেল তেল ব্যবহার করলে পুষ্টি সংযোজন হবে। আজকের আর্টিকেলে নারিকেল তেল খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
নারিকেল তেল
যেহেতু নারিকেল তেলে একধরনের ফ্যাট। এতে থাকা ফ্যাটিঅ্যাসিডগুলোর মধ্যে প্রায় ৯০ শতাংশ স্যাচুরেটেড ফ্যাট। তাই শীতকালে কঠিন অবস্থায় জমে যায়। এবং ৭৬ডিগ্রি ফারেনহাইট (২৪ডিগ্রি সেলসিয়াস) তাপমাত্রায় গলে যায়। বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে নারিকেল তেল উৎপাদনে হিটপ্রেস ও বিভিন্ন কেমিক্যাল ব্যবহার করা হয়।
এই ধরনের নারিকেল সরাসরি কখনোই খাওয়া উচিত নয়। এতে স্বাস্থ্যের ঝুকি হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তাই নারিকেল তেল খাওয়ার আগে অবশ্যই নিশ্চিত হতে হবে এটি অর্গানিক কিনা। কেমিক্যাল মুক্ত খাঁটি নারিকেল তেল গ্রহণ করলে পুষ্টিগুণ লাভ করা যায়। যাকে এক্সট্রা ভার্জিন গ্রেড নারিকেল তেলও বলা হয়।
নারিকেল তেল খাওয়ার নিয়ম
নিচে নারিকেল তেল কি কি উপায়ে খাওয়া যায় সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
রান্নার জন্য ব্যবহার
খাঁটি নারিকেল তেলের স্মোক পয়েন্ট প্রায় ৩৫০ ড্রিগ্রি ফারেনহাইট(১৭৫ড্রিগ্রি সেলসিয়াস), এটি মাঝারি তাপে রান্না করতে হবে। এছাড়াও বেক করার জন্য মাঝারি তাপ উপযু্ক্ত। অনেকে হয়তো স্মোক পয়েন্ট সম্পর্কে অবগত নয়। এটি হচ্ছে এমন এক তাপমাত্রা যেখানে তেল পুড়তে শুরু করে এবং নিলাভ ধোঁয়া উৎপন্ন হয়। রান্নার সময় অনেক বেশি তাপ দেওয়ার ফলে তেলের স্মোক পয়েন্ট ছাড়িয়ে যায়।
এতে খাবারে পোড়া গন্ধ সৃষ্টি হতে পারে। এই অধিক তাপের ফলে উপকারী পুষ্টিউপদান নষ্ট হয়ে যায়। নারিকেল তেল উচ্চ তাপমাত্রায় যদি ৪০০ ড্রিগ্রি ফারেনহাইট (২০৪ড্রিগ্রি সেলসিয়াস) হয় তাহলে রান্নার জন্য উপযুক্ত হবেনা। কারণ স্মোক পয়েন্টে ছাড়িয়ে গেলে উপস্থিত সকল পুষ্টিউপাদান নষ্ট হয়ে যাবে। মূলত নারিকেল তেল সস বা সালাদে ব্যবহার করার চেয়ে স্টোভ টপ রান্না বা বেকিংয়ের জন্য একটি ভালো উৎস।
নারিকেল তেল ব্যবহারে রান্নার কয়েকটি ধরন
সাধারণত আমরা রান্নায় সয়াবিন ও সরিষার তেল ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু কখনো কি ডিম ভাজিতে নারিকেল তেল ব্যবহার করেছিলেন? যদি না করে থাকেন তাহলে একবার বাসায় ট্রাই করতে পারবেন। এই তেল বিভিন্ন শাকসবজি, ডিম, মাছ ভাজাতে ব্যবহার যায়। এতে খাবারের স্বাদের মধ্যে এক নতুনত্ব যোগ হয়।
- নারিকেলের স্বাদ পছন্দ করলে চকলেট বার তৈরিতে ভার্জিন গ্রেড নারিকেল তেলটি ব্যবহার করা করতে পারেন। সাধারণত চকলেট বার তৈরির জন্য প্রয়োজন কোকো পাউডার, প্রাকৃতিক মধু ও খাঁটি নারিকেল তেল।
- নারিকেল তেল খাওয়ার আরও একটি উপায় হলো চা বা কফিতে যোগ করা। প্রায় এক চা চামচ বা খুব সামান্য পরিমানে এই তেল কফি বা চায়ে ব্যবহার করা যেতে পারে।
নারিকেল তেলের সংমিশ্রণে একটি সহজ রেসিপি জেনে নেওয়া যাক-
উপকরণ
- টি ব্যাগ ১টি
- ১ টেবিল চামচ মিষ্টি ছাড়া কোকো পাউডার।
- ১ টেবিল চামচ ক্রিম
- ১ চা চামচ নারিকেল তেল
- মিষ্টি স্বাদের জন্য স্টিভিয়া বা সামান্য পরিমানে চিনি ব্যবহার করা যেতে পারে।
এবার একটি চায়ের কাপের মধ্যে টি ব্যাগ ও গরম পানি দিতে হবে। তারপর অবশিষ্ট উপাদানগুলো দিয়ে ভালো করে মিশিয়ে নিতে হবে। মেশানো হয়ে গেলে টি ব্যাগ ফেলে দিয়ে চা পান করতে হবে।
বেকিং এর জন্য নারিকেল তেল ব্যবহার
- ভার্জিন গ্রেড নারিকেল তেল প্যানকেক, পাউরুটি তৈরিতে ব্যবহার করা যেতে পারে। এটি খাবারের স্বাদ বাড়িয়ে তোলে।
- চিনাবাদাম বা ওটমিলে খাঁটি নারিকেল তেল মাখিয়ে খাওয়া যেতে পারে।
- প্রোবায়োটিকের একটি বড় উৎস হলো দই। এটি খাওয়ার জন্য সামান্য পরিমানে গলানো খাঁটি নারিকেল তেল ব্যবহার করা যেতে পারে।
