ডায়াবেটিস রোগীর খাবারের তালিকা সাধারণত অন্যদের থেকে আলাদা হয়ে থাকে। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে একটি স্বাস্থ্যকর খাদ্যভ্যাস থাকা অন্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ডায়াবেটিস মানেই যে সব ধরনের খাবার খাওয়া নিষেধ এমনটি নয়। ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণের জন্য খাদ্য বাছাইয়ে বিশেষভাবে সর্তকতা অবলম্বন করা জরুরী। যা দেহের প্রয়োজনীয় শক্তির যোগান দিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে ভালো রাখতে সাহায্য করবে।
ডায়াবেটিস হলেই কি খাবার খাওয়া একেবারেই বাদ দিতে হবে? চোখের সামনে খাবার দেখেও হয়তো অনেকেই খেতে পারেন না। কারণ হলো ডায়াবেটিস! তবে এই রোগ নিয়ন্ত্রণে রেখেও খাবার খাওয়া যাবে পরিমাণ মতো। অর্থাৎ পুষ্টিকর খাদ্য তালিকা তৈরি করলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। আজকের আলোচনায় ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য খাবারের তালিকা সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
ডায়াবেটিস
ডায়াবেটিস হলো শরীরের এমন একটি গুরুতর অবস্থা, যখন আমাদের শরীর নিজে থেকে ইনসুলিন তৈরি করতে পারে না বা তৈরি হওয়া ইনসুলিন দক্ষতার সঙ্গে (কার্যকরভাবে) ব্যবহার করতে পারে না। এর ফলে রক্তে শর্করার বা গ্লুকোজের মাত্রা স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি হয়।
ইনসুলিন মানুষের শরীরের কোষগুলিতে শর্করা প্রবেশ নিয়ন্ত্রন করে। অর্থাৎ একটি চাবি হিসেবে কাজ করে এই ইনসুলিন। এর দ্বারা আমাদের খাবার থেকে যে চিনি বা শর্করা পাওয়া যায়, তা রক্তের মধ্য দিয়ে বাহিত হয়ে কোষের মধ্যে প্রবেশ করতে পারে। তারপর কোষ শরীরের প্রয়োজনীয় শক্তির জন্যে সেই গ্লুকোজ ব্যাবহার করে।
ডায়াবেটিস চিকিৎসা
টাইপ ১ঃ ডায়াবেটিস নিরাময় এ যদি টাইপ ১ হয়ে থাকে তবে খাদ্যাভাস, ব্যায়াম, মানসিক চাপ, আবেগ এবং সাধারণ স্বাস্থ্য ইত্যাদির উপর জোর দেওয়া হয়ে থাকে। এসবে নিয়ন্ত্রণ নিয়ে আসতে পারলে টাইপ ওয়ান ডায়াবেটিস কমানো সম্ভব পাশাপাশি সঠিক মাত্রায় ইনসুলিন পাম্প করতে হবে।
টাইপ ২ঃ এক্ষেত্রে ডায়েট ব্যায়াম এবং ওজন কমানোর উপর জোর দেন।
ডায়াবেটিস এর উভয় ধরণের ক্ষেত্রেই দেখা যায় এটি নিরাময়ে খাদ্যাভাস এর উপর বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে।
ডায়াবেটিস রোগীর খাদ্য তালিকা
নিয়ন্ত্রিত খাবারের মধ্যে প্রথমেই আসে মিষ্টি খাবার। যেমন – চিনি, গুড়, মধু, গ্লুকোজ না খাওয়া। এ ছাড়া আমিষ বা প্রোটিন এবং চর্বি ফ্যাট স্বাভাবিক মাত্রায় গ্রহণ করা। সকালের নাস্তার সময় থেকে রাতে ঘুমাতে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত প্রতি তিব থেকে সাড়ে তিন ঘন্টা পরপর খাবার খেতে হবে। ঔষধ ও খাবারের মধ্যে একটা সমন্বয় থাকতে হবে।
