প্রত্যেকের ঘরেই বয়স্ক মানুষ যেমন মা-বাবা, দাদা-দাদি থাকেন। পরিবারের বয়স্ক সদস্যরা একটি গাছের ছায়ার মতো আমাদের পাশে থাকেন। আমাদের ছোটবেলায় তারা আদর যত্ন করে মানুষ করে তোলেন। এবং একসময় আমরা বড় হয়ে যাই। অন্যদিকে শেষ বয়সে এসে তাদের সেবা যত্নের প্রয়োজন হয়।
আমাদের পরিবারের বয়স্ক সদস্যরা গুরুত্বপূর্ণ ও অবিচ্ছেদ্য অংশ। তাদের জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা দিয়ে পরিবার ও সমাজে অবদান রাখেন। তাই প্রবীণদের প্রতি আমাদের কিছু দায়িত্ব রয়েছে। শেষ বয়সে আমাদের উচিত তাদের প্রয়োজনীয় চাহিদা মেটানো ও সেবা যত্ন করা। তাই প্রবীণদেরক কখনোই বোঝা মনে করা উচিত নয়। আজকের আর্টিকেলে আমরা বয়স্কদের যত্ন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করবো।
বয়স্ক ব্যাক্তিদের যত্ন
বয়স্কদের যত্নের দিকে বিশেষ নজর দেওয়া একান্ত জরুরি। তারা ছোটকাল থেকে আমাদের কষ্ট করে মানুষ করেছেন। বয়স বাড়ার সাথে সাথে তারা শিশুর মতো হয়ে যান। এই সময়ে তাদের যত্নের প্রয়োজন হয়। তাই তাদের দিকে বিশেষ ভাবে খেয়াল রাখতে হবে। এবং সবসময় তাদের পাশে থাকতে হবে। মানসিক ও শারীরিকভাবে বিশেষ যত্ন নেওয়াটা যেমন গুরুত্বপূর্ণ তেমনটি পরিবারের সদস্য হিসেবে আমাদের নৈতিক দায়িত্ব। চলুন বয়স্কদের যত্ন সম্পর্কে বিস্তাতির জেনে নেওয়া যাক-
বয়স্কদের শারীরিক যত্ন
নিয়মিত চিকিৎসা ও পরীক্ষা
প্রবীণ সদস্যদের বসয় বাড়ার সাথে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে যায়। এই সময় বিভিন্ন রোগ শরীরে বাসা বাধতে শুরু করে। যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি। তাই পরিবারের বয়স্কদের নিয়মিত চিকিৎসা পরীক্ষা করানো উচিত। শরীর অসুস্থ হলে গেলে চিকিৎসকের কাছে নিয়ে যেতে হবে। এবং প্রয়োজনীয় ওষুধ সময় মতো খাওয়াতে হবে। কারণ এই বসয়ে তাদের ওষুধ খাওয়ার কথা মনে থাকে না। এবং কোন ওষুধ কখন খেতে হবে তারা বুঝতে পারেনা। এই বিষয়ে আমাদের সর্তকতা অবলম্বন করতে হবে। ওষুধ খাওয়ার কথা মনে করিয়ে দিতে হবে। অথবা নিজেদেরকে খাইয়ে দিতে হবে।
স্বাস্থ্যকর খাদ্য
বয়স্ক ব্যাক্তিদের খাবারের তালিকা একটু আলাদা রাখা উচিত। মূলত প্রতিদিনের খাবারের তালিকায় সুষম খাদ্য রাখতে হবে। যেমন প্রচুর শাকসবজি, দুধ, ফলমূল ইত্যাদি। এবং যতটা সম্ভব অতিরিক্ত তেল ও মসলাযুক্ত খাবার খাওয়ানো থেকে বিরত রাখতে হবে। তাদেরকে স্বাস্থ্যকর খাবার খাওয়ানোর অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এতে করে তাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেড়ে যাবে। সহজে রোগ শরীরে প্রবেশ করতে পারবে না। তারা সুস্থ স্বাভাবিকভাবে জীবন কাটাবে।
নিয়মিত ব্যায়াম
শরীরকে ফিট ও সুস্থ রাখতে ব্যায়াম গুরুত্বপূর্ণ। তাই বয়স ভেদে কার জন্য কেমন উপযুক্ত ব্যায়াম হবে সেটা আগে নির্ধারণ করতে হবে। এরপরে বয়স্কদের নিয়মিত ব্যায়াম করাতে হবে। যা তাদেরকে শক্তিশালী হতে সাহায্য করবে।
বয়স্কদের মানসিক যত্ন
সামাজিক সংযোগ
কর্মব্যস্ততার কারণে আমরা অনেক সময় পরিবারের বয়স্ক সদস্যদের সাথে যোগাযোগ করতে পারিনা। যার ফলে তারা একাকিত্ব বোধ করতে থাকেন। তাই সামাজিকভাবে সক্রিয় ও প্রিয়জনদের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করতে হবে। সেই সাথে কিছু সময় বের করে তাদের সাথে সুন্দর সময় কাটানোর চেষ্টা করতে হবে। এতে তারা মানসিকভাবে আনন্দ অনুভব করবে।
মানসিক স্বাস্থ্যের যত্ন
প্রবীণ ব্যাক্তির মধ্যে অনেক সময় বিষন্নতা দেখা যায়। তাই তাদের মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি বিশেষ নজর রাখা জরুরী। প্রয়োজন হলে বিশেষজ্ঞের নিকট শরানাপন্ন হওয়া উচিত। পাশাপাশি নিয়মিত ঘুম, স্বাস্থ্যকর খাবার, শারীরিক ব্যায়াম ইত্যাদি নিয়মগুলো মেনে চললে মানসিক স্বাস্থ্যে ভালো থাকবে।
পছন্দের কাজে নিযুক্ত থাকা
প্রায় সকলের পছন্দের কাজ থাকে। তেমনি বয়স্ক মানুষদের মস্তিষ্ক সচল রাখার জন্য তাদের পছন্দের কাজগুলো করতে সাহায্য করে। যেমন বই পড়া, বাগান পরিচর্যা করা ইত্যাদি। শখ বা পছন্দের কাজগুলো করার ফলে মনে এক ধরনের প্রফুল্লতা কাজ করে।
মানসিক চাপ কমাতে ধ্যান
একাকিত্ব ও অবসাদ থেকে মনসিক রোগে শিকার হতে পারেন প্রবীনরা। দীর্ঘদিন যাবৎ মানসিক চাপে থাকার ফলে আত্নহনেন দিকে ঝুঁকে পরেন অনেকেই। মানসিক চাপ কম বেশি সকলের থাকে। বসস্কদের মানসিক স্বাস্থ্য ও চাপ কমানোর জন্য প্রতিদিন ধ্যান বা মেডিটেশন করা উচিত। এতে মানসিক চাপ কমবে।
অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ বিষয়
আর্থিক নিরাপত্তা
বয়স্ক ব্যাক্তিদের অবসরের জন্য পরিকল্পনা করা উচিত। তাদেরকে সাধ্যমতো আর্থিক নিরাপত্তা দেওয়া জরুরি। ফলে তারাদের শেষ বয়সে এসে আর্থিক বিষয়টি নিয়ে চিন্তিত হতে হবেনা। যা তাদের জীবনযাত্রা আরও সহজ হতে সাহায্য করবে।
ঘরের পরিবর্তন
অনেক সময় বয়স্করা অসাবধানতার কারণে বাথরুমে যাওয়া আসা করার সময় পড়ে দিয়ে অঘটন ঘটে যায়। এমনিক বাসায় যদি সিঁড়ে থাকলে সিঁড়িতে উঠা নামা করার সময় বয়স্কব্যাক্তিরা পড়ে দিয়ে দুর্ঘটনার শিকার হন। এই বিষয়টি মোকাবেলার জন্য ঘরের পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
সহায়ক প্রযুক্তি
বয়স্কদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সহায়ক প্রযুক্তি রয়েছে। যেমন হুইলচেয়ার, ওয়াকার। এগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। এই ধরনের প্রযুক্তির সহায়তায় গুলো তাদের দৈনন্দিন কাজ করতে সাহায্য করবে।
সবসময় উৎসাহিত করা
তারা যেসকল কাজ করতে পছন্দ করেন সেগুলো কাজ করতে দেওয়া উচিত। যেমন বাগানে পানি দেওয়া, রান্নার কাজে সাহায্য করা, সংবাদ পত্র পাঠ করা ইত্যাদি। ছোট ছোট কাজে সবসময় তাদেরকে উৎসাহিত করা। এতে তারা আরও উৎসাহিত হবে। এবং সেই কাজগুলো করতে অনেকটা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করবে।
সহায়ক ব্যবস্থা
বর্তমানে বয়স্কদের জন্য অনেক সহায়ক ব্যবস্থা চালু হয়েছে। যেমন অ্যাডাল্ট ডে কেয়ার। প্রয়োজন হলে এগুলোর সাহায্য নেওয়া যেতে পারে। এতে যেকোনো সমস্যা হলে সহায়ক ব্যবস্থা থেকে দ্রুত সমাধানের উপায় পাওয়া যাবে।
প্রবীণদের জন্য দরকার আরও বাড়তি যত্ন
বয়স্ক পরিচর্যা যাকে বয়সস্ক যত্ন বলা হয়। প্রবীণ ব্যাক্তিদের দৈনন্দির কাজর্ম ও স্বাস্থ্যসেবা সহ বিভিন্ন সহায়তার প্রয়োজন হয়। তাদের জন্য নেওয়া পরিবারের অন্য সদস্যদের দায়িত্ব। বয়স বাড়ার সাথে ত্বকে বড়িরেখা পরে, চুল পেকে যায়, দৃষ্টিশক্তি লোপ পায়। এছাড়াও বিভিন্ন জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হয়ে পরেন অনেকে। পরবর্তীতে অসুস্থতার কারণে অনেক প্রবীন দীর্ঘদিন যাবৎ শয্যাশায়ী থাকেন।
শুধু তাই নয় তাদের স্মৃতিশক্তি হ্রাস হয়। মস্তিষ্কের কার্যক্ষমতা ধীরে ধীরে কমতে থাকে। তাদের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা কমে যাওয়ায় কারণে বিভিন্ন সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করতে পারে। তাই বয়স্কদের বিষয়ে সচেতন ও যত্নবান হওয়া উচিত।
- হাড় ভেঙে গেলে হাঁটার সময় লাঠি ব্যবহার করা উচিত।
- যতটা সম্ভব তাদেরকে হাসিখুশি রাখতে হবে।
- জটিল রোগ হলে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
- চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কখনোই এন্টিবায়োটিক ওষুধ খাওয়ানো যাবে না।
- নিয়মিত শরীরচর্চা, পর্যাপ্ত ঘুম ও বিশ্রামের ব্যবস্থা করা উচিত।
- সবসময় পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার মধ্যে রাখতে হবে।
- তাদের সাথে হাসি তামাশা করা যেতে পারে।
- তাদের দিকে আলাদা নজর নিতে হবে। সময়, র্ধৈয ও ভালোবাসা দিয়ে তাদের যত্ন নিতে হবে।
- বাসায় ছোট সদস্য থাকলে তাদের সাথে খেলতে দেওয়া প্রয়োজন। এতে শিশু ও প্রবীণ উভয়ই খেলার মাধ্যমে আনন্দ অনুভব করতে পারবে।
- অনেক সময় বাসায় থাকার কারণে একঘেয়েমি লাগতে পারে। তাই বয়স্কদের বিকেলে একটু ঘুরতে নিয়ে যাওয়া। অথবা বাড়ির পাশে খেলার মাঠ বা ছাদবাগানে দিয়ে কিছু সময় কাটানো।
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনায় বয়স্ক ব্যাক্তিদের যত্ন সম্পর্কে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো তুলে ধরা হয়েছে। যাদের বাসায় বয়স্ক ব্যাক্তি রয়েছে পরিবারের সদস্য হিসেবে প্রত্যেকের উচিত তাদের যত্নে ব্যাপারে সতর্ক থাকা। তাদেরকে কখনোই অবহেলা না করা। কারণ এতে তারা বিষন্নতা, একাকিত্বতা অনুভব করবে। পরবর্তীতে তারা মানসিক ভাবে বিপদগ্রস্থ হয়ে যাবে। পরিবারের যেকোনো বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে তাদের সাথে পরামর্শ করা উচিত। এতে তারা কখনই আলাদা বা অবহেলিত মনে করবে না।