আমের স্বাদ বছরজুরে পেতে আমসত্ব তৈরি করা দারুন একটি উপায় বলা যায়। এখন আমসত্ব তৈরি করার কিছুদিনের মধ্যে যদি সেটা নষ্ট হয়ে যায় তাহলে কেমন লাগবে একবার ভেবে দেখুন তো? নিশ্চয়ই মনটা খারাপ হয়ে যাবে তাই না! আসলে যত্ন সহকারে তৈরি করা কোনো খাবার নষ্ট হয়ে গেলে তো খারাপ লাগাটা স্বাভাবিক।
ফলের রাজা আম, গ্রীষ্মকালীন সময়ে কড়া রোদ বা কালবৈশাখী ঝড় যাই হোক না কেনো, সব কিছুকে উপেক্ষা করে আম খেতে আমরা সকলেই প্রস্তুত থাকি। এতো সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণে ভরপুর আম সারাবছর পাওয়া যায় না বলে আমরা আমসত্ব তৈরি করে আমের স্বাদ ধরে রাখি। আজকে আমরা আমসত্ব সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো।
আমসত্ব কিভাবে ঘরে বসে খুব সহজে তৈরি করার যায়
আমের মৌসুম শুরু হতে শেষ পর্যন্ত প্রায় ঘরে ঘরে আমসত্ব তৈরি করার ধুম পরে যায়। কারণ এটি তৈরি করে না রাখলে হয়তো সারা বছর আফসোস করেই কাটাতে হবে। এটি অনেক মজার একটি মুখোরোচক খাবার। যার সাথে শৈশবের স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমাদের। তাই আম ফুরিয়ে যাওয়ার আগেই আমসত্ব বানিয়ে রাখা হয়।
আমসত্ব বানানোর পদ্ধতি কম বেশি সকলেই পারি। যদিও সংক্ষেপে বলা যায়, কাচা বা পাকা আমের রসালো অংশ দিয়ে মূলত তৈরি করা হয় আমসত্ব। আজকে আমসত্ব রেসিপি জানবো। ফলে খুব সহজেই ঘরোয়াভাবে তৈরি করে নিতে পারেন। এবং পরিবার স্বজন নিয়ে সারাবছর আমসত্বের মাধ্যমে আমের স্বাদ নিতে পারবেন।
আমসত্ব তৈরি করতে যা যা লাগছে
- কাচা আম ১ কেজি
- চিনি ১ কাপ
- লবন হাফ চা চামচ
- মরিচের গুড়ো ১ চা চামচ
- ভাজা জিরা গুড়ো ১ চা চামচ
রেসিপি
- পিলারের সাহায্যে আমগুলোর খোসা ছাড়িয়ে নিয়ে টুকরো করে নিতে হবে। কোনো ভাবেই যেনো সবুজ অংশ লেগে না থাকে।
- একটি বাটিতে পানি দিয়ে টুকরো করে রাখা আমগুলো দিয়ে সামান্য পরিমাণে লবন দিয়ে ২০-২৫ মিনিটের জন্য ভিজিয়ে রাখতে হবে। লবন পানিতে ভিজিয়ে রাখলে আমের অতিরিক্ত টক ভাব কমে যায়।
- ২০ মিনিট পরে ঠান্ডা পানি দিয়ে ২-৩ বার ধুয়ে নিতে হবে।
- এরপরে চুলায় একটি পাত্র বসিয়ে আমগুলো দিয়ে ৩/৪ কাপ পানি দিতে হবে। চুলার আঁচ মিডিয়ামে রেখে ঢাকনা দিয়ে ঢেকে সিদ্ধ করে নিতে হবে। মাঝে মাঝে একটু নেড়ে দিতে হবে। না হলে পুরে যেতে পারে।
- ভালোভাবে সিদ্ধ হয়ে গেলে ছাকনিতে ছেকে নিতে হবে। আমের রসালো অংশ বা আমের পিউরি খুব বেশি ঘন বা পাতলা করা যাবেনা। ঘন বেশি মনে হলে সামান্য একটু পানি ব্যবহার করা যেতে পারে।
- রান্নার করার জন্য একটি প্যান বসিয়ে আমের পিউরি দিতে হবে। এরমধ্যে চিনি, লবন, মরিচের গুড়ো, ভাজা জিরা গুড়ো, দিয়ে অনবরত নেড়ে নিতে হবে।
