You are currently viewing পিঠা-পুলির উৎসব এবং বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের পিঠা-পুলি
পিঠা-পুলির উৎসব

পিঠা-পুলির উৎসব এবং বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের পিঠা-পুলি

পিঠা-পুলির উৎসব বাঙালির লোকসংস্কৃতির এক অপার আনন্দের উৎস। বাংলার প্রতিটি ঋতুতে পিঠা-পুলি তৈরির একটি ঐতিহ্যবাহী প্রথা রয়েছে, যা যুগের পর যুগ ধরে বাঙালির জীবনে এক অমূল্য অংশ হিসেবে রয়ে গেছে। শীতের শুরুর সাথে সাথে গ্রামীণ বাংলার বাড়ির উঠানে শুরু হয় পিঠা তৈরির ধুম। বিভিন্ন পিঠার স্বাদ, গন্ধ এবং এর সঙ্গে জড়িত সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য বাঙালির উৎসবের মর্মবাণীকে তুলে ধরে। পিঠা তৈরির মূল উপকরণ হিসেবে ব্যবহৃত হয় চালের গুঁড়ো, খেজুরের গুড়, নারকেল, দুধ, যা গ্রামীণ বাংলার কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি এবং শস্য উৎপাদনের ওপর নির্ভরশীল।

বাংলার প্রতিটি অঞ্চলে পিঠার স্বাদ ও রকমে রয়েছে ভিন্নতা। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন পিঠার নাম, প্রক্রিয়া এবং উপকরণের পরিবর্তন দেখা যায়। যেমন, উত্তরবঙ্গের সিদল পিঠা, দক্ষিণবঙ্গের ভাপা পিঠা, কিংবা পূর্ববঙ্গের চুঙ্গা পিঠা- সবগুলোই বাংলার সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যকে তুলে ধরে। এই আর্টিকেলে আমরা পিঠা-পুলির উৎসব সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। 

বাংলায় পিঠা পুলির উৎসব কবে প্রথম চালু হয়?

বাংলায় পিঠা-পুলির উৎসবের সুনির্দিষ্ট সময়কাল জানা না গেলেও, এটি বহু শতাব্দী ধরে চলে আসছে এবং বাংলার প্রাচীন কৃষি সংস্কৃতির সাথে গভীরভাবে যুক্ত। ধারণা করা হয়, পিঠা তৈরির প্রথা মূলত শস্য কাটা ও মাড়াইয়ের সাথে সম্পর্কিত। খেজুরের রস সংগ্রহ এবং নতুন ধান কাটা শেষে বাংলার গ্রামীণ অঞ্চলে উৎসবমুখর পরিবেশে পিঠা-পুলি তৈরি ও বিতরণ শুরু হয়। 

শীতকালে নবান্ন উৎসবের সময়, নতুন চাল এবং খেজুরের রস ব্যবহার করে পিঠা তৈরির রীতি বাংলার কৃষিভিত্তিক সমাজে একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে ওঠে। এটি কেবল খাদ্য হিসেবে নয়, বরং বাঙালির সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতীক হিসেবে বিশেষ মর্যাদা লাভ করে, যা যুগে যুগে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে প্রবাহিত হয়েছে।

দেশের কোথায় কোথায় পিঠা-পুলির উৎসব বেশি হয়?

দেশের কোথায় কোথায় পিঠা-পুলির উৎসব বেশি হয়?

বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পিঠা-পুলির উৎসব অনুষ্ঠিত হলেও কিছু বিশেষ অঞ্চল এই উৎসবের জন্য বিশেষভাবে পরিচিত। উত্তরবঙ্গের রংপুর, দিনাজপুর এবং বগুড়া অঞ্চলে শীতকালে পিঠা-পুলির উৎসব অত্যন্ত জনপ্রিয়, যেখানে নবান্ন উপলক্ষে পিঠার আয়োজন হয়। দক্ষিণবঙ্গের খুলনা, বরিশাল এবং ফরিদপুর অঞ্চলেও পিঠা-পুলির উৎসব বিশেষভাবে পালিত হয়, যেখানে ভাপা পিঠা, দুধ পুলি এবং চিতই পিঠা প্রচলিত। 

চট্টগ্রাম অঞ্চলে চিতই পিঠা ও শুটকি পিঠার আয়োজন বেশি হয়, আর সিলেট অঞ্চলে চুঙ্গা পিঠা এবং পুলি পিঠার উৎসব বেশ উল্লেখযোগ্য। ঢাকাসহ শহরাঞ্চলে শীতকালে পিঠার মেলা এবং উৎসবের আয়োজন করা হয়, যেখানে ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলের পিঠা উপস্থাপন করা হয়।

দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কিছু পিঠা-পুলি

আর্টিকেলের এ পর্যায়ে চলুন বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কিছু বিখ্যাত পিঠা-পুলি সম্পর্কে জেনে আসি। 

ভাপা পিঠা (ঢাকা এবং দক্ষিণবঙ্গ)

