মধু হলো মৌমাছি থেকে প্রাপ্ত বিশেষ একটি খাবার। মৌমাছিরা বিভিন্ন ফুল থেকে নির্জাস বা নেকটার সংগ্রহ করে। এই নির্জাস এর কিছু অংশ তারা খাদ্য হিসেবে গ্রহন করে আর বাকিটা সংগ্রহ করে রাখে। সংগৃহিত এই অংশ কেই বলা হয় মধু। ফুল থেকে মৌমাছির এর মধু সংগ্রহ করার পথ তা বেশ সুদীর্ঘ এবং বেশ রোমাঞ্চকর।
মৌয়াল দের নিশ্চয় চেনেন? ছোট বেলায় একবার পরিচিত এক মৌয়ালের সাথে গিয়েছিলাম মধু সংগ্রহ এর পুরো বিষয় টি আরও ভালো ভাবে পর্যবেক্ষন করার জন্য। সে এক দারুন অভিজ্ঞতা। আমার মতো নিশ্চয় অনেকেই আছেন যারা মধু খেতে খুব পছন্দ করেন। অথচ মৌমাছি কিভাবে মধু তৈরি করে সেই সম্পর্কে আমরা ক”জন জানি বলুন তো। চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক মৌমাছির মধু তৈরির সম্পূর্ন পদ্ধতি বা প্রক্রিয়া সম্পর্কে।
মৌমাছি সম্পর্কে কিছু কথা
মৌমছি হলো প্রকৃতির সুন্দর একটি উপকরন। মধু নিয়ে জানার আগে মৌমাছি সম্পর্কে কিছু কথা না জানলেই না। কারন মধু তৈরির প্রধান এবং একমাত্র কারিগর কিন্তু এই মৌমাছি। সারা বিশ্বে প্রায় ২০ হাজার প্রজাতির মৌমাছি রয়েছে। মৌমাছির ইংরেজী নাম হলো “BEE” বা বি। মৌমাছিড়া মধু ও মোম উৎপাদনের পাশাপাশি ফুলের পরাগায়নের জন্য বিখ্যাত।
বলা হয়ে থাকা প্রকৃতির অন্যতম কঠিন পরিশ্রমী পতঙ্গ হলো এই মৌমাছি। জেনে অবাক হবেন যে মৌমাছিরা ভিষন দলবদ্ধ, এমনকি ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র এই পতঙ্গ গুলোর রয়েছে “রানী” এবং “সেনা”। এ যেনো প্রাচীন কালের রাজা বাদশাহ দের কাহিনি। মৌমাছি কিন্তু আমাদের জন্য এতো কষ্ট করে মধু সংগ্রহ করেনা। তারা মুলত শীতকালে নিজেদের খাদ্য এর সঠিক যোগান দেওয়ার লক্ষ্যেই মৌচাকে তাদের মধু জমা করে রাখে। অবশ্য তাদের সংগৃহিত মধু থেকেই পরবর্তিতে মৌয়াল মধু সংগ্রহ করে।
মৌমাছিদের এমন দল বদ্ধ এবং পরিশ্রমি মনোভাব নিসন্দেহে আমাদের জন্য অনেক শিক্ষ্যনীয়। মৌমাছি নিয়ে নবকৃষ্ণ ভর্ট্রাচার্য এর একটি কবিতা নিশ্চয় ছোটবেলায় পড়েছেন !! চলুন একটু স্মৃতিচারন করা যাক।
“মৌমাছি, মৌমাছি
কোথা যাও, চাচি নাচি
দাঁড়াও না একবার ভাই।
ঐ ফুল ফোটে বনে
যাই মধু আহরনে
দাড়াবার সময় তো নাই।”
মৌমাছি কিভাবে মধু তৈরি করে
মৌমাছির মধু তৈরি করার প্রক্তিয়াটি সম্পূর্ন প্রাকৃতিক। সাধারনত বিভিন্ন ফুল থেকে মৌমাছিরা এই মধু সংগ্রহ করে। পৃথিবীতে হাজারের উপরে মৌমাছির প্রজাতি রয়েছে। তবে সকল মৌমাছি কিন্তু মধু তৈরি করে না। সবচেয়ে বেশি মধু তৈরি করে এমন দুইটি মৌমাছির প্রজাতি হলো apis cerana এবং apis Mellifera মৌমাছি। সাধারনত apis গোত্রের মৌমাছিরাই সবচেয়ে বেশী মধু তৈরি করে থাকে।
