ছোলা হলো একটি উচ্চ প্রোটিন ও পুষ্টিগুণ সম্পূর্ণ খাবার।অনেকের কাছে এটি বুট নামেও পরিচিত।ছোলা কে বলা হয় স্বাস্থ্যকর স্টিডফুড । রাস্তার ধারে বন্ধুদের সাথে ঝাল ঝাল ছোলা মাখা খাওয়ার অভিজ্ঞতা আমাদের অনেকেরই রয়েছে। নিয়মিত ছোলা খেলে আপনি পাবেন ভরপুর পুষ্টির নিশ্চয়তা। তাই স্বাস্থ্যসচেতন ও ভোষনরসিক মানুষদের খাবারের তালিকাতেও দিন দিন ক্রমশই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে এই ছোলা।
ছোলা তে রয়েছে প্রোটিন, কার্বোহাইড্রেট, শর্করা, ভিটামিন, ক্যালসিয়াম সহ আরও অনেক পুষ্টি উপাদান যা আমাদের স্বাস্থ্যকে উন্নত করতে সাহায্য করে। মজার বিষয় হলো এই ছোলা আপনি রান্না করে খাওয়ার পাশাপাশি কাঁচাও খেতে পারবেন। ছোলা খাওয়ার উপকারিতা এবং কীভাবে ছোলা খেলে আপনি সবচেয়ে বেশি উপকার পাবেন সেটি সম্পর্কেও জানতে পারবেন এই পুরো আর্টিকেল থেকে।
ছোলার পুষ্টিউপাদান
ছোলা মূলত একটি ডাল জাতীয় খাদ্যশস্য। সারা বিশ্বে ছোলার দুটি জাত বা ভ্যারিয়েন্ট রয়েছে। একটি হলো দেশি ছোলা এবং অন্যটি হলো কাবলি ছোলা। এই ছোলা গুলো অত্যন্ত পুষ্টিকর। প্রতি ১০০ গ্রাম ছোলা তে রয়েছে ৬৫ গ্রাম শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট, ১৮ গ্রাম প্রোটিন বা আমিষ , এবং প্রায় ৫ গ্রাম ফ্যাট। এছাড়াও ছোলা তে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ভিটামিন বি ১, বি ২, ম্যাগনেসিয়াম, লৌহ,আয়রন এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট।
ছোলা খাওয়ার উপকারিতা
ছোলা বাঙালির রান্নাঘরে খুব পরিচিত একটি খাবার। বিশেষ করে রমজান মাসে এই ছোলার চাহিদা সর্বাধিক। মুড়ি কিংবা চানাচুর মাখার সাথে একটু ছোলা না থাকলে পুরো খাবার টাই যেনো অসম্পূর্ণ। বিভিন্ন ব্যায়ামবিদ এবং চিকিৎসকের দৈনিক এক মুঠ ছোলা খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। চলুন জেনে নেওয়া যাক এই ছোলার কিছু উপকারিতা-
হজমে ক্ষমতা উন্নত করে
ছোলা একটি শস্যজাতিয় খাবার। ছোলা তে রয়েছে র্যাফিনোজ নামক ভোজ্য আঁশ। ছোলা তে থাকা ফাইবার এবং অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের পাকস্থলী এর উপকারি ব্যাকটেরিয়া এর পরিমান বাড়াতে সাহায্য করে। এতে করে আমাদের হজম ক্ষমতা উন্নত হয়। নিয়মিত ছোলা খেলে এটি আমাদের হজম ক্ষমতা উন্নত করার পাশাপাশি কোষ্টকাঠিন্য এর সমস্যা দূর করতেও সাহায্য করে।
ক্যান্সার রোধে
শরীরে আয়রনের ঘাটতি এর কারনে অনেক নারীরা কোলন ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়। তবে ফলিক অ্যাসিড সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণের মাধ্যমে এই ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব হয়। ছোলা তে রয়েছে আয়রন , জিংক ও ম্যাগনেসিয়া, যা আমাদের শরীরের আয়রনের ঘাটটি পুরন করে। এতে করে নিয়মিত ছোলা খেলে এটি ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে।
রক্তে শর্করা এর মাথা নিয়ন্ত্রণ
