You are currently viewing বার্মিজ আচার- যা একবার মুখে দিলেই ভুলে যাবেন সব!
বার্মিজ আচার

বার্মিজ আচার- যা একবার মুখে দিলেই ভুলে যাবেন সব!

বার্মিজ আচার, মায়ানমারের ঐতিহ্যবাহী খাবারের অন্যতম একটি অংশ, যা তার বৈচিত্র্যময় স্বাদ এবং স্বতন্ত্র রন্ধনশৈলীর জন্য পরিচিত। এই আচার বিভিন্ন প্রকার সবজি, ফল এবং মসলা মিশ্রণে তৈরি হয়, যা এক অনন্য স্বাদ ও গন্ধের সৃষ্টি করে। বার্মিজ আচার কেবলমাত্র মায়ানমারের খাবার সংস্কৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ নয়, বরং এটি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার রন্ধনশৈলীর বৈচিত্র্যকেও প্রতিফলিত করে। 

বিভিন্ন প্রকার মশলা এবং উপাদানের সঠিক মিশ্রণে তৈরি এই আচারগুলি সাধারণত ঝাল, টক, মিষ্টি এবং নোনতা স্বাদের মিশ্রণ। মায়ানমারের প্রতিটি অঞ্চলে আচার তৈরির নিজস্ব প্রথা রয়েছে, যা স্থানীয় সংস্কৃতি এবং খাবারের ঐতিহ্যকে তুলে ধরে। বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্ব অঞ্চলের জেলাগুলোতে এ আচার বেশ সুপরিচিত একটি খাবার। আজকের আর্টিকেলে বার্মিজ আচার এর চুল-ছেড়া বিশ্লেষণ নিয়েই হাজির হয়েছি। 

বার্মিজ আচার: বাংলাদেশে পরিচিতির ইতিহাস

বার্মিজ আচার, মায়ানমারের ঐতিহ্যবাহী আচার, বাংলাদেশে পরিচিতি লাভ করেছে মূলত দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অভিবাসন ও সাংস্কৃতিক বিনিময়ের মাধ্যমে। বিশেষ করে, ১৯৪৮ সালে মায়ানমারের স্বাধীনতার পর থেকে অনেক বাঙালি পরিবার মায়ানমার থেকে বাংলাদেশে ফিরে আসে। তাদের সাথে তারা তাদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং খাবারের রেসিপিগুলিও নিয়ে আসে, যার মধ্যে অন্যতম ছিল বার্মিজ আচার। 

এই আচার মূলত সবজি, ফল, এবং মসলা মিশিয়ে তৈরি করা হয়, যা স্বাদে ও গন্ধে অনন্য। কক্সবাজার, চট্টগ্রাম এবং বান্দরবানের মতো দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের জেলা এলাকায় বার্মিজ আচার ব্যাপক জনপ্রিয়তা লাভ করে। এই অঞ্চলে বসবাসরত মায়ানমার বংশোদ্ভূত মানুষেরা তাদের পরিবারের মধ্যে আচার তৈরির প্রথা বজায় রেখেছে এবং স্থানীয়দের সাথে এটি ভাগাভাগি করেছে। 

তাছাড়া, এই অঞ্চলের বাজারগুলিতে বার্মিজ আচার সহজলভ্য হওয়ায় স্থানীয় বাঙালিদের মধ্যে এর পরিচিতি ও জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পায়। এই প্রক্রিয়ায়, বার্মিজ আচার বাংলাদেশের খাবারের সংস্কৃতির একটি অংশ হয়ে উঠেছে, যা প্রমাণ করে খাদ্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে মানুষের মধ্যে সেতুবন্ধন সৃষ্টি করা সম্ভব।

বার্মিজ আচার আমদানি

বার্মিজ আচার আমদানি

বার্মিজ আচার বাংলাদেশে প্রধানত মায়ানমারের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্কের মাধ্যমে আমদানি করা হয়। মায়ানমার থেকে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজারের বন্দরে এই আচারগুলি আমদানি করা হয়। এছাড়া, কক্সবাজার ও বান্দরবানে বসবাসরত মায়ানমার বংশোদ্ভূত মানুষেরা তাদের নিজস্ব উপায়ে আচার তৈরি করে স্থানীয় বাজারে সরবরাহ করেন। এই প্রক্রিয়াটি সাধারণত কিছু ছোট ব্যবসায়ী এবং পরিবারগুলির মাধ্যমে সম্পন্ন হয় যারা মায়ানমারের সাথে সরাসরি যোগাযোগ রাখে। তারা মায়ানমার থেকে আচার এবং এর উপাদানগুলি সংগ্রহ করে বাংলাদেশে নিয়ে আসে এবং স্থানীয়ভাবে এটি বিক্রি করে।
বালাচাও কি? চিংড়ি বালাচাও খাওয়ার নিয়ম, উপকারিতা ও রেসিপি