- জ্বাল দেওয়ার সময় আমের পিউরি ফুটতে শুরু করলে সাবধানতার সাথে নাড়তে হবে।
- আমসত্বের মিশ্রণটি রেডি হয়ে গেলে একটি ট্রেতে সরিষার তেল দিয়ে ব্রাশ করে মিশ্রণটি ঢেলে দিতে হবে। তারপরে শুকিয়ে নিতে হবে।
রোদে দিতে হবে দেখে অনেকে আমসত্ব তৈরি করা কিছুটা ঝামেলা মনে করেন। বিশেষ করে শহরমুখী মানুষদের জন্য ঝামেলা। ফলে তারা আমসত্ব বাহির থেকে কিনেন। যদিও বাহিরের তৈরিকৃত আমসত্ব কতটুকু স্বাস্থ্যসম্মত তা আমরা সঠিক জানিনা। তাই ঘরে বসেই রোদে দেওয়ার ঝামেলা ছাড়াই আমসত্ব তৈরি করুন খুব সহজ উপায়ে। রোদের শুকানোর বিকল্প হিসেবে চুলার পাশে রেখে অথবা ওভেনের মাধ্যমে আমসত্ব শুকাতে হবে।
ঘরোয়াভাবে আমসত্ব সংরক্ষণ পদ্ধতি
নিচে আমসত্ব সংরক্ষণ পদ্ধতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো।
সরিষার তেল
আমসত্ব তৈরি করে খাঁটি সরিষার তেলে বেশি করে দিয়ে বোয়ামে রাখতে হবে। এতে আমসত্ব অনেকদিন পর্যন্ত ভালো থাকবে।
রোদের মাধ্যমে
আমসত্ব বেশি দিন সংরক্ষণের জন্য মাঝে মাঝে রোদে দিতে হবে। ফলে আমসত্বের স্বাদ ধরে রাখতে সাহায্য করতে এবং ফাংগাসের হাত থেকে রক্ষা করবে। এতে ঘরের স্বাভাবিক তাপমাত্রায় খুব সহজে সংরক্ষণ করা যাবে।
শুকনো বোয়ামে
আমসত্ব তৈরি করে অবশ্যই শুকনো কাচের বোয়ামে সংরক্ষণ করতে হবে। বোয়ামে যেনো পানি লেগে না থাকে সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে। কারণ পানির আদ্রতা লেগে নষ্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
শুকনো চামচের ব্যবহার
আমসত্ব বোয়ামে রাখার পরে অনেক সময় আমরা হাত দিয়ে আমসত্ব বের করে খেয়ে ফেলি। ফলে হাতে পানি বা অন্য কিছু লেগে থাকলে আমসত্বের সংষ্পর্শ এসে দ্রুত ফাংগাস ধরতে পারে। তাই বোয়াম থেকে তোলার জন্য হাতের পরিবর্তে শুকনো চামচ ব্যবহার করতে হবে। অবশ্যই খেয়াল রাখতে হবে চামচ যেনো ভেজা না থাকে বা অন্য কোনো উপাদান লেগে না থাকে।
শুষ্ক ও পরিষ্কার স্থান
আমসত্ব তৈরি করে ভেজা বা স্যাঁতস্যাতে জায়গায় সংরক্ষণ করা যাবেনা। এতে ছত্রাক আক্রমন করে দ্রুত নষ্ট হয়ে যাবে। তাই আমসত্বের বোয়াম একটি শুষ্ক ও পরিষ্কার জায়গায় রেখে দিতে হবে।
ফ্রিজের মাধ্যমে
আমসত্ব সংরক্ষনের আরও একটি সহজ উপায় হলো ফ্রিজিং। ফ্রিজে রেখে সারা বছর আমসত্ব খাওয়া যাবে। মাঝে মধ্যে একটু হালকা রোদে দিতে হবে। ঠান্ডা জায়গায় ফাংগাস লাগার সম্ভাবনা নেই বললেই চলে। আমসত্ব অবশ্যই ভালোভাবে শুকিয়ে নিতে হবে। না হলে এটি তাড়াতাড়ি নষ্ট হয়ে যাবে। শুকানোর পরে আমসত্ব পিচ পিচ করে কেটে একটি জিপলক ব্যাগে ভরে নরমাল ফ্রিজে সংরক্ষণ করা যাবে।
