You are currently viewing বাংলাদেশে সরিষার তেলের দাম এবং দাম বৃদ্ধির কারণ

বাংলাদেশে সরিষার তেলের দাম এবং দাম বৃদ্ধির কারণ

আমরা সরিষা বীজ মোটামুটি সবাই জানি ও চিনি। এই সরিষা বীজ থেকে তৈরি হয় সরিষার তেল। এটি গাঢ় হলুদ বর্ণের ও বাদামের মত সামান্য কটু স্বাদযুক্ত ও শক্তিশালী সুবাস যুক্ত হয়ে থাকে। যা স্বাদে একটু ঝাঝালো ভাব থাকে। এই তেলের ঔষধি গুণাগুণের জন্য প্রাচীনকাল থেকেই আয়ুর্বেদ চিকিৎসায় ব্যবহার হয়ে আসছে। অনেক আগে থেকে আমাদের পূর্বপুরুষেরা ঐতিহ্যগত ভাবে এই তেল ব্যবহার করে আসছেন। স্বাধীনতার আগে ও পরেও বাংলাদেশের মানুষ সরিষা তেলের ওপর প্রায় নির্ভরশীল ছিল। যে কারনে সেই কাল থেকে এখন পর্যন্ত ভর্তা থেকে শুরু করে অনেকেই রান্নার কাছে সরিষার তেল ব্যবহার করে থাকেন। ওমেগা আলফা ৩, ওমেগা আলফা ৬ ফ্যাটি এসিড, ভিটামিন ই ও  অ্যান্টিঅক্সিডেন্টের সমৃদ্ধ হওয়ায় সরিষার তেলকে স্বাস্থ্যকর তেল বলা হয়।

রূপচর্চায় বা চুলের যত্নে মাথায় সরিষার তেল ব্যবহার হয়ে থাকে। চুল পড়া রোধ, চুলের আগা ফাটা, চুল ঘনকালো করতে সরিষা তেলের ভূমিকা অনেক। ত্বকের যত্নেও সরিষার তেলের বহু ব্যবহার রয়েছে। ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাবে সয়াবিন ও পাম তেলের দাম যখন আকাশ ছুঁয়েছে, ঠিক সেই সময়েই দেশের মানুষ আবারও ঐতিহ্যবাহী সরিষা তেল খাবারের দিকেই মনোযোগ দিচ্ছে। অনেকটা বাধ্য হয়েই সরিষাতেই ফিরছে দেশের মানুষ। স্বাস্থ্যসম্মত হিসেবে অনেকেই যখন সেই সরিষা তেল ব্যবহার করছেন। সরিষা তেল ব্যবহারের পূর্বে অবশ্যই নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে যে আপনার সরিষার তেল খাঁটি কিনা? নকল বা ভেজাল সরিষার তেল ব্যবহারের ফলে ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে বেশি। 

সরিষা তেল ব্যবহারের কারন

আপনি যদি একটু আগের কথা চিন্তা করেন তবে জানতে পারবেন পূর্বে সরিষার তেলই এক সময় রান্নায় বেশি ব্যবহার হতো। পরবর্তীতে দেশের মানুষ রান্নায় সরিষার তেল বাদ দিয়ে সয়াবিন ও পাম তেল তুলনামূলক স্বস্তা, চাকচিক্যময় এবং প্রচারের জন্য ব্যবহার শুরু করে। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করে বড় বড় ইন্ডাস্ট্রি গুলো সয়াবিন-পাম তেল পরিশোধন কারখানা গড়ে তোলে। এরপর থেকে সয়াবিন-পামের অগ্রযাত্রা শুরু হয় এবং সরিষার ব্যবহার কমে যায়। 

সরিষার তেল ব্যবহার কমে যাওয়ার আরেকটি গুরুত্ব দিক ছিল,সয়াবিন তেলের প্রায় দেড় গুণ দাম বেশি ছিল সরিষার তেল। প্রথম দিকে পাম ওয়েল ও সয়াবিন তেলের দাম সরিষার তেলের তুলনায় অনেক কম ছিল। আর যে কোন ভাজা পোড়া রান্নায় সয়াবিন তেল স্বচ্ছ হওয়ায় রান্নার ক্ষেত্রে ব্যপক চাহিদা হয়। 