- খাঁটি নারিকেল তেল চামচের সাহায্যে সরাসরি খাওয়া যাবে। খাবার খাওয়ার ৩০-৪৫ মিনিট আগেই খেতে পারবেন। এতে ক্ষুধা হ্রাস পায়, খাবার গ্রহণে ভারসাম্য বজায় থাকে।
- হলুদ ও নারিকেল তেল এই দুটো উপাদান একসাথে খেলে শরীরের হৃদরোগ ও প্রদাহের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
এক্সট্রা ভার্জিন নারিকেল তেল খাওয়ার উপকারিতা
এক্সট্রা ভার্জিন নারিকেল তেল খাওয়ার ফলে বিস্ময়কর স্বাস্থ্য উপকারিতা পাওয়া যায়। একনজরে উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
- নারিকেল তেলে অ্যান্টিব্যাকটেরিয়াল, অ্যান্টিফাঙ্গাল ও অ্যান্টিপ্রোটোজোয়াল রয়েছে যা আমাদের শরীরকে অনেক রোগ থেকে নিরাপদে রাখে। যেহেতু এটি অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের ভালো একটি উৎস, তাই এটি পরিমিত খাওয়ার ফলে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে বাড়িয়ে আমাদের সুস্থ্য রাখে।
- এছাড়াও খারাপ কোলেস্টেরলের এলডিএল মাত্রা কমিয়ে ভালো কোলেস্টেরলের এইচডিএল মাত্রা বৃদ্ধি করে। যার ফলে হৃদরোদের ঝুঁকি হ্রাস পায়।
- এই তেল খাওয়াল ফলে আমাদের মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা বৃদ্ধি করে, স্ট্রোক হওয়ার ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করে। ত্বক, চুল ও নখের জন্য বেশ উপকারী।
- ওজন কমাতেও নারিকেলের অবদান রয়েছে। এটি ক্ষুধা কমিয়ে বিপাক বৃদ্ধি করে। যার ফলে অতিরিক্ত ওজন হ্রাস পায়।
- ক্যান্সার, কিডনি পাথর দূর করতে নারিকেল তেলের জুড়ি নেই। গবেষণা অনুসারে, এই তেল উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
- নারিকেল তেলে অ্যান্টি ইনফ্লেমেটরি বৈশিষ্ট্য রয়েছে যা বাতের ব্যাথা দূর করে । যারা আর্থ্রাইটিসের রোগী তারা এই ব্যবহার করতে পারেন।
- এই তেল আমাদের হজম শক্তি বৃদ্ধি করতে সহায়ক। যাদের পরিপাকতন্ত্রের গোলযোগ রয়েছে বা পেটের বিভিন্ন সমস্যা রয়েছে তারা এই তেল খেলে এসকল সমস্যা থেকে রেহাই পেতে পারেন।
- মৃগীরোগের ঔষধ হিসেবে কাজ করে নারিকেল তেল। যাদের খিুঁচনি সমস্যা রয়েছে তারা কিছুটা হলেও উপকার পেতে পারেন। কারণ এই তেলে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও মাঝারি চেইন ফ্যাটি অ্যাসিড বিদ্যমান যা এই রোগের সমস্যা কমাতে সাহায্য করে।
- নারিকেল তেল ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করে থাকে। এতে উপস্থিত বায়োঅ্যাকটিভ যৌদ রক্তে গ্লুকোজের পরিমাণ কমায়।
নারিকেল তেল কতটুকু খাওয়া উচিত
ভার্জিন নারিকেল তেলে ৯০শতাংশ স্যাচুরেটেড ফ্যাট অর্থাৎ সম্পৃক্ত চর্বি রয়েছে। তাই প্রতিদিন ১-২ টেবিল চামচ খাওয়া যেতে পারে। এর বেশি খেলে উপকারের চেয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকি হতে পারে। প্রতিদিন নারীদের ২০ গ্রাম ও পুরুষদের ৩০ গ্রামের বেশি খাওয়া উচিত নয়।
খাবার তেল নিয়ে অজানা তথ্য ও কোন তেল উপকারী
কিছু গবেষণায় দেখা গিয়েছে নারিকেল তেল ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা বৃদ্ধি করে, হার্টের স্বাস্থ্যকে ভালো রাখে। আবার অন্যরা দেখেনে এটি খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়িয়ে তুলতে পারে। যদিও এটি প্রতিদ্বন্দিতাপূ এমন বিরোধী গবেষণার কারণে কি পরিমাণে তেল খাওয়া যাবে না কিভাবে খেতে হবে তা নিয়ে বিভ্রান্তিতে পরেছেন অনেকে।
আশা করছি এই আর্টিকেল সম্পূর্ণ পড়ার পরে আপনি নারিকেল তেল খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে সঠিক ধারণা পাবেন। এবং এই তেলের পুষ্টি পেতে আপনিও স্বাস্থ্যকর খাদ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করতে পারেন। সাথে মুখে ভিন্ন স্বাদ উপভোগ করতে পারবেন।