গ্রাম বাংলার অত্যন্ত সুপরিচিত একটি ফল চলতা। বর্ষাকালে এই ফলটির দেখা মেলে এবং শীতকাল অব্দি পাওয়া যায়। চালতা গাছের ফুলের বৃতিকেই মূলত চালতা ফল বলা হয়। পাকা চালতা লবন ও মরিচ দিয়ে মাখিয়ে খেতে লোভনীয়। এছাড়াও টক ডাল, চাটনি ও আচার অনেকের প্রিয়।
টক ঝাল মিষ্টি চালতা আচার দেখলেই মুখে পানি চলে আছে। আচারের দোকান থেকে চালতার আচার খাওয়া হয়েছে। আচারওয়ালা মামা স্কুল কলেজের গেট ও রাস্তার ধারে মজার স্বাদের চালতার আচার নিয়ে বসতেন। আবার অনেকে বাড়িতেও চালতার আচার তৈরি করে থাকেন। খেতে বেশ সুস্বাদু হওয়ায় প্রায় সকলের পছন্দের তারিকায় রয়েছে।
চালতা আচার
অন্যান্য আচারের মধ্যে এই চালতার আচারটি অন্যতম। এই আচারটি ছোট বড় সবাই পছন্দ করে থাকেন। খিচুড়ি, গরম ভাতের সাথেই পরিবেশন করা যায়। অন্যদিকে বাজারের তৈরি চালতা কতটা স্বাস্থ্যসম্মত সেটা আমরা নিশ্চিত নয়। তাই ঘরোয়াভাবে মানসম্মত আচার তৈরি করা যেতে পারে। তবে অনেকেই এই আচার তৈরির প্রসেস সম্পর্কে জানেন না। তাই আমরা আজ চালতার আচারের সহজ রেসিপি সম্পর্কে লিখবো-
রেসিপি
উপকরণ
- চালতা ১টি
- হলুদ ও লবন পরিমাণ মতো ( চালতা সিদ্ধ করার সময়)
- সরিষার তেল হাফ কাপ
- শুকনো লাল মরিচ ২টি
- এলাচ ৩টি,
- দারুচিনি ২টি
- তেলপাতা ২টি
- রসুন বাটা ১ চা চামচ
- সরিষার বাটা ১ চামচ
- চিনি/ গুড় হাফ কাপ
- ভিনেগার ১ চা চামচ
মসলা তৈরির জন্য
- মৌরি/মিষ্টি জিরা ১ চা চামচ
- আস্ত ধরিয়া ১ চা চামচ
- পাঁচফোড়ন ১ চা চামচ
- জিরা ১ চা চামচ
- শুকনো লাল মরিচ ২টি
আমের আচার কিভাবে তৈরি করা হয়? কেন খাবেন?
প্রণালী
- চালতা প্রথমে ভালো করে ধুয়ে নিতে হবে। বটি বা ধারালো ছুড়ি দিয়ে মাঝ বরাবর কেটে নিতে হবে। মাঝের আঁটি কেটে ফেলে দিতে হবে। তারপরে পাতলা করে কেটে নিতে হবে। যতটা সম্ভব পাতলা করার চেষ্টা করতে হবে। এতে আচার খেতেও বেশি মজা হবে। এরপরে উপরের সবুজ অংশগুলো ছাড়িয়ে নিতে হবে।
- চালতাগুলো কেটে নেওয়ার পরে পরিষ্কার পানি দিয়ে ধুয়ে নিতে হবে। চুলায় একটি প্যান বসিয়ে চালতা, পানি, লবন ও হলুদের গুড়ো দিয়ে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে সিদ্ধ করে নিতে হবে। চুলা থেকে পানিয়ে ঠান্ডা করতে হবে। ঠান্ডা হয়ে এলে থেতো করে নিতে হবে।
- একটি চুলায় প্যান বসিয়ে মসলা তৈরির জন্য যেসকল উপকরণ রয়েছে সবগুলো একসাথে মাঝারি আচেঁ ভেজে নিতে হবে। ঠান্ডা হলে গুড়ো করে নিতে হবে।
- এবার চুলায় অন্যএকটি কড়াই বসিয়ে সরিষার তেল দিয়ে আস্তগরম মসলা দিতে হবে। এরমধ্যে রসুন বাটা দিয়ে একটু নেড়ে নিতে হবে। সরিষা বাটা, থেতো করা চালতা, আচারের মসলা, গুড় বা চিনি দিতে হবে। এরপরে ভিনেগার দিয়ে অল্প আচে অনবড়ত নাড়তে হবে। ঝোল টেনে এলে আরও কিছুক্ষণ নেড়ে চুলা থেকে নিমেয়ে নিতে হবে। ব্যস হয়ে গেলো মজাদার চালতার আচার।
চালতা আচারের পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা
চালতা টক জাতীয় একটি ফল। এতে রয়েছে ঔষধিগুণ যেমন প্রোটিন, ক্যালসিয়াম, শর্করা, আমিষের মতো প্রয়োজনীয় উপাদান। এছাড়াও ভিটামিন সি, ভিটামিন এ ,আয়রন ও পটাসিয়াম ইত্যাদি স্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টিকর উপাদান। চালতায় যেসকল গুণাগণ বিদ্যমান, চালতার আরেও কমবেশি সেসকল পুষ্টি পাওয়া যায়। চালতার আচার খেতে মুখোরচক সেই সাথে স্বাস্থ্য গুণাগুণে ভরপুর। চলুন কিছু স্বাস্থ্য উপকারিতা সম্পর্কে জেনে নেওয়া যাক-
স্কার্ভি থেকে সুরক্ষা
ভিটামিন সি এর অভাবজনিত একটি রোগের নাম হলো স্কার্ভি। যেহেতু চালতা ভিটামিন সি যুক্ত ফল। তাই এই আচার খেলে স্কার্ভি থেকে সুরক্ষা পাওয়া যেতে পারে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে
চালতায় অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট বিদ্যমান হওয়ার এটি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে পারে। তাই নিয়মিত চালতার আচার খাওয়া যেতে পারে।
রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে
এত থাকা পটাসিয়াম রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। যাদের উচ্চ রক্তচাপের সমস্যা রয়েছে তারা চালতার আচারটি খেলে উপকার পাবেন।
ঠান্ডাজনিত সমস্যা প্রতিরোধে
যারা ঠান্ডাজনিত সমস্যায় যেমন গলা ব্যথা, সর্দি, বুকে কফ জমা ইত্যাদিতে ভুগছেন তাদের জন্য চালতার আচার বেশ উপকারি।
রক্তশূন্যতা দূর করে
শরীরে আয়রনের ঘাটতির ফরে রক্তশূন্যতা দেখা যায়। চালতায় আয়রন রয়েছে। নিয়মিত চালতার আচার খাওয়া যেতে পারে। ফলে রক্তশূন্যতা দূর করতে সাহায্য করে।
হাড় মজবুত করতে
বয়স বাড়ার সাথে অনেকের হাড়ে বিভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। চালতায় প্রচুর ক্যালসিয়াম রয়েছে যা হাড়কে মজবুত করতে সহায়ক। এক্ষেত্রে প্রতিদিনের খাদ্য তালিকায় চালতার আচারটি রাখা যেতে পারে।