আগে খুচরা দাম এক লিটার সরিষার তেল যেখানে ১৮০ টাকা ছিল, সেখানে সয়াবিন তেল এক লিটার ছিল ১০০ টাকা। পাম তেল আরো কম ৮৫-৯০ টাকার মতো ছিল। আর পাইকারি বাজারে ও পাইকারি দাম আরো কম দামের কারনে দোকানদারগন এই তেল বিক্রিয়ে উৎসাহী হয়ে ওঠে। মূলত দামের পার্থক্যের কারণেই নিম্নবিত্ত থেকে শুরু করে মধ্যবিত্ত, উচ্চ মধ্যবিত্ত সবাই সয়াবিন-পাম তেল ব্যবহার শুরু করে এবং এই দিকেই ঝুঁকতে থাকে। ফলে নিজেদের তেল নিজেরা ব্যবহার না করে আমদানী করা তেল নির্ভর হয়ে পড়ে। আর শৌখিন পণ্য হয়ে ওঠে সরিষা তেল। যা রান্নার জন্য ব্যবহার মানেই মনে হতো শৌখিনতা। অনেক উপকারীতা থাকা শর্তেও সরিষার তেল ব্যবহার বিলুপ্ত হয়। আর বিভিন্ন পুষ্টিগুন, সস্তা, প্রচার ও টিভি নিউস সহ অনেক বড় বড় শিল্প প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় সয়াবিন তেলের চাহিদা বেড়ে সার্বজনীন হয়। 

সরিষার তেল ব্যবহার বাড়ার কারন

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সয়াবিন, সানফ্লাওয়ার তেলবীজের উৎপাদনে বড় ধরনের ব্যাঘাত ঘটে বিশ্বজুড়ে। এই তেলবীজ সরবরাহ প্রক্রিয়া চরমভাবে বাধাগ্রস্ত হয় বিশ্বজুড়ে। উন্নয়নশীল দেশ সহ উন্নত দেশগুলো সবাই বিপাকে পড়ে। পাম তেলের সবচেয়ে বড় রপ্তানিকারক দেশ হলো ইন্দোনেশিয়া। এরই মধ্যে এই দেশ পাম তেলের রপ্তানি নিষিদ্ধ করায় ভোজ্য তেলের বাজারে দামে রেকর্ড ছুঁয়ে যায়। 

তেলের মূল্য বাজারে আপ-ডাউন হয়ে থাকে। এভারেজ একটা মূল্য যদি ধরা যায়। একটা সময় সেই রেকর্ড দামের তেল দেশে আনতে গিয়ে লিটারে সয়াবিন ১৯৮ টাকায় ছুঁয়ে দেশেও রেকর্ড গড়ে। আর পাম তেলের দাম নির্ধারিত হয় লিটারে ১৭২ টাকা।

সয়াবিন এবং পাম তেলের তুলনায় সরিষা তেলের দামের ব্যবধান যখন মাত্র ৪০ টাকায় নামায় অনেকেই ঝুঁকল সরিষা তেলের দিকেই। বাজারে সরিষার তেলের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় আবারও সরিষার তেলের দাম বেড়ে যায়। অর্থাৎ যখন কোন প্রডাক্ট সবাই ব্যবহার করে বা চাহিদা বেড়ে যায়, বাজারে তখন সেই প্রডাক্টের দাম বেড়ে যায়। এমন টাই ঘটেছে সরিষার তেলের ক্ষেত্রেও। বাজারে সয়াবিন তেল, পাম ওয়েলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরিষার তেল স্বাস্থ্যসম্মত বেশি ও পুষ্টিগুন সম্পন্ন বেশী হওয়ায় এই তেলের ব্যবহার বেড়ে যায় ফলে চাহিদা বেড়ে যায়। 

