You are currently viewing স্বাদ, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই খাবার
ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই খাবার

স্বাদ, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই খাবার

ঢাকা, যা একসময় মোগল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল, তার ঐতিহ্যবাহী খাবারের জন্য সুপরিচিত। এখানকার প্রতিটি পদ যেন এক একটি কালের সাক্ষী, যা আমাদের প্রাচীন সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের মেলবন্ধন ঘটায়। পুরান ঢাকার সরু গলি থেকে শুরু করে অভিজাত রেস্টুরেন্ট পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই খাবার শুধু আমাদের স্বাদগ্রন্থিকেই তৃপ্ত করে না, বরং আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ধারাকে বহন করে। 

ঢাকার বিরিয়ানি, কাচ্চি, হালিম, বাখরখানি, নিখুঁতি এবং মিষ্টান্নের মতো জনপ্রিয় খাবারগুলি যুগ যুগ ধরে আমাদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতির প্রতিচ্ছবি হিসেবে স্থান পেয়েছে। প্রতিটি পদ, এর রান্নার পদ্ধতি এবং পরিবেশনের ধরন যেন আমাদের ঐতিহাসিক ঐতিহ্যকে চোখের সামনে জীবন্ত করে তোলে। ঢাকাই খাবার শুধু পেট ভরায় না, মনে আনে এক অন্যরকম আনন্দের অনুভূতি, যা আমাদেরকে অতীতের সাথে সংযুক্ত করে। আজকের আর্টিকেলে আমরা কিছু ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই খাবার সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।

কিছু ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই খাবার

ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবারগুলি কেবলমাত্র স্বাদে নয়, এর ইতিহাস এবং প্রস্তুতির প্রক্রিয়ার দিক থেকেও সমৃদ্ধ। প্রতিটি খাবার একটি নির্দিষ্ট সময়ের গল্প বলে, যা ঢাকার সংস্কৃতি এবং ঐতিহ্যের সাথে গভীরভাবে জড়িত। নিচে কিছু প্রাচীন ঢাকাই খাবারের বর্ণনা দেওয়া হলো:

কাচ্চি বিরিয়ানি

ঢাকার কাচ্চি বিরিয়ানি একটি অতুলনীয় স্বাদ ও সৌরভের সংমিশ্রণ, যা মোগল আমল থেকে প্রভাবিত। কাচ্চি শব্দটি এসেছে ‘কাঁচা’ শব্দ থেকে, যা নির্দেশ করে যে মাংস ও চাল আলাদাভাবে রান্না না করে একসাথে কাঁচা অবস্থায় রান্না করা হয়। 

এর প্রস্তুতির জন্য সাধারণত খাসির মাংস ব্যবহৃত হয়, যা দই, আদা, রসুন, লবণ, জায়ফল, জৈত্রি, এলাচি, দারচিনি এবং অন্যান্য মশলা মিশিয়ে মেরিনেট করা হয়। মেরিনেট করা মাংসের সাথে যোগ করা হয় সুগন্ধী বাসমতি চাল এবং খাঁটি ঘি। সবশেষে, এর ওপর কাঁচা আলু এবং বারিস্টা (ভাজা পেঁয়াজ) ছিটিয়ে ধীর আঁচে ‘দম’ এ রান্না করা হয়। 

ফলাফল হিসেবে প্রতিটি দানায় মাংস ও মশলার অনবদ্য স্বাদ মিশে থাকে। ঢাকার ‘নান্না বিরিয়ানি’ বা ‘আজিজ সুপার মার্কেট’-এর মতো স্থানে এই বিখ্যাত কাচ্চি বিরিয়ানি খেতে পাওয়া যায়, যা শহরের খাবারপ্রেমীদের জন্য একটি অন্যতম প্রিয় পদ।

পুরান ঢাকার হালিম

পুরান ঢাকার হালিম

হালিম একটি পুষ্টিকর ও সুস্বাদু পদ, যা ঢাকার ঐতিহ্যের একটি অংশ। এটি তৈরি করতে মসুর, মুগ, ছোলার ডাল এবং গমের দানা আগে থেকে ভিজিয়ে রাখা হয়। এরপর মাংসের (খাসি বা মুরগি) ছোট ছোট টুকরা, আদা, রসুন, গরম মশলা এবং ঘি দিয়ে ধীরে ধীরে রান্না করা হয়। ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধীর আঁচে রান্নার পর সব উপকরণ মিশে এক ধরনের পেস্টের মতো হয়, যা খেতে অত্যন্ত নরম ও মসৃণ। 

হালিমের সাথে সাধারণত লেবু, আদা, কাঁচা মরিচ এবং পেঁয়াজের কুচি পরিবেশন করা হয়। এই সুস্বাদু খাবারটি রমজান মাসে বিশেষভাবে জনপ্রিয়, তবে সারা বছরই এটি খাওয়া হয়। ‘চাঁদনী চক’ এবং ‘তাসকিন হালিম’ এর মতো কিছু ঐতিহ্যবাহী দোকান এই হালিমের জন্য বিখ্যাত।