ভাপা পিঠা ঢাকার এবং দক্ষিণবঙ্গের অন্যতম জনপ্রিয় পিঠা। এই পিঠা সাধারণত শীতকালে বানানো হয় এবং চালের গুঁড়া, নারকেল ও গুড়ের মিশ্রণ দিয়ে তৈরি করা হয়। ভাপা পিঠা তৈরি হয় বিশেষভাবে ভাপে সেঁকে, যার ফলে এটি অনেক নরম এবং হালকা হয়। নারকেল এবং গুড়ের মিষ্টি স্বাদ ভাপা পিঠাকে উৎসবের একটি অপরিহার্য উপাদান করে তুলেছে।

পাটিসাপটা পিঠা (পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের শহরাঞ্চল)

পাটিসাপটা পিঠা পশ্চিমবঙ্গ এবং বাংলাদেশের শহরাঞ্চলে জনপ্রিয় একটি পিঠা। এটি সাধারণত দুধ, নারকেল এবং খেজুরের গুড় দিয়ে তৈরি করা হয়। পিঠার বাইরের আবরণটি চালের গুঁড়া ও ময়দা দিয়ে তৈরি হয় এবং ভেতরে থাকে নারকেল ও গুড়ের পুর। পাটিসাপটা পিঠা দেখতে রোলের মতো এবং এর নরম এবং মিষ্টি স্বাদ এটি বিশেষ এক ধরণের মিষ্টান্ন হিসেবে পরিচিত করেছে।

দুধ পুলি (খুলনা এবং বরিশাল)

দুধ পুলি খুলনা এবং বরিশালের বিখ্যাত একটি পিঠা। এটি দুধ এবং খেজুরের গুড় মিশিয়ে তৈরি করা হয়। চালের গুঁড়া দিয়ে ছোট আকারের পুলি বানিয়ে তা দুধে সেদ্ধ করা হয়। পুলির মধ্যে নারকেল এবং গুড়ের মিষ্টি পুর দেওয়া হয়, যা দুধের সঙ্গে মিশে এক অমৃত স্বাদ এনে দেয়। শীতকালে এই পিঠা বিশেষভাবে জনপ্রিয় এবং বিভিন্ন উৎসবের সময় দুধ পুলি একটি অপরিহার্য পদ।

চিতই পিঠা (চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী)

চিতই পিঠা চট্টগ্রাম এবং নোয়াখালী অঞ্চলে অত্যন্ত জনপ্রিয়। এটি বিশেষত শীতকালে তৈরি হয় এবং মাটির চুলায় সেঁকা হয়। চিতই পিঠা চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয়, যা সাধারণত নোনতা স্বাদের হয়। এর সঙ্গে পরিবেশন করা হয় গুড়, নারকেল, কিংবা মাংসের ঝোল। এই পিঠা সহজে হজমযোগ্য এবং শীতকালে সকালের নাশতা বা সন্ধ্যার নাস্তার জন্য একটি আদর্শ খাবার।

ফুলঝুরি পিঠা (পাবনা এবং রাজশাহী)

ফুলঝুরি পিঠা (পাবনা এবং রাজশাহী)

ফুলঝুরি পিঠা পাবনা এবং রাজশাহী অঞ্চলের একটি জনপ্রিয় পিঠা। এটি মূলত চালের গুঁড়া দিয়ে তৈরি করা হয় এবং দেখতে ফুলের মতো হয়। পিঠাটি বিশেষ ধরণের ছাঁচে তৈরি করা হয়, যা পরে গরম তেলে ভেজে নেওয়া হয়। ফুলঝুরি পিঠা মূলত মিষ্টি ধরনের এবং এটি বিভিন্ন উৎসব ও পার্বণে তৈরি করা হয়।

শুঁটকি পিঠা (সাতক্ষীরা)

সাতক্ষীরা অঞ্চলের শুঁটকি পিঠা এক অনন্য স্বাদের পিঠা, যা মাছে শুঁটকি ব্যবহার করে তৈরি করা হয়। শুঁটকির সঙ্গে মসলা মিশিয়ে এই পিঠার পুর বানানো হয় এবং ময়দার আবরণে এটি মোড়ানো হয়। এরপর এটি ভেজে অথবা ভাপে সেঁকা হয়। শুঁটকি পিঠা স্বাদে অত্যন্ত মুখরোচক এবং এই অঞ্চলের খাবারের বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরে।

সিদল পিঠা (উত্তরবঙ্গ)

উত্তরবঙ্গের সিদল পিঠা এই অঞ্চলের ঐতিহ্যবাহী এক ধরনের পিঠা, যা মূলত চালের গুঁড়া এবং শুটকি মাছ দিয়ে তৈরি হয়। শুটকির সঙ্গে নানা মশলা মিশিয়ে সিদল বানানো হয়, যা পরে চালের গুঁড়ায় মোড়ানো হয়। এরপর পিঠা গরম তেলে ভেজে পরিবেশন করা হয়। সিদল পিঠা উত্তরবঙ্গের গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর কাছে বিশেষ জনপ্রিয় এবং এটি সারা বছর বিভিন্ন উৎসব ও সামাজিক আচার-অনুষ্ঠানে পরিবেশিত হয়।