সয়াবিনের তুলনায় সরিষা তেলের লিটারে দামের ব্যবধান আনুমানিক ৮২ টাকা হয়ে যায়। আর বোতল জাত সয়াবিনের তুলনায় বোতল জাত সরিষা তেলের দামের পার্থক্য লিটারে আনুমানিক ১৫২ টাকা হয়। ব্যবসায়ী ও বাজার বিশ্লেষন করে দেখা যায়, মৌসুমের শুরুতেও প্রতি মণ সরিষার দাম ছিল মান ভেদে এভারেজ ২০০০ টাকা থেকে ২৫০০ টাকা পর্যন্ত। আর সেই সরিষা বাজারে বা কৃষক পর্যায়ে বিক্রি হচ্ছে ৩০০০ থেকে ৩৫০০ টাকায়। যেহেতু সরিষা থেকে চাপের মাধ্যমে সরিষার তেল তৈরি হয়। যে কারনেই সরিষার দাম বাড়ার জন্য এই তেলের দামও বাড়ে। আবার আগে যদি কম দামে সরিষা কিনেও থাকে মিলরা বা তেল কোম্পানীরা। কিন্তু তারা বাড়তি মুনাফা পাওয়ার জন্য বাড়তি দামের বাজারের জন্য তেলের দাম বেশি ধরে রাখে।

দেশের ২০১৮-১৯ মৌসুমের এক পরিসংখ্যান অনুযায়ী, সরিষা দিয়ে ভোজ্য তেলের জোগান দেশে পাঁচ লাখ সাত হাজার হেক্টর জমিতে উৎপাদিত সরিষার পরিমাণ ছিল সাত লাখ ৩৫ হাজার মেট্রিক টন। আর ২০২০-২১ অর্থবছরে দেশে পাঁচ লাখ ৮৮ হাজার ৭৩৭ হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ হয়েছে হেক্টরে ১.৩৬ টন। গড় ফলন হিসাব করলে দেখা যায় প্রায় আট লাখ টন সরিষা উৎপাদিত হয়েছে। যেই অনুযায়ী হিসাব কলে দেখা যায় যদি প্রতিবছর ৩.৫ লাখ মেট্রিক টন উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব হয়, তবে ২০৩০ সালে দেশে মোট সরিষা উৎপাদন হবে প্রায় ৪৬ লাখ ৬৩ হাজার মেট্রিক টন। যা থেকে প্রায় ১৬ লাখ ৩২ হাজার মেট্রিক টন তেল পাওয়া যাবে। যখন কোন ভোজ্য তেলের দাম বেড়ে যায় তখন আমরা সেটা ব্যবহার কম করে কমদামের তেল টা ব্যবহার করে থাকি।

বাংলাদেশ পরমাণু কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্ভিদ প্রজনন বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা এবং তেলজাতীয় ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি প্রকল্পের উপপ্রকল্প সমন্বয়ক ড. রেজা মোহাম্মদ ইমন বলেন, যদি দেশে বিনাসরিষা-৪ ও বিনাসরিষা-৯ জাতের সরিষা ২২ লাখ হেক্টর পতিত (দুই ফসলের মাঝের) জমিতেও আবাদ করা যায়, তবে বছরে ১৭ হাজার কোটি টাকার তেল আমদানি করা যাবে। এতে ১৭ হাজার কোটি টাকার তেল দেশে যদি আমদানি করা হয় তবে সেটা আর করতে হবে না। দেশে ২২ লাখ হেক্টর জমি পতিত আছে আমন আর বোরোর মাঝের সময়ে যদি এই পতিত এই জমি সরিষা উৎপাদন করা হয়, তবে বছরে তেলের উৎপাদন আট থেকে ১০ লাখ টন বাড়বে।

দেশে উৎপাদনের পরিকল্পনা

আমাদের দেশে ভোজ্য তেলের চাহিদা যেহেতু শতকরা ৮০% বেশি আমদানি নির্ভর। তাই আমদানি নির্ভরতা কমিয়ে দেশে উৎপাদন না বাড়ালে ভবিষৎ এ সরিষার তেল সহ যে কোন ভোজ্য তেল নিয়ে সমস্যায় পড়তে হবে। তাই দেশের অর্থণৈতিক উন্নয়নে ও তেলের চাহিদা পূরনে ভোজ্য তেলের আমদানি কমিয়ে উন্নত সরিষা চাষ করতে হবে। যে কারনে সরিষা চাষ সহ সরিষার তেলের কোম্পানী ও কোল্ড প্রেস বা ঘানি ভাংগা সরিষার তেল উৎপাদন করতে মিল মালিকদের উদ্যোগ গ্রহনের জন্য কাজ করা হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট কাজ করে যাচ্ছে কিভাবে সরিষা চাষ বৃদ্ধি করে দেশের তেলের চাহিদা পূরন করা যায়। 

সরিষার তেলের দাম

ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ শুরুর আগে ১৮০ টাকা লিটার সরিষা তেল বিক্রি হয়েছিল। মার্চে সেই তেল লিটারে ২৪০ টাকা হয়। আবার মে মাসে সেই সরিষা বিক্রি হয়েছিল লিটারে ২৫০-২৮০ টাকা। আর বোতলজাত সরিষা তেল বিক্রি হয়েছিল রাঁধুনি সরিষার তেল লিটারে ৩৫০ টাকা। এখন বাজার আপডাউনের কারনে কোন মাসে সরিষার তেল কিছু টা কম আবার বেশি দামে বিক্রি হয়ে থাকে।

ফুড হাইড্রেট গ্লাস জার সহ ৫৬৫ মিলি ইন্ডিয়ান কাচ্ছি ঘানি সরিষার তেল বিক্রি হয় ৬৯৫ টাকা। বাজারে বর্তমানে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের সরিষার তেল বিক্রয় হয় ৩০০ থেকে ৩২০ টাকায়। উৎপাদনকারীরা বলছেন, শুধু উৎপাদন খরচ নয়, ব্র্যান্ড ভ্যালুসহ অন্যান্য বিষয় বিবেচনায় নিয়েই পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করা হয়। এ কারণে নামি প্রতিষ্ঠান গুলোর তৈরি সরিষার তেলের দাম একটু বেশি হয়। 

বাজারে কোম্পানি অনুযায়ী প্রতি লিটার সরিষার তেল বিক্রি হয়ে থাকে ৩০০-৩৩০ টাকা পর্যন্ত। ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদন ও বাজার ঘুরে দেখা গেছে, সিটি গ্রুপের তীর ব্র্যান্ডের তেল ৩৪০-৩৬০ টাকা, স্কয়ার কনজিউমার প্রডাক্টসের রাঁধুনী ৩৩০-৩৫০ ও বাংলাদেশ এডিবল অয়েল লিমিটেডের রূপচাঁদা ৩৪০-৩৬৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। আর প্রতি লিটার সুরেশ সরিষার তেল ৩৪৫-৩৪৫ এবং ৫০০ গ্রাম ওজনের এসিআই ১৬০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। 

রাজধানী সহ বিভিন্ন বাজারে ও অনলাইন অনেক ওয়েবসাইটেও সরিষার তিন ধরনের তেল পাওয়া যায়। স্থানীয়ভাবে মেশিনে ভাঙানো তেলের পাশাপাশি বিভিন্ন ব্রান্ড কোম্পানির তেল যেমন আছে, সেই সাথে ঘানি ভাঙানো তেলও। তবে বর্তমান সময়ে সব চেয়ে বেশি ক্রেতা বা কাস্টমারের কাছে চাহিদা ঘানি ভাংগা সরিষার তেলের। কারন অনেক দামি ব্রান্ডের কোম্পানীর সরিষার তেলে ভেজাল ও সেই খাটি তেলের স্বাদ মেলে না। যে কারনে মানুষ নিজে সরিষা