শর্করা যুক্ত খাবার খাওয়া
ধীরে ধীরে শোষিত হয় এমন শর্করা হলো জটিল বা পলিস্যাকারাইড। ভুষি যুক্ত আটার রুটি, লাল চাল, ভুট্টার খই, খেজুর আশযুক্ত শাক সবজি ও ফল হলো জটিল শর্করা। যদি কারও খাবারে শর্করা বাড়ানোর প্রয়োজন হয় তাহলে এ ধরণের শর্করা দিয়ে বাড়ানো যেতে পারে। এতে ডায়াবেটিস তেমন বাড়বে না। এদিকে দ্রুত শোষিত হয় এমন শর্করা হলো আশবিহীন মিষ্টি ফল, দুধ, আতপ চাল, ময়দা। এগুলো সঙ্গে বা ডাইসাকারাইড। এ ধরণের শর্করা সব সময় সীমিত পরিমানে খাওয়া উচিত। আবার প্রতিটি শর্করাযুক্ত খাবার সমানভাবে রক্ত শর্করা বাড়ায় না। খাবারের ঘনত্ব ও সময়ের ওপর রক্ত শর্করা বাড়তে পারে। সমস্যা হলো কিছু শ্বেতসারজাতীয় খাবার খুব দ্রুত রক্তে সুগার তথা গ্লুকজের মাত্রা বাড়িয়ে দেয়, ফলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে রাখা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। এসব খাবারকে বলা হয় উচ্চ ‘গ্লাইসেমিক ইনডেক্স (জিআই)’ – যুক্ত খাবার।
গ্লাইসেমিক ইনডেক্স ( জিআই)
গ্লাইসেমিক ইনডেক্স এমন একটি স্কেল যা একটি খাবার রক্তে সুগারের মাত্রা কত দ্রুত বা ধীরে ধীরে বাড়িয়ে দেয় তার উপর ভিত্তি করে বানানো। যেসব খাবার রক্তে সুগারের মাত্রা দ্রুত বাড়িয়ে দেয়, সেগুলোর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স বেশি, আর যেগুলো রক্তে সুগারের মাত্রা কে ধীরে ধীরে প্রভাবিত করে সেগুলোর গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম ।
কম গ্লাইসেমিক ইনডেক্সযুক্ত শ্বেতসার যুক্ত খাবার
- লাল চালের ভাত
- লাল আটার রুটি
- বাসমতি চালের ভাত
- লাল আটার পাস্তা ও নুডলস
- খোসাসহ সেদ্ধ বা বেক করা মিষ্টি আলু
- মাল্টি গ্রেইন ও হোলগ্রেইন পাউরুটি
এই ধরণের খাবারে আশের পরিমাণও বেশি থাকে, যা আপনার পরিপাকতন্ত্রের কার্যক্রমকে সহায়তা করে। সাদা চালের ভাত, ময়দার রুটি ও সাধারণ পাউরুটি খাওয়া কমিয়ে দিলে ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ সহজ হয়।
শর্করাযুক্ত খাবারের উপকারিতা
- এ ধরণের খাবার আশযুক্ত যা আপনার পরিপাকতন্ত্রকে সুস্থ্য রাখে।
- কিছু শর্করা ধীরে ধীরে রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়ায়, ফলে এটি ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে সহায়ক।
- গোটা শস্যদানা হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখতে সাহায্য করে।
ফলমূল ও শাকসবজি