বাকরখানি

বাকরখানি ঢাকার এক অসাধারণ ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি রুটি, যা মুঘল আমলে খুবই জনপ্রিয় ছিল। এটি তৈরি করতে ময়দা, খামির, দুধ, চিনি, ঘি এবং এলাচির মিশ্রণ ব্যবহার করা হয়। ময়দার মণ্ডটি পাতলা করে গোল আকারে বেলে এতে ঘি ও চিনি ছিটিয়ে ভাঁজ করে আবার গোল আকৃতিতে আনা হয়, যাতে এতে বিভিন্ন স্তর তৈরি হয়। 
বাকরখানি কি, কেন বিখ্যাত? বাকরখানি তৈরির রেসিপি

এরপর এটি ওভেনে বা চুলায় বেক করা হয়। ফলাফল হিসেবে এটি খেতে হয় খাস্তা, মিষ্টি এবং মোলায়েম। বিশেষ করে পুরান ঢাকার নাজিমউদ্দিন রোড বা ‘বাকরখানি গলি’ নামে পরিচিত স্থানগুলিতে আসল বাকরখানি পাওয়া যায়। এটি সাধারণত চা বা কাহওয়ার সাথে বিকালের নাস্তায় পরিবেশন করা হয়।

নেহারি

নেহারি একটি ঐতিহ্যবাহী মুঘল খাবার, যা সাধারণত গরুর পায়ের মাংস, মগজ এবং হাড় দিয়ে তৈরি করা হয়। ‘নেহার’ শব্দটি এসেছে ‘নাহার’ শব্দ থেকে, যার অর্থ সকাল। এটি প্রথমে মুঘল সম্রাটদের প্রাতঃরাশ হিসেবে ব্যবহৃত হতো। নেহারি তৈরি করতে প্রথমে মাংস এবং হাড়গুলো ধীরে ধীরে ঝোলের মধ্যে সেদ্ধ করা হয়, যাতে মাংস নরম হয়ে যায় এবং হাড়ের ভেতরের গুণগত উপাদান ঝোলে মিশে যায়। 

এর সাথে মশলার মধ্যে থাকে আদা, রসুন, এলাচি, দারচিনি, লবঙ্গ এবং বিশেষ নেহারি মশলা। নেহারি সাধারণত নান রুটি বা তন্দুরি রুটির সাথে পরিবেশন করা হয় এবং এর মসৃণ ঝোল ও নরম মাংস খেতে অত্যন্ত তৃপ্তিদায়ক। পুরান ঢাকার ‘রেড ক্রিসেন্ট’, ‘কাবাব ঘর’ বা ‘কায়েমি’ রেস্তোরাঁয় এই মজাদার নেহারি পাওয়া যায়।

মোরগ পোলাও

মোরগ পোলাও ঢাকার একটি বিখ্যাত খাবার, যা বিশেষ করে উৎসব ও বিবাহের অনুষ্ঠানে পরিবেশন করা হয়। এটি মূলত বাসমতি চাল, বড় মোরগের মাংস এবং নানা ধরনের মশলা দিয়ে তৈরি করা হয়। মাংসকে দই, আদা, রসুন, পেঁয়াজ এবং অন্যান্য মশলা দিয়ে মেরিনেট করা হয়। 

এরপর মেরিনেট করা মাংস এবং ভেজে রাখা চাল একসাথে মিশিয়ে রান্না করা হয়, যাতে প্রতিটি দানায় মাংসের স্বাদ মিশে যায়। মোরগ পোলাওয়ে ডিম, কিসমিস, বাদাম এবং শাহী ঘির ব্যবহারের কারণে এটি সুগন্ধে ভরপুর ও অত্যন্ত সুস্বাদু হয়। এর সঙ্গে সাধারণত রায়তা বা সালাদ পরিবেশন করা হয়, যা এর স্বাদকে আরও বাড়িয়ে তোলে।

ভুরি ভুনা

ভুরি ভুনা ঢাকার অন্যতম জনপ্রিয় খাবার, বিশেষ করে যারা স্পাইসি খাবার পছন্দ করেন তাদের জন্য এটি একটি আদর্শ পদ। এটি তৈরি হয় গরুর ভুরি (পেটের অংশ) দিয়ে, যা আগে থেকে ভালভাবে পরিষ্কার করে অনেকক্ষণ সেদ্ধ করা হয়। এরপর সেদ্ধ ভুরি আদা, রসুন, পেঁয়াজ, কাঁচা মরিচ এবং প্রচুর মশলা দিয়ে কষিয়ে ভাজা হয়। 