প্রকৃতির অন্যতম সবচেয়ে সুন্দর নিদর্শন হলো ফুল। এই ফুলের মাঝে থেকেই মৌমাছি রা রস সংগ্রহ করে থাকে। এই রস গুলোকে বলা হয় নেকটার। এই নেকটার গুলো মৌমাছিরা প্রথমে খাবার হিসেবে গ্রহন করে। আর বাকি অংশ টুকু নিজেদের দেহে সঞ্চয় করে রাখে মৌচাকে সংরক্ষনের জন্য। মধু সংগ্রহ করার পর মৌমাছিরা নিজেদের মৌচাকে ফিরে যায়। মৌমাছিদের এই মধু সংগ্রহ করার প্রক্রিয়াটা কিন্তু বেশ মজার। আগেই বলেছিলাম প্রাচীন কালের রাজা বাদশা দের আমলে যেমন রানি, রাজা, ও সেনা ছিলো ঠিক তেমনি কিন্তু মৌমাছিদের মাঝেও এমন রানী ও সেনা আছে। আর সাধারনত কর্মী মৌমাছিরাই ফুল থেকে মধু সংগ্রহ করে থাকে।
কখনো কি মৌমাছির চাক দেখেছেন? মধু ভর্তি এই চাক কিন্তু মৌমাছিদের সম্পূর্ন নিজস্ব সৃষ্টি। মৌমাছির আকার-আকৃতি এবং কাজের উপর ভিত্তি করে মৌমাছিকে ৩ টি ভাগে ভাগ করা হয়। রানি মৌমাছি, পুরুষ মৌমাছি এবং কর্মী মৌমাছি। মৌমাছিদের মাঝে প্রধান হলো রানী মৌমাছি। মৌমাছিদের শ্রেনীদের মাঝে ৯৯ শতাংশ ই হলো কর্মী মৌমাছি। এই কর্মী মৌমাছিরাই শুধু মধু আহরন করে থাকে। তবে মৌমাছিদের মাঝে কর্মঠ শ্রেনীর এক মৌমাছি রয়েছে, যারা কিনা রানী, সৈন্য এবং কর্মী সকলে মিলে মধু সংগ্রহ করে থাকে।
মধু সংগ্রহ প্রক্রিয়া
মধু সংগ্রহ এর জন্য ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৌমাছিরা প্রথমে ফুল নির্বাচন করে থাকে। সকল ফুল থেকেই কিন্তু মধু পাওয়া যায় না। সাধারনত মৌমাছিড়া নিজেদের চাকের আশের পাশে প্রায় দেড় থেকে দুই কিলোমিটারের মাঝেই ফুল থেকে নিজেদের মধু সংগ্রহ করে থাকে। তবে কোন কারনে এই দূরুত্বের মাঝে কাংখিত ফুল না পেলে মৌচাক থেকে প্রায় ৭-৯ কিলোমিটার দূরে গিয়েও তারা মধু সংগ্রহ করে। একবার ভেবে দেখুন মধু সংগ্রহ এর জণ্য এই ক্ষুদ্র মৌমাছির কতই না পরিশ্রম। মৌমাছিড়া প্রায় ৫০ থেকে ১০০ টি ফুলের রস, পাকস্থলিতে জমা রাখতে পারে।
মৌমাছিরা মধু সংগ্রহ এর সময় নিজেদের বিভিন্ন কাজের জন্য বিভক্ত করে ফেলে। একদল মৌমাছি ফুলের পরাগ সংগ্রহ করে, আরেকদল পানি সংগ্রহ করে আবার কিছু মৌমাছি সরাসরি ফুলের রস সংগ্রহ করে থাকে। তবে একটু মৌমাছি সাধারনত ফুল থেকে দুই ধরনের রস বা মধু সংগ্রহ করে থাকে। একটি হলো পরাগ এবং অন্যটি হলো ফুলের রস। পরাগের চেয়ে ফুলের রসের মধুর স্বাদ সবচেয়ে বেশি। কারন মৌমাছিরা একেবারে ফুলের মধ্যভাগ থেকে এই মধু সংগ্রহ করে থাকে।
মধু খেলে কি হয় ও এর উপকারিতাগুলো কি কি