ভিনেগার ব্যবহারে
আমরা সকলেই জানি ভিনেগার বা সিরকা খুব ভালো একটি প্রিজারভেটিভসের কাজ করে। আমসত্ব তৈরি করার সময় সামান্য পরিমাণে ভিনেগার ব্যবহার করা যেতে পারে। অথবা আমসত্ব তৈরির পরেও ব্যবহার করা যেতে পারে। ভিনেগার ব্যবহার করতে হবে আমসত্বের পরিমানের ওপর নির্ভর করে।
যে বয়ামে আমসত্ব সংরক্ষণ করা উচিত
যে ধরনের বয়ামে সংরক্ষণ করলে আমসত্ব বেশিদিন সংরক্ষণ করা যায় তা নিচে দেওয়া হল।
কাচের বোয়াম
আচার যেমন আমরা কাচের বোয়ামে সংরক্ষণ করে থাকি। ঠিক তেমনি আমসত্ব সংরক্ষনের জন্য শুকনো কাচের বোয়াম নিতে হবে। এই পাত্রে রাখলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত আমসত্ব ভালো থাকবে।
প্লাস্টিকের বোয়াম
আমসত্ব একটি আচার জাতীয় খাবার। তাই এটি প্লাস্টিকের বোয়ামে না রাখাই উচিত। কারণে এতে আমসত্ব বেশিদিন পর্যন্ত ভালো থাকেনা। দ্রুত ফাংগাস ছড়িয়ে পরতে পারে।
কাসার পাত্র
অনেকে আমসত্ব কাসার পাত্রে রাখেন। কাসার পাত্রে রাখলে খুব তাড়াতাড়ি আমসত্ব নষ্ট হয়ে যায়। তাই এটি পরিহার করাই উত্তম।
সিরামিকের পাত্র
কাচের বোয়ামের মতো আরও একটি উপযুক্ত পাত্র হলো সিরামিকের বোয়াম। এখানে আমসত্ব রাখলে অনেকদিন পর্যন্ত ভালো থাকে।
টক ঝাল মিষ্টি শুকনো আমসত্ব রেসিপি ও খাওয়ার উপকারিতা
আমসত্ব কেন খাবেন
আমসত্ব ছোট থেকে বড় সব বয়সের মানুষের বেশ পছন্দের একটি সুস্বাদু মুখোরোচক খাবার। আমরা মুখের স্বাদ নিতে এটি খেয়ে থাকি। তবে হয়তো অনেকেই জানিনা আমের পুষ্টিগুণ কিছু পরিমাণে আমসত্বে পাওয়া যায়। চলুন এক নজরে আমসত্বের উপকারিতা সম্পর্কে যেনে নেওয়া যাক-
- আমসত্বে প্রচুর পরিমানে ভিটামিন সি রয়েছে। ভিটামিন সি এর অভাব পূরণ করতে আমসত্ব খাওয়া যেতে পারে।
- এতে থাকা ফাইবার হজম শক্তি বাড়িয়ে তোলে এবং কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করতে সাহায্য করে।
- ওমেগা থ্রি ফ্যাটি অ্যাসিড ও অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট আমাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এতে সহজে শরীরে অসুখ বাধতে পারেনা।
- আমসত্বে থাকা পুষ্টি উপাদান কোলেস্টেরল লেভেলের ভারসাম্য রক্ষা করে।
- সর্দি কাশি দূর করতে আমসত্ব কার্যকারি। তাই যাদের এই সমস্যা রয়েছে তারা আমসত্ব খেতে পারেন পরিমাণ মতো।
উপরোক্ত আলোচনায় ঘরোয়া উপায়ে আমসত্ব সংরক্ষণ পদ্ধতি, রোদে দেওয়ার ঝামেলা ছাড়াই ঘরে বসেই আমসত্ব তৈরির সহজ ও পারফেক্ট রেসিপি, কিছু উপকারিতা সম্পর্কে বিস্তারিত লেখা হয়েছে। এই আর্টিকেল পড়লে যত্নে করা আমসত্ব খুব সহজে সংরক্ষণ করতে পারবেন। আর আমসত্ব নষ্ট হওয়া নিয়ে চিন্তিত থাকতে হবেনা।