ঘণ্টার পর ঘণ্টা ভাজা হওয়ার ফলে ভুরির মশলা গুলির সাথে মিশে যায় এবং এটি খেতে খুবই মজাদার হয়। ভুরি ভুনা ঢাকার বিয়ের অনুষ্ঠান বা বিশেষ কোন ভোজের সময় অত্যন্ত জনপ্রিয়। পুরান ঢাকার ‘নিউ ইয়র্ক রেস্তোরাঁ’ বা ‘রহমত আলী হোটেল’-এর মতো স্থানগুলোতে এর আসল স্বাদ পাওয়া যায়।

কাবাব

কাবাব

ঢাকার কাবাব বলতে সাধারণত শিক কাবাব, চাপ কাবাব এবং বট কাবাবের কথা বোঝায়। শিক কাবাব মূলত গরুর মাংস, আদা, রসুন এবং বিশেষ মশলা দিয়ে তৈরি করা হয়। এই মিশ্রণকে শিকে গেঁথে উনুনে বা ওভেনে গ্রিল করা হয়, যাতে এটি খাস্তা ও সোনালি রঙের হয়। চাপ কাবাব সাধারণত মাংসের বড় টুকরো নিয়ে তাতে মশলা মাখিয়ে সরাসরি তন্দুরে বা চুলায় গ্রিল করা হয়। বট কাবাব খাসির কলিজা দিয়ে তৈরি, যা বিভিন্ন মশলার সাথে মেখে তাওয়া বা চুলায় ভাজা হয়। ঢাকার ‘কাবাব ঘর’, ‘বড় বট কাবাব’, বা ‘হোসেনি দালান’-এর কাবাবের খ্যাতি দেশজুড়ে।

ফুচকা ও চটপটি

ফুচকা এবং চটপটি ঢাকার রাস্তাঘাটে অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি স্ট্রিট ফুড। ফুচকা তৈরি হয় ভাজা পাপড়ির মধ্যে মসলা মেশানো আলুর পুর ভরে এবং টক-ঝালের মিশ্রণে চুবিয়ে। চটপটি তৈরি হয় ছোলা, আলু এবং টক-ঝালের মিশ্রণে, যা খেতে অত্যন্ত সুস্বাদু ও মশলাদার। ঢাকার বিখ্যাত ফুচকা-চটপটির দোকানগুলোতে এটির এক বিশেষ স্বাদ পাওয়া যায়, যা অন্য কোথাও খুঁজে পাওয়া যায় না।

সন্দেশ

সন্দেশ ঢাকার একটি বিখ্যাত মিষ্টি, যা ছানা দিয়ে তৈরি করা হয়। এটি তৈরি করতে ছানা, চিনি এবং খোয়া মিশিয়ে নরম ও মোলায়েম করে গড়া হয়। বিভিন্ন ধরনের সন্দেশ পাওয়া যায়, যেমন নকশী সন্দেশ, ক্ষীর সন্দেশ, মালাই সন্দেশ ইত্যাদি। এটি সাধারণত উৎসব এবং বিশেষ দিনে পরিবেশন করা হয়। ঢাকার বিখ্যাত মিষ্টির দোকানগুলোতে এটির আসল স্বাদ পাওয়া যায়, যা যে কোনো মিষ্টি প্রেমীকে মুগ্ধ করবে।

উপসংহার

ঐতিহ্যবাহী ঢাকাই খাবার এর প্রতিটি পদে মিশে আছে এক একটি গল্প, এক একটি সময়ের নিদর্শন। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে এই স্বাদ ও ঐতিহ্য আমাদের জীবনধারায় মিশে আছে। তাই ঢাকাই খাবারকে শুধু খাদ্য হিসেবে নয়, বরং একটি সংস্কৃতির অমূল্য অংশ হিসেবে দেখতে হবে। 

এই খাদ্য ঐতিহ্যকে সংরক্ষণ ও প্রচার করা আমাদের দায়িত্ব, যাতে ভবিষ্যৎ প্রজন্মও এই অনন্য সংস্কৃতির স্বাদ উপভোগ করতে পারে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী খাবার আমাদের শুধু তৃপ্তি দেয় না, বরং আমাদের শিকড়ের প্রতি গর্ব অনুভব করায় এবং আমাদের সংস্কৃতির সাথে অটুট বন্ধনে আবদ্ধ করে।

Bornali Akter Borno

Bornali Akter Borno is a passionate food enthusiast and entrepreneur. From an early age, her love for culinary exploration led her to experiment with flavors and ingredients, ultimately inspiring her to work with Binni Food, an e-commerce brand dedicated to offering premium quality Organic Food and delectable treats to food enthusiasts in Bangladesh. Bornali's relentless pursuit of flavor and commitment to excellence have earned her recognition in the culinary world. Her journey is a testament to the power of passion and perseverance, showcasing how dedication to one's craft can lead to entrepreneurial success and culinary innovation.