ডায়াবেটিস থাকলেও আপনি ফলমূল ও শাকসবজি খেতে পারেন । আসলে এগুলো আপনার স্বাস্থ্য রক্ষার জন্য অন্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ । শাকসবজি ও ফলমূল সাধারণত ক্যালোরিতে কম এবং ভিটামিন, খনিজ পদার্থ ও আশে পরপূর্ন, যা আপনার শরীরের পুষ্টির পূরণ করে । তাজা, ড্রাইফ্রুট বা ফ্রোজেন বা ক্যানের প্রক্রিয়াজাত যেকোনো ধরণের ফল ও শাকসবজি খাওয়া যেতে পারে। যত প্রকারের রং-বেরঙের ফলমূল ও শাকসবজি খাবেন ততই ভালো। তবে ফলের জায়গায় এগুলোর জুস ও স্মুদি খাওয়া যাবে না, কারণ এগুলোতে আশের পরিমান কম থাকে।
অনেকেই লো-কার্ব ডায়েটের জন্য খাদ্যতালিকা থেকে ফল ও শাকসবজি বাদ দিয়ে দেন। কিন্তু এগুলো বাদ না দিয়ে বরং শর্করাযুক্ত ফল ও শাকসবজি বেছে নেওয়া ভালো। ডায়াবেটিস থাকলেও ফল ও শাকসবজি খাওয়া অনেক উপকারিতা রয়েছে।
ফল ও শাকসবজি খাওয়ার উপকারিতা
- পরিপাকতন্ত্রকে সঠিকভাবে কাজ করতে সহায়ক।
- হার্টের বিভিন্ন সমস্যা, স্ট্রোক এবং কিছু ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে শক্তিশালী করে।
ডায়াবেটিস রোগীদের জন্যে ফল ও সবজী
- এক ফালি জাম্বুরা বা বাঙ্গি সাথে টক দই সামান্য।
- মৌসুমি ফল যেমন খেজুর, আলুবোখারা।
- রান্নায় গাজর, মটরশুটি, বরবটি বা শিম ব্যাবহার করা ।
- ভাতের সাথে মটরশুটি, অথবা মাংসে বেশি পেয়াজ ও পালংশাক যোগ করতে পারেন।
- কম শর্করাযুক্ত শাকসবজী এর মাঝে মাশরুম, শশা, পালংশাক, বাধাকপি, ব্রকলি ও লেটুস পাতা উল্লেখ্যযোগ্য।
- বরই, তরমুজ, এভোক্যাডো ইত্যাদি এবং বিভিন্ন ধরণের বেরি ডায়াবেটিস রোগীদের জন্য কম শর্করাযুক্ত ফলের দুর্দান্ত উৎস।
প্রোটিনযুক্ত খাবার
ডিম, মাছ ও মাংসে প্রচুর প্রোটিন থাকে যা পেশীকে শক্তিশালী রাখে। তবে স্বাস্থ্যকর খাদ্যাভাস গড়ে তুলতে লাল মাংস ( গরু, খাসি, ভেরা) ও প্রক্রিয়াজাত মাংস খাওয়ার পরিমান কমিয়ে দিতে হবে । কারন এই ধরণের মাংসের সাথে ক্যান্সার ও হৃদরোগের সম্পর্ক রয়েছে।
তৈলাক্ত মাছ যেমন ( স্যামন, সার্ডিন) ও সামুদ্রিক মাছ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিডের সমৃদ্ধ উৎস, যা হৃদযন্ত্রকে সুরক্ষা দেয় । এছাড়াও শিম, ডাল, বীণজাতীয় খাবার ও বাদাম ভেগান বা নিরামিষদের জন্যে ভালো উৎস হিসেবে কাজ করে।
প্রোটিনযুক্ত খাবারের উপকারিতা
- প্রোটিন পেশী সুস্থ্য রাখে
- তৈলাক্ত মাছ হৃদরোগ প্রতিরোধে সহায়তা করে
ডায়াবেটিস রোগীর জন্যে প্রোটিনযুক্ত খাবার
- নাস্তায় মুঠোভর্তি বাদাম খাওয়া যেতে পারে ।
- ডালের বিভিন্ন পদ রান্না করতে পারেন ।
- ডিম সেদ্ধ, পোচ বা ভাজা খেতে পারেন ।
- মাছ ও মাংস কম তেলে ও মশলায় রান্না করে বা বেক করে খেতে পারেন।
তেল, মাখন, ও ঘি
চর্বি ও তেল আমাদের শরীরের জন্যে অত্যান্ত গুরুত্ত্বপূর্ন পুষ্টি উপাদান। এটি প্রধানশক্তি গুলোর মাঝে অন্যতম । বিশেষ করে, চর্বি শরীরে বিভিন্ন ভিটামিনের শোষণ নিশ্চিত করতে সহায়ক। তবে ধরণের চর্বি সমান নয়, এবং ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রে চর্বি নির্বাচন খুবই সতর্কতার সাথে করতে হবে, স্যাচুরেটেড ফ্যাট বা সম্পৃক্ত চর্বি রক্তে খারাপ কোলেস্টরল এর মাত্রা বাড়িয়ে দেয় , যা হার্টের রোগ ও স্ট্রোক এর ঝুকি বাড়াতে পারে। তাই বলা যায় ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্যতালিকায় সঠিক ধরণের চর্বি অন্তর্ভুক্ত করাটা গুরুত্ত্বপুর্ণ।
এক্ষেত্রে অলিভ ওয়েল, ক্যানোলা ওয়েল, সূর্যমুখী তেল, বাদামজাত তেল অসম্পৃক্ত ফ্যাটের চমৎকার উৎস । এগুলো শুধু হার্টের জন্যেই ভালো নয় , রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে । এছাড়াও বাদাম ও বীজ জাতীয় খাবার যেমন পিনাট বাটার, আমন্ড বাটারও চমৎকার স্বাস্থ্যকর চর্বির উৎস।
চর্বি, তেলের উপকারিতা
- হৃদরোগের ঝুকি কমায়ঃ অসম্পৃক্ত ফ্যাট রক্তে খারাপ কোলেস্টরলের মাত্রা কমিয়ে এবং ভালো কোলেস্টরলের মাত্রা বাড়িয়ে হৃদরোগের ঝুকি কমাতে সহায়ক।
- শক্তির উৎসঃ চর্বি শরীরে শক্তি সঞ্চয়ের কাজ করে এবং এটি আমাদের শরীরকে দীর্ঘস্থায়ী শক্তি প্রদান করে।
- রক্তে শর্করার নিয়ন্ত্রণঃ সঠিক ধরনের চর্বি রক্তে শর্করার মাত্রা নিয়ন্ত্রণ রাখতে সহায়তা করে যা ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে গুরুত্ত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে।
এছাড়াও দুগ্ধজাত খাবার ও সুষম খাবার নিয়মিত খেতে হবে । আমরা খাবারের পুষ্টি উপাদান এর ভিত্তিতে ডায়াবেটিস রোগীদের খাবার সম্পর্কে জানলাম এবার জেনে আসি কোন খাবার গুলো এসময় বেশি উপকারী যা নিয়মিত খেলে বিশেষভাবে উপকারী-
- মোটা সেদ্ধ লাল চাল
- লাল আটা
- জবের আটা
- ওটস
- চিবিয়ে খেতে হয় এমন ফল ( আপেল, নাশপাতি, পেয়ারা)
- সব ধরনের শাক
- গাজর
- লাউ
- পেঁপে
- চালকুমড়া
- দুধ
- টক দই
এগুলো গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম হওয়াতে এগুলো ধীরে ধীরে গ্লুকোজ সরবরাহ করে, যা রক্তে শর্করার মাত্রা বাড়তে দেয় না এবং ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রনে সহায়তা করে।
উপরোক্ত আলোচনায় আমরা ডায়াবেটিস কি ও ডায়াবেটিস রোগেীর খাদ্যতালিকা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। অনেক সময় ডায়াবেটিস রোগীদের খাদ্য তালিকা নিয়ে আমরা বিভ্রান্তিতে পরে যাই। আশা করছি এই লেখাটি পরে সঠিক ধারণা পেয়ে যাবেন। এবং পরিবারের কেউ ডায়াবেটিস রোগী থাকলে তাদের জন্য একটি পুষ্টিসমৃদ্ধ খাবারের তালিকা তৈরি করতে পারেন।