বার্মিজ আচার: বিস্তারিত প্রস্তুত প্রণালী

বার্মিজ আচার তৈরি করাতে বেশ ধৈর্য্য এবং সূক্ষ্মতার প্রয়োজন হয়। মায়ানমারের ঐতিহ্যবাহী এই আচার বাঙালি রসনার সাথে মিশে এক নতুন স্বাদের সংমিশ্রণ তৈরি করেছে। নিচে বিস্তারিতভাবে বার্মিজ আচার তৈরির প্রণালী আলোচনা করা হলো:

উপাদানসমূহ:

  • সবজি বা ফল:
    • গাজর: ৫০০ গ্রাম
    • বাঁধাকপি: ৫০০ গ্রাম
    • শসা: ৫০০ গ্রাম
    • কাঁচা লঙ্কা: ১০০ গ্রাম
    • পেঁপে: ৫০০ গ্রাম
  • মশলা:
    • সরিষার গুঁড়া: ১০০ গ্রাম
    • শুকনো লঙ্কা গুঁড়া: ৫০ গ্রাম
    • মেথি গুঁড়া: ২৫ গ্রাম
    • মৌরি গুঁড়া: ২৫ গ্রাম
    • লবণ: পরিমাণমতো (সাধারণত ১-২ টেবিল চামচ)
    • চিনি: ৫০ গ্রাম
  • তেল ও অন্যান্য উপাদান:
    • সরিষার তেল: ২৫০ মিলি
    • রসুন: ১০-১৫ কোয়া, কুচি করা
    • আদা: ৫০ গ্রাম, কুচি করা
    • ভিনেগার বা লেবুর রস: ১০০ মিলি

সবজি বা ফল প্রস্তুতি:

  • সবজি বা ফল ভালোভাবে ধুয়ে নিন এবং পানি ঝরিয়ে ফেলুন।
  • প্রতিটি সবজি বা ফল সমান আকারের টুকরো করে কেটে নিন। উদাহরণস্বরূপ, গাজর ও পেঁপে লম্বা লম্বা টুকরো করে কেটে নিন, বাঁধাকপি ছোট ছোট টুকরো করে নিন এবং শসা গোল গোল করে কেটে নিন।
  • কাঁচা লঙ্কা মাঝখান থেকে কেটে নিন, তবে লঙ্কার দানা ফেলে দেবেন না।

মশলার মিশ্রণ:

  • একটি বড় পাত্রে সরিষার গুঁড়া, শুকনো লঙ্কা গুঁড়া, মেথি গুঁড়া, মৌরি গুঁড়া, লবণ এবং চিনি একসাথে মিশিয়ে নিন।
  • রসুন ও আদা কুচি করে মশলার মিশ্রণে যোগ করুন এবং সবকিছু ভালোভাবে মেশান।

সবজি মেশানো:

  • কাটা সবজি বা ফল মশলার মিশ্রণে মেশান। প্রতিটি টুকরো মশলায় ভালোভাবে মাখানো নিশ্চিত করুন।
  • মিশ্রিত সবজি বা ফলকে প্রায় ১ ঘণ্টা রেখে দিন যাতে মশলা সবজির সাথে ভালোভাবে মিশে যায়।

তেল গরম করা:

  • একটি পাত্রে সরিষার তেল গরম করুন। তেল ভালোভাবে গরম হলে সেটিকে ঠান্ডা করুন।
  • ঠান্ডা তেল সবজি বা ফলের মিশ্রণের উপরে ঢেলে দিন। তেল সবজির উপর সম্পূর্ণভাবে ঢালা উচিত যাতে প্রতিটি টুকরো তেলে ডুবে যায়।

আচার সংরক্ষণ:

  • মিশ্রিত আচারকে পরিষ্কার ও শুকনো কাচের বা মাটির পাত্রে সংরক্ষণ করুন।
  • পাত্রের মুখ ভালোভাবে বন্ধ করে দিন।
  • আচার পাত্রটি এক সপ্তাহ রোদে রেখে দিন। রোদে শুকানোর সময় প্রতিদিন আচারের পাত্রটি একটু নেড়ে দিতে পারেন যাতে তেল ও মশলা সবজির সাথে মিশে যায়।

স্বাদ পরীক্ষাঃ

  • এক সপ্তাহ পর আচারের স্বাদ পরীক্ষা করুন। যদি মনে হয় আচার পুরোপুরি প্রস্তুত হয়েছে, তবে এটি খাওয়া শুরু করতে পারেন।
  • আচার ঠান্ডা ও শুষ্ক স্থানে সংরক্ষণ করুন। এটি ফ্রিজে রাখলে আরও দীর্ঘ সময় ভালো থাকবে।
বাংলাদেশ থেকে বার্মিজ আচার: কোথায় এবং কিভাবে পাবেন
বার্মিজ আচার

বাংলাদেশ থেকে বার্মিজ আচার: কোথায় এবং কিভাবে পাবেন

বার্মিজ আচার, মায়ানমারের ঐতিহ্যবাহী একটি সুস্বাদু আচার, বাংলাদেশে বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এটি বিভিন্ন এলাকায় এবং অনলাইন মাধ্যমে পাওয়া যায়। এখানে বিস্তারিতভাবে জানানো হলো কোথায় এবং কিভাবে বার্মিজ আচার বাংলাদেশ থেকে সংগ্রহ করতে পারবেন।