চুঙ্গা পিঠা (ময়মনসিংহ এবং সিলেট)

চুঙ্গা পিঠা মূলত সিলেট এবং ময়মনসিংহ অঞ্চলে প্রচলিত একটি পিঠা, যা বাঁশের চুঙ্গার (খোল) মধ্যে চাল দিয়ে তৈরি করা হয়। বৃষ্টির দিনে বা শীতে এই পিঠা বিশেষভাবে জনপ্রিয়। চালের গুঁড়া বাঁশের চুঙ্গার মধ্যে দিয়ে মাটির চুলায় রাখা হয় এবং ধীরে ধীরে চুলায় সেঁকা হয়। এর স্বাদ এবং সেঁকার প্রক্রিয়া খুবই বিশেষ এবং এই অঞ্চলগুলোর বৈশিষ্ট্যপূর্ণ খাবারের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত।

বছরের কোন কোন সময়ে পিঠা-পুলির উৎসব এর আয়োজন করা হয়? 

বাংলায় পিঠা-পুলির উৎসব প্রধানত শীতকালে আয়োজন করা হয়, বিশেষ করে নবান্নের সময়। নবান্ন বাংলার কৃষি সংস্কৃতির অন্যতম প্রধান উৎসব, যা নতুন ধান কাটার পর উদযাপিত হয়। এই সময় খেজুরের রস সংগ্রহের মৌসুম শুরু হয় এবং নতুন চাল পাওয়া যায়। নতুন ধানের চাল এবং তাজা খেজুরের রস দিয়ে তৈরি বিভিন্ন রকমের পিঠা যেমন ভাপা পিঠা, পুলি পিঠা, পাটিসাপটা ইত্যাদি শীতের সকালে ও সন্ধ্যায় পরিবারের সদস্যদের নিয়ে উপভোগ করা হয়। 

শরীয়তপুরের বিখ্যাত বিবিখানা পিঠা- একটি ঐতিহাসিক রেসিপি!

পিঠা-পুলি তৈরি ও খাওয়ার এই উৎসব বাঙালির পারিবারিক বন্ধনকে আরও দৃঢ় করে। শীতের সময়কার পিঠা-পুলির উৎসব একধরনের উষ্ণতা এবং আনন্দ নিয়ে আসে, যা বাংলার ঐতিহ্যবাহী উৎসব উদযাপনের অঙ্গ। তবে পিঠা-পুলির উৎসব শুধুমাত্র শীতকালে সীমাবদ্ধ নয়। বর্ষার সময়ও বাংলার কিছু অঞ্চলে পিঠা তৈরির চল রয়েছে। বর্ষার দিনগুলোতে চিতই পিঠা, ধূপ পিঠা, কিংবা ভাজা পিঠা বিশেষ জনপ্রিয়। 

বৃষ্টির দিনগুলোতে পরিবারের সদস্যরা একসঙ্গে বসে গরম গরম পিঠা উপভোগ করেন, যা বর্ষার সময়কার বিশেষ আয়োজন হিসেবে বিবেচিত হয়। এছাড়া বিভিন্ন পূজা, পার্বণ এবং উৎসবের সময়ও পিঠা-পুলির আয়োজন করা হয়। বাংলা নববর্ষ বা বৈশাখী উৎসবে নানা ধরনের মিষ্টি পিঠা যেমন দুধ পিঠা, ক্ষীর পুলি ইত্যাদি তৈরি করা হয়। এই ধরনের উৎসবগুলিতে পিঠা কেবল খাবার হিসেবে নয়, বরং সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে উদযাপিত হয়।

উপসংহার

পিঠা-পুলির উৎসব বাংলার সংস্কৃতির এক বিশেষ অধ্যায়, যা কেবলমাত্র খাদ্য হিসেবে নয়, বাঙালির আবেগ, স্মৃতি এবং ঐতিহ্যের একটি অপরিহার্য অংশ। পিঠার প্রতিটি ধরণ, প্রতিটি প্রস্তুত প্রণালী বাংলার ভৌগোলিক বৈচিত্র্যকে চিত্রিত করে। পিঠা-পুলির মধ্য দিয়ে বাঙালি তার শিকড়ের সন্ধান পায়, নিজস্বতাকে নতুন করে উপলব্ধি করে। 

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগলেও পিঠা-পুলি তৈরির এই প্রাচীন প্রথা বাঙালির জীবনযাত্রায় অক্ষুণ্ণ রয়েছে। পিঠার প্রতিটি কামড়ে লুকিয়ে আছে বাংলার ঐতিহ্যবাহী ইতিহাসের এক স্বাদময় গল্প, যা শুধু উৎসবেই নয়, বাঙালির দৈনন্দিন জীবনেও এক অনন্য আনন্দের উৎস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত।