দিন যত যাচ্ছে ততো বাড়ছে গরমের তিব্রতা। গরমে হাঁসফাঁস অবস্থা সকলেরই। এমন অবস্থায় সকলের মাথায় ঘুরছে ছোট বেলার পুরোনো সেই গান “ আল্লাহ মেঘ দে, পানি দে ,ছায়া দে রে তুই আল্লাহ!” কি তাই না? মন যতোই বৃষ্টি চাইতে থাকুক না কেন আবহাওয়া অফিস কিন্তু অন্য খবর দিয়েছে।
আবহাওয়াবিদদের মতে বৃষ্টি তো দূরের কথা বরং আগামী কয়েক দিনে তাপমাত্রা আরও বাড়বে বলে আশঙ্কা করছেন তারা। তাহলে উপায় কী? প্রচণ্ড এই গরমে কীভাবে নিজেকে রক্ষা করবেন এবং এই গরমে সচেতন না থাকলে আপনি কি কি ক্ষতির সম্মুখীন হতে যাচ্ছেন এই বিষয়ে আজ বিস্তারিত আলোচনা করবো।
গরমের সময় কাল
বাংলাদেশে এপ্রিল হলো সবচেয়ে উত্তাপময় মাস। কারণ এই সময়ে পৃথিবী সূর্যরশ্মি থেকে লম্বালম্বিভাবে কিরণ পায়। আমরা জানি সূর্য কে কেন্দ্র কে পৃথিবী নিজ কক্ষপথে ঘোরে। এপ্রিল এর এই সময় টাতে পৃথিবীর ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ সূর্যের সবচেয়ে কাছাকাছি অবস্থানে থাকে। এতে করে গরমের মাত্রা টাও বেড়ে যায়। এর মাঝে বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রা দীর্ঘস্থায়ী থাকে যশোর জেলা তে। এ বছরেও যশোর এবং চুয়াডাঙ্গা তে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়েছে।
এই গরমে নিজেকে সুস্থ রাখতে করণীয়
প্রচণ্ড গরমে অনেকেই অসুস্থ হয়ে পড়ছেন। প্রতি বছর গরমের সময়ে হাসপাতালগুলোতে রোগিদের ভীর বেড়ে যায়। বিশেষ করে শিশু এবং বৃদ্ধদের গরমে অসুস্থ হওয়ার প্রবণতা সবচেয়ে বেশি। তবে সহজ কিছু স্টেপ অনুসরণ করেই আপনি এই গরমে নিজেকে সুস্থ রাখতে পারেন।
বিশুদ্ধ পানি পান করুন
দৈনিক প্রাপ্তবয়স্কদের ৩/৪ লিটার বিশুদ্ধ পানি পান করা জরুরী। তবে বয়স ও আপনার শরীরের অবস্থার উপর ভিত্তি করে পানি পানের পরিমাণ কম বেশি হতে পারে। যেমন আপনি যদি প্রচুর শারীরিক পরিশ্রম করেন বা ঘামের মাধ্যমে পানি বের হয় তবে সেটা পূরণে এর থেকেও বেশি পরিমাণে পানি পান করতে হবে।
রোদ থেকে দূরে থাকুন
যতোটা সম্ভব রোদ থেকে দূরে থাকার চেষ্টা করুন। দিনের বেশিরভাগ সময় রোদে রাখলে এটি আপনার শরীরকে ডিহাইড্রেট করে ফেলবে। তাই চেষ্টা করুন ছায়া যুক্ত স্থানে থাকার জন্য।
ছাতা এবং সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহার করুন
বাহিরে বের হলে অবশ্যই একটি ভালো মানের ছাতা এবং সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহার করতে হবে। এক্ষেত্রে চেষ্টা করবেন মিনিমাম SPF 50++ মানের সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহার করার।
নিয়মিত ঠান্ডা পানিতে গোসল করুন