হজম শক্তি বৃদ্ধি
চালতায় থাকা পুষ্টিগুণ হজম শক্তি বাড়াতে সহায়তা করে। যারা বদহজমের সমস্যার ভুগছেন তারা চাইলে চালতার আচারটি পরিমাণমতো খেতে পারেন। সেই সাথে কোষ্ঠকাঠিন্য সমস্যা থাকলে সেটিও দূর হবে।
ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে
ক্ষতিকারক কোলেস্টরল ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে চালতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এবং রক্ত পরিষ্কার করে থাকে। তাই চালতার আচারটিও খাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে ডক্টরের পরামর্শ নিয়ে খেতে হবে।
চালতা আচারের খাওয়ার অপকারিতা
- চালতার আচার অতিরিক্ত সেবন করার ফলে পেটে গ্যাসের সৃষ্টি হতে পারে। তাই পরিমাণমতো এই আচারটি খেতে হবে।
- যাদের অ্যালার্জির সমস্যা রয়েছে, চালতার আচার খাওয়ার ফলে অ্যালার্জি প্রতিক্রিয়া হয়ে শ্বাসকষ্ট, চুলকানি বা ফুসকুড়ি দেখা দিতে পারে। সেক্ষেত্রে এই আচারটি না খাওয়াটাই উত্তম।
- যারা জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত তারা চালতার আচার খাওয়ার আগে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিবেন। অন্যথায় ঔষধের সাথে প্রতিক্রিয়া হয়ে আরও জটিল সমস্যা বেড়ে যেতে পারে।
- যেকোনো খাবার যতই আমাদের জন্য উপকারী হোক না কেনো, সেটা পরিমাণমতো খেতে হবে। কারণ অতিরিক্ত কোনো কিছুই ভালো নয়। এতে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে। সেক্ষেত্রে চালতার আচারটি নিয়মিত খেতে চাইলে পরিমাণের বেশি খাওয়া যাবেনা।
গর্ভাবস্থায় চালতা আচার খাওয়া যাবে কি
গর্ভাবস্থায় চলাকালীন গর্ভবতি মহিলারা টক জাতীয় খাবার ও আচার খেতে পছন্দ করেন। যেহেতু চালতায় প্রচুর ভিটামিন রয়েছে তাই চালতা ফলটি খাওয়ার ফলে গর্ভে থাকা শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশে সাহায্য করার পাশাপাশি দৃষ্টি শক্তি ভালো রাখে। এই সময়টায় যেহেতু খাবারের অরুচি দেখা দেয় তাই এই চালতা খাওয়ার ফলে রুচি বৃদ্ধি হয় এবং হজমের সমস্যা দূর করে। এছাড়াও উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে ভূমিকা পালন করে।
তবে খালি পেটে কখনোই এই ফলটি খাওয়া যাবেনা। এতে পেটের বিভিন্ন সমস্যা দেখা দিতে পারে। সাথে গর্ভে থাকা শিশুরটির হতে পারে সমস্যা। পরিমাণ মতো চালতা খাওয়া গেলেও চালতার আচার খাওয়া খেতে বিরত থাকতে হবে। সর্বশেষে, যেকোনো খাবার খাওয়ার আগে ডক্টরের পরামর্শ নিতে হবে।
চালতার আচার সংরক্ষণ পদ্ধতি
- চালতার আচার দীর্ঘদিন সংরক্ষণের জন্য একটি কাচের পাত্রে রাখুন।
- আচারে অবশ্যই সরিষার তেল ব্যবহার করতে হবে। অন্য তেল আচারের ব্যবহার করা যাবে না।
- আচার খাওয়ার জন্য চামচ ব্যবহার করুন। ভেজা হাতে আচার স্পর্শ করা থেকে বিরত থাকুন।
- ফ্রিজে রেখেও দীর্ঘদিন পর্যন্ত সংরক্ষণ করা যাবে। তবে ফ্রিজ থেকে আচার বের করে মাঝে মাঝে হালকা রোদে দিতে হবে।
উপরিউক্ত আলোচনায় চালতা আচার কি, তৈরি পদ্ধতি, উপকারিতা, সতর্কতা, রেসিপি এবং এর সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এই লেখাটি পড়ার পড়ে আপনি বাসায় বসে ঘরোয়াভাবে চালতা আচার তৈরি করে পরিবার নিয়ে মজা করে খেতে পারবেন।