ফুল থেকে রস সংগ্রহ এর পরে মৌমাছিরা এই রস গুলো তাদের পেটে জমা রাখে। মৌমাছিদের পেটে মধু জমা রাখার জন্য একটি আলাদা জায়গা রয়েছে। এটি Honey Stomach নামেও পরিচিত। মৌমাছির শরীরের দুইটি পাকস্থলির মাঝে একটি পাকস্থলি শুধুমাত্র এই মধু দিয়েই পরিপূর্ন থাকে। মৌমাছির এই পাকস্থলির ধারন ক্ষমতা প্রায় ৭০ মিলিগ্রাম হয়ে থাকে। তাই মৌমাছি যখন মধু সংগ্রহ করে তার পাকস্থলি পরিপূর্ন করে তখন সেই পাকস্থলির ওজন আর মৌমাছির ওজন প্রায় সমান হয়ে যায়।
ফুলের নির্জাস থেকেই ঘন তরল মধু
প্রাথমিক অবস্থাতে মৌমাছিরা ফুল থেকে রস সংগ্রহ করার পর এগুলো তাদের পাকস্থলিতে জমা রাখে। এরপর তারা মৌচাকের উদ্দেশ্য যাত্রা শুরু করে। মৌচাকে যাবার পর সেখানে অবস্থানরত কর্মী মৌমাছির মুখে এই ফুলের নির্জাস গুলো দিয়ে থাকে। দীর্ঘক্ষন মৌমাছির মুখে ফুলের নেক্টার থাকার করনে এটি একসময় ঘন তরলে পরিনত হতে থাকে।
মধু কেন নষ্ট হয় না
মৌমাছিদের মধু সংগ্রহ করার পর পরেই, মৌমাছির শরীরে থাকা বিভিন্ন এনজাইমের কারনে মধুর মাঝে গ্লুকোজ ও ফ্রুকটোজ প্রক্রিয়াজাতকরন হয়ে আলাদা হতে শুরু করে। এমনকি মধুর মাঝে যদি কোণো পানি কোনা থেকে থাকে, সেটি ও বাস্পের মাধ্যমে দূর হয়ে যায়। এতে করে মধু দীর্ঘদিন ভালো থাকে।
মধু নষ্ট না হওয়ার অন্য আরেকটি কারন হলো মধুতে PH এর মাত্রা খুব সল্প পরিমানে থাকে। এই PH সল্পতা ব্যাকটেরিয়ার আক্রমন থেকে মধু কে রক্ষা করে থাকে। এছাড়া মধু যাতে দীর্ঘদিন ভালো থাকে এজন্য মৌমাছিরা তাদের মৌচাকে মোম তৈরি করে থাকে। এই গাঢ় মোমের কারনে মৌচাকে মধু গুলো সুরক্ষিত অবস্থায় থাকে।
মৌমাছি কত দিনে মধু সংগ্রহ করে
মৌমাছিদের আয়ুকাল বেশ সিমিত। শ্রমিক মৌমাছিরা মৌসুমের উপর ভিত্তি করে দেড় থেকে দু মাস পর্যন্ত বেঁচে থাকে। তবে রানী মৌমাছিরা ৩-৫ বছর অব্দি ও বেঁচে থাকে। আর এই সময়ের মাঝে একটি মৌমাছি প্রায় ১/১২ চা চামচ মধু সংগ্রহ করে। এটি প্রায় ০.৮ মিলিগ্রামের সমান।
মধু উৎপাদনের সেরা সময়
মৌমাছিদের মধু সংরহ করার সেরা সময় হলো শরৎকাল। এসময় প্রকৃতিতে বিভিন্ন ফুলের সমারহ দেখা যায়। আর ঠিক এই সময় টাতেই সকল মৌমাছিরা মধু সংগ্রহের জন্য ব্যাস্ত হয়ে পরে।
উপসংহার
মৌমাছি ও মধু হলো প্রকৃতি থেকে পাওয়া এক অমুল্য উপহার। মৌমাছি শুধু যে মধু তৈরি করে থাকে তা কিন্তু না, বরং মৌমাছি পরাগায়নের জন্যও অনেক বেশি উপকারি। আমরা অনেকেই এই মধু খেয়ে থাকি, কিন্তু এই মিষ্টি মধু সংগ্রহের পেছনে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র মৌমাছিদের যে কতো পরিশ্রম এটা হয়তো আমাদের অনেকেরই অজানা ছিলো। আশা করছি আজকের এই লেখার মাধ্যমে আপনারা মৌমাছি কিভাবে মধু তৈরি করে সেই বিষয়ে বিস্তারিত জেনেছেন।