এই গরমে সুস্থ থাকার জন্য আপনাকে নিয়মিত গোসল করতে হবে। এতে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে থাকবে এবং আপনি রোগ জীবাণুর হাত থেকে রক্ষা পাবেন। তবে বাহির থেকে এসেই একেবারে ঠান্ডা পানিতে ভুলেও গোসল করবেন না। এতে স্ট্রোক এর সম্ভাবনা বেড়ে যায়। বাহির থেকে এসে প্রথমে এক গ্লাস পানি পান করবেন। এরপর ফ্যানের নিচে বসে কিছুক্ষণ রেস্ট করে তারপর গোসল করবেন।
হালকা রং এর সুতি আরামদায়ক কাপড় পরিধান করুন
সুতি এবং হালকা বর্ণের কাপড় সূর্যের ক্ষতিকর রশ্নি থেকে আমাদের রক্ষা করে।
খাবারের তালিকায় বেশি বেশি মৌসুমি ফল এবং সবুজ শাকসবজি রাখুন
মৌসুমি ফল এবং শাকসবজিতে থাকা ভিটামিন এই গরমেও আমাদের শরীরকে প্রয়োজনীয় ভিটামিনের জোগান দেয় । তাই সুস্থ থাকতে অতিরিক্ত মশলা জাতীয় খাবারের পরিবর্তে এগুলো খাওয়ায় উত্তম।
ইসবগুলের ভুসির উপকারিতা, খাওয়ার নিয়ম ও সতর্কতা
গরমে ঘর ঠান্ডা রাখার ৪ টি দারুণ কার্যকরী উপায়
- একটি বড় বাটিতে বরফ নিন এবং টেবিল ফ্যানের সামনে রাখুন। এরপর ফ্যান ছাড়লেই একটা ঠান্ডা বাতাস অনুভব করবেন।
- অপ্রয়োজনে ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করবেন না। দিনের বেলা যথা সম্ভব ঘরের লাইট বন্ধ করে রাখবেন।
- গরমে বিছানার জন্য হালকা রং এর চাঁদর নির্বাচন করুন এবং জানালাতে ভারী পর্দা ব্যবহার করুন।
- বাড়ির আশেপাশে প্রচুর গাছ লাগান। যদি সম্ভব হয় রুমের মাঝেও ছোট ছোট টবে গাছ লাগাতে পারেন।
তীব্র এই গরমে যেই খাবার গুলো এড়িয়ে চলবেন
- অধিক মশলা ও ঝালযুক্ত খাবার।
- অতিরিক্ত চা-কফি।
- ফার্স্টফুড।
- ডিম ( ডিমের পরিবর্তে মাছ ও মাংস খেতে পারেন)।
- ডুবো তেলে ভাজা খাবার।
প্রচণ্ড গরমেও শরীর ঠান্ডা রাখবে যেই খাবার
- দই
- লেবুর শরবত
- শসা
- গ্রীষ্মকালিন বা সিজনাল রসালো ফল যেমন তরমুজ
- ডাবের পানি
- আখের শরবত
এই গরমে ত্বকের যত্নে করনীয়
তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে পাল্লা দিয়ে যেন ত্বকের সমস্যাও বেড়ে যায়। ত্বকে জ্বালাপোড়া করা, লাল হয়ে উঠা সহ আরও নানা সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। অনেকে তো বলেই থাকেন গরম এসেছে তো মুখ ভর্তি পিম্পল এসেছে। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই গরমে কীভাবে ত্বকের যত্ন নিশ্চিত করবেন-
- পর্যাপ্ত পানি পান করুন।
- নিয়মিত গোসল করুন।
- সানস্ক্রিন ক্রিম ব্যবহার করুন।
- বাহিরে থেকে আসলে ভালো ভাবে ডাবল ক্লিনজিং করে মুখ পরিষ্কার করুন।
- সপ্তাহে অন্তত ৩ দিন চুলে শ্যাম্পু করুন।
- ত্বকে রিফ্রেশমেন্ট এর জন্য শসা এবং আলু ব্লেন্ড করে ফ্রিজে আইস কিউব করে রাখতে পারেন। বাহির থেকে এসেই একটি পাতলা কাপড়ে মুড়িয়ে এটি ত্বকে ব্যবহার করলে একদিকে এটি যেমন আপনার ত্বকের রোদে পোড়া ভাব দূর করবে ঠিক তেমনি আলাদা একটা রিফ্রেশমেন্ট ও পাবেন।
হিট স্ট্রোক কি?
অতিরিক্ত গরমে শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা হারিয়ে ফেললে একে হিট স্ট্রোক বলা হয়। হিট স্ট্রোকের ফলে শরীর তার কার্যক্ষমতা হারিয়ে ফেলে । হিট স্ট্রোকের ক্ষতিকর দিক গুলো এতোটাই বেশি যে প্রতি বছর হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত হয়ে দেশের বিভিন্ন এলাকাতে বহু মানুষ মারা যান
যাদের হিট স্টোকের সম্ভাবনা তুলনামূলক বেশী
- শিশু
- বয়স্ক ব্যক্তি
- প্রতিবন্ধী ব্যক্তি
- অতিরিক্ত ওজনের সমস্যায় ভুগছেন যারা
- হৃদ্রোগ ও উচ্চ রক্তচাপে আক্রান্ত ব্যক্তি
- শ্রমজীবী মানুষ ( যারা দীর্ঘক্ষণ বাহিরে রোদে কাজ করে থাকেন)
হিট স্ট্রোক এর লক্ষণ সমূহ
হিট স্ট্রোক সম্পর্কে আমরা অনেকেই পর্যাপ্ত তথ্য জানি না। এতে করে অনেক সময় অসচেতন তার কারণেই মারাত্মক ক্ষতি হতে পারে আমাদের। নিচে হিট স্ট্রোক এর লক্ষণ গুলো রয়েছে-
- মাথা ব্যথাঃ প্রচণ্ড গরমে মানুষের মাইগ্রেন ট্রিগার করে। এতে করে মাথা ব্যথা বেড়ে যায়।
- বমিঃ গরমে যদি হুট করে বমি বমি ভাব দেখা যায় তাহলে এটি হিট স্টোক এর লক্ষণ।
- শ্বাস-প্রশ্বাসে কষ্টঃ হিট স্ট্রোকের সময় হৃৎপিণ্ড দ্রুত স্পন্দন করে। এতে করে শ্বাস-প্রশ্বাসে সমস্যা দেখা যায়।
- অল্প তে হাপিয়ে উঠাঃ শরীরে অতিরিক্ত ক্লান্তি অনুভব করা এবং অল্পতে হাপিয়ে ওঠা হিট স্টোকের অন্যতম লক্ষণ।
- ত্বক লালচে হয়ে যাওয়াঃ শুধু ত্বক লালচে হয়ে যাওয়াই না বরং ত্বকে জ্বালাপোড়া সমস্যা ও ত্বক শুষ্ক হওয়া হিট স্টোকের লক্ষণ।
- ঘাম বন্ধ হয়ে যাওয়াঃ হিট স্টোকের রোগিদের প্রচণ্ড গরম অনুভব হলেও তাদের শরীর থেকে ঘাম নির্গত হয় না। হুট করেই প্রচণ্ড গরমে গা না ঘামলে অবশ্যই সতর্ক থাকবেন।
- প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যাওয়াঃ এ সময় প্রস্রাবের পরিমাণ কমে যায় এবং গাঢ় হলুদ রঙের প্রস্রাব হতে পারে।
- অজ্ঞান হয়ে যাওয়াঃ অতিরিক্ত উত্তাপে শরীর সঠিকভাবে কাজ না করলে অজ্ঞান হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। অসংলগ্ন কথা বার্তাঃ যেহেতু হিট স্ট্রোকে আক্রান্ত ব্যক্তির শরীরের সাথে সাথে মস্তিষ্ক ও কাজ করা বন্ধ করে তাই এসময় রোগী অসংলগ্ন কথা বলে থাকে।
হিট স্ট্রোক প্রতিরোধের উপায়
- পর্যাপ্ত বিশুদ্ধ পান পান করুন।
- যথা সম্ভব রোদ থেকে দূরে থাকুন।
- দুপুরের রোদে বাচ্চাদের খেলা ধুলা থেকে বিরত রাখুন।
- প্রখর রোদ বা বাহির থেকে এসেই ফ্রিজের ঠান্ডা পানি পান করবেন না।
- ঢিলেঢালা ও হালকা রঙের কাপড় পরিধান করুন।
- অ্যালকোহল যুক্ত খাবার এবং চা-কফি খাওয়া থেকে বিরত থাকুন।
- প্রতিদিন ঠান্ডা পানিতে গোসল করুন। তাপমাত্রার উপর নির্ভর করে দুই বার গোসল করতে পারেন।
- প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় সবুজ শাকসবজি ও রসালো ফল রাখুন।
- সহজে হজম হয় এমন খাবার খান ।
এই গরমে নিজের ও প্রিয়জনের যত্ন নিন। সচেতন থাকুন এবং নিজ নিজ অবস্থান থেকে চেষ্টা করুন অন্তত একটি করে গাছ লাগানোর জন্য।গাছ তাপমাত্রা কমাতে এবং পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রাখতে সাহায্য করে।