ছোলা একটি শর্করা বা কার্বোহাইড্রেট সমৃদ্ধ খাবার। ছোলার গ্লাইসেমিক ইনডেক্স কম। এতে করে এটি রক্তে শর্করার পরিমান ধীরে ধীরে বাড়াতে সাহায্য করে। ভেজানো ছোলা তে রয়েছে কার্বোহাইড্রেট এবং ফাইবার বা আশ। ছোলার এই আঁশ আমাদের এক্তের গ্লূকোজের মাত্রাকে নিয়ন্ত্রণে করে। এতে যারা যারা ডায়েবটিকস এ ভুগছেন তাদের জন্য কাচা ছোলা খাওয়া বেশ উপকারী।
রক্তের ফ্যাট কমাতে সাহায্য করে
ছোলা তে থাকা ফ্যাটের বেশিরভাগই হলো পলি আনস্যাচুয়েটেড ফ্যাট। ফ্যাট আমাদের শরীরের জণ্য ক্ষতিকর হলেও ছোলা তে থাকা ফ্যাট আমাদের জন্য উপকারী। এটি আমাদের রক্তে থাকা ব্যাড চর্বি কমাতে সাহায্য করে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
ছোলা তে রয়েছে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট, ভিটামিন বি১, বি২, বি৬ এবং আমিষ। নিয়মিত ছোলা খেলে এটি আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির পাশাপাশি আমাদের স্বাস্থ্যবান ও শক্তিশালী হতে সাহায্য করে।
ত্বক ও চুলের সৌন্দর্য বৃদ্ধিতে
অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট ও ভিটামিনে ভরপুর এই ছোলা আমাদের ত্বক ও চুলের যত্নে অনেক উপকারী। নিয়মিত ছোলা খেলে এটি আমাদের ত্বক উজ্জ্বল রাখার পাশাপাশি ত্বকের মৃসনতা বজায় রাখতেও সাহায্য করে। সেই সাথে উজ্বল ও ঝলমেলে চুল পেতেও ছোলা খেতে পারেন।
জ্বালাপোড়া দূর করে
ছোলা তে রয়েছে সালফার নামক খাদ্য উপাদান। সালফার আমাদের হাত পায়ের জ্বালাপোড়া দূর করতে সাহায্য করে । গ্রীষ্ম কালে অনেকেই হাত পায়ের জ্বালাপোড়ার সমস্যায় ভুগে থাকেন। তারা ছোলা খেতে পারেন আশা করছি বেশ ভালো ফলাফল পাবেন।
হাড়ের সমস্যা দূর করে
ছোলা তে রয়েছে ক্যালসিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম , ফসফরাস সহ ভোজ্য আঁশ। এই উপাদান গুলো আমাদের হাড়ের স্বাস্থ্য ভালো রাখে এবং হাড় কে মজবুত রাখতে সাহায্য করে।
স্নায়ুর দুর্বলতা কমাতে
ছোলা তে থাকা ভিটামিন বি স্নায়ুর দুর্বলতা কমাতে সাহায্য করে। সেই সাথে মেরুদণ্ডের ব্যথা, মস্তিষ্কের গোলযোগ কমাতে, হৃৎপিণ্ডের দুর্বলতা কমাতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতেও ছোলার উপকারিতা রয়েছে।
কাঁচা ছোলা নাকি রান্না করা ছোলা?
ছোলা কাচা খাবেন নাকি রান্না করা খাবেন এটি নিয়ে অনেকেরই দ্বিমত রয়েছে। ছোলা এমন একটি খাবার যেটি পুষ্টিগুণে ভরপুর। আপনি যেভাবেই ছোলা খান না কেন এটি আপনার স্বাস্থ্য এ জন্য ভালো। তবে রান্না করা ছোলা ও কাচা ছোলার উপকারিতায় রয়েছে কিছুটা ভিন্নতা। কি সেই ভিন্নতা সেটাই একটু জেনে নিবো আজ-
কাঁচা ছোলা খাওয়ার উপকারিতা
বিভিন্ন মশলার মিশ্রনে রান্না করা ছোলার চেয়ে কাঁচা তে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট এর পরিমাণ বেশি। খাওয়ার অন্তত ৬ ঘন্টা আগে ছোলা পানিতে ভিজিয়ে রাখা উচিত। এছাড়া কাচার ছোলার সাথে সামান্য কাচা আদা মিশিয়ে খেলে এটি আমাদের শরীরে অ্যান্টিবায়োটিক এর কাজ করে। নিয়মিত সকালে এক মুঠ কাঁচা ছোলা খেলে এটি আমাদের শক্তি বৃদ্ধিতে সাহায্য করবে। এছাড়াও কাচা ছোলা আমাদের উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে এবং রক্তের