কক্সবাজার

কক্সবাজার, বিশেষ করে টেকনাফ, বার্মিজ আচারের প্রধান উৎস। এই এলাকা মায়ানমারের সাথে সীমান্তবর্তী হওয়ায় এবং এখানে প্রচুর সংখ্যক রোহিঙ্গা শরণার্থী বসবাস করায় বার্মিজ আচার সহজলভ্য।

  • স্থানীয় বাজার: টেকনাফ এবং উখিয়ার বাজারে বার্মিজ আচার পাওয়া যায়।
  • রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আশেপাশে: ক্যাম্পের আশেপাশের দোকানগুলোতে বার্মিজ আচার বিক্রি হয়।

চট্টগ্রাম

চট্টগ্রাম শহরেও বার্মিজ আচার বেশ জনপ্রিয়। এখানে মায়ানমারের সাথে দীর্ঘদিনের ব্যবসায়িক সম্পর্ক রয়েছে।

  • কদমতলী বাজার: এই বাজারে বিভিন্ন ধরনের বার্মিজ আচার পাওয়া যায়।
  • চট্টগ্রাম রেল স্টেশন সংলগ্ন দোকানপাট: স্টেশনের আশেপাশের দোকানগুলোতে বার্মিজ আচার বিক্রি হয়।

বান্দরবান

বান্দরবান জেলার বিভিন্ন স্থানে বার্মিজ আচার পাওয়া যায়। এখানে অনেক মায়ানমার বংশোদ্ভূত মানুষেরা বসবাস করেন, যারা বার্মিজ আচার তৈরি করে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন।

  • বান্দরবান সদর বাজার: এই বাজারে বিভিন্ন ধরনের বার্মিজ আচার পাওয়া যায়।
  • রুমা ও থানচি বাজার: বান্দরবানের অন্যান্য এলাকা থেকেও আচার সংগ্রহ করা যায়।

অনলাইন শপ

বর্তমানে বিভিন্ন অনলাইন প্ল্যাটফর্মেও বার্মিজ আচার সহজলভ্য। অনলাইনে অর্ডার করে বাসায় বসেই বার্মিজ আচার সংগ্রহ করা যায়।

  • ফেসবুক পেজ ও গ্রুপ: কিছু ফেসবুক পেজ এবং গ্রুপ আছে যারা বার্মিজ আচার বিক্রি করে। উদাহরণস্বরূপ, “Burmese Pickle BD” বা “Myanmar Achar BD” এর মতো পেজগুলি।
  • অনলাইন শপিং সাইট: daraz.com.bd, rokomari.com এর মতো জনপ্রিয় ই-কমার্স সাইটগুলোতেও বার্মিজ আচার পাওয়া যায়।

ঢাকার বিশেষ দোকান

ঢাকার কিছু বিশেষ দোকানেও বার্মিজ আচার পাওয়া যায়।

  • গুলশান ও বনানী: এই এলাকায় কিছু ডেলিকটেসেন এবং সুপারমার্কেট আছে যারা বার্মিজ আচার রাখে।
  • ধানমন্ডি ও বসুন্ধরা সিটি: এই এলাকায় কিছু বিশেষ দোকান ও শপিং মলে বার্মিজ আচার পাওয়া যায়।

উপসংহার

বার্মিজ আচার মায়ানমারের রন্ধনশৈলীর একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য এবং এটি শুধু স্বাদে বৈচিত্র্য এনে দেয় না, বরং স্থানীয় খাদ্যসংস্কৃতির ইতিহাস এবং ঐতিহ্যকেও ধারণ করে। এই আচারগুলি মায়ানমারের মানুষের দৈনন্দিন জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং উৎসব ও পার্বণে বিশেষভাবে পরিবেশিত হয়। 

বাংলাদেশেও বার্মিজ আচার বেশ সুপরিচিত। দক্ষিণ পূর্বের জেলাগুলো থেকে শুরু করে বর্তমানে সারাদেশে বেশ জনপ্রিয় একটি আচারের নাম হলো বার্মিজ আচার। বার্মিজ আচারের মধ্য দিয়ে আমরা মায়ানমারের রন্ধনশৈলীর গভীরতা এবং বৈচিত্র্য অনুভব করতে পারি, যা আন্তর্জাতিক খাদ্যসংস্কৃতির ক্ষেত্রেও একটি মূল্যবান সংযোজন।

Bornali Akter Borno

Bornali Akter Borno is a passionate food enthusiast and entrepreneur. From an early age, her love for culinary exploration led her to experiment with flavors and ingredients, ultimately inspiring her to work with Binni Food, an e-commerce brand dedicated to offering premium quality Organic Food and delectable treats to food enthusiasts in Bangladesh. Bornali's relentless pursuit of flavor and commitment to excellence have earned her recognition in the culinary world. Her journey is a testament to the power of passion and perseverance, showcasing how dedication to one's craft can lead to entrepreneurial success and culinary innovation.