কোলেস্টেরল এর মাত্রা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে। অন্যদিকে কাঁচা ছোলা তে গ্লাইসেমিক ইনডেক্স এর পরিমাণ কম থাকে এতে করে সকালে কাঁচা ছোলা খেলে এটি দীর্ঘক্ষণ আপনার পেট ভরা রাখবে এতে করে আপনার ওজন ও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এছাড়াও অ্যানিমিয়া দূর করতে এবং গর্ভবতী মায়েদের স্বাস্থ্যের জন্যও কাচা ছোলা খাওয়া অনেক উপকারী। তাই দৈনিক এক মুঠ কাঁচা ছোলা খাওয়ার অভ্যাস করতে পারেন। শুধু কাঁচা ছোলা খেতে অসস্থিবোধ হলে ছোলার সাথে সামান্য কাঁচা মরিচ কুচি, পেঁয়াজকুচি, আদা কুচি , সরিষার তেল , ধনিয়াপাতা ও লবণ মিশিয়ে মেখে খেতে পারেন।
রান্না করা ছোলার উপকারিতা।
ছোলা তে রয়েছে ক্যালরি। সাধারণত মশলা এবং আলুর মিশ্রণে অনেকেই ছোলা রান্না করে থাকে যেটিকে বলা হয় ছোলা ভুনা। যেহেতু মশলার মিশ্রন থাকে তাই স্বাভাবিকভাবে কাঁচা ছোলার চেয়ে রান্না করা ছোলাতে ক্যালরি এর পরিমাণ টা বেশী থাকে। তাই যারা দ্রুত ওজন বাড়াতে যাচ্ছেন তারা রান্না করে ছোলা খেতে পারেন। আবার অনেকেই কাঁচা ছোলা খেতে পারেন না বা কাঁচা ছোলা খেলে পেটের সমস্যায় ভোগেন, তারা চাইলে এভাবে রান্না করে ছোলা খেতে পারেন। তবে ছোলা রান্নাতে যতো কম মশলা ব্যবহার করবেন ততোই এটি আপনার স্বাস্থ্য এর জন্য ভালো হবে। অতিরিক্ত তেল মশলা জাতীয় খাবার আপনার শরীরের জন্য ক্ষতিকর।
দৈনিক কি পরিমাণে ছোলা খাওয়া যাবে
কোনো খাবার শরীরের জণ্য যতোই উপকারী হোক না কেন , সেটি আপনাকে নির্দিষ্ট পরিমাণে খেতে হবে। কারণ প্রয়োজনের অতিরিক্ত খাবার খেলে উপকারের চেয়ে অপকারের মাত্রা টাই বেশি। বিশেষজ্ঞ দের মতে একজন সুস্থ ব্যক্তি দৈনিক ২৫-৩০ গ্রাম ছোলা খেতে পারবেন। তবে আপনি যদি কোনো রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে অবশ্যই ডাক্তার বা পুষ্টিবিদের পরামর্শ মেনে ছোলা খাবেন।
সতর্কতা
ছোলা তে রয়েছে পটাশিয়াম। যাদের কিডনির সমস্যা রয়েছে তাদের জন্য পটাশিয়াম সমৃদ্ধ খাবার খাওয়া উচিত না। তাই আপনি যদি কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন সেক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া ছোলা খাওয়া অনুচিত। অন্যদিকে ছোলা খাওয়ার আগে অন্তত ৬ ঘন্টা এটিকে ভালোভাবে পানিতে ভিজিয়ে রাখবেন। এতে করে ছোলার বাহিরের ক্যামিক্যাল বা ফাইটিং গুলো দূর হবে। এছাড়া আপনার যদি পেটে ব্যথা থাকে সেক্ষেত্রে ছোলা খাওয়া উচিত না এবং বাজার থেকে ছোলা কেনার সময় কৌটাজাত ছোলা কেনা থেকে বিরত থাকবেন। কৌটাজাত খাবার থেকে বটুলিজম নামক বিষক্রিয়া হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাই চেষ্টা করবেন সাধারণ প্যাকেটের ছোলা সংগ্রহ করার।
আশা করছি আজকের এই ব্লগ থেকে আপনারা ছোলা খাওয়ার উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত একটা ধারণা পেয়েছেন। সুস্থ থাকার জন্য স্বাস্থ্যকর খাবারের কোনো বিকল্প নেই। আর ঠিক এমনই একটি স্বাস্থ্যকর খাবার হলো ছোলা। তাই নিজের ও পরিবারের সুস্থ্যতাই দৈনিক পরিমিত পরিমাণে ছোলা খাওয়ার অভ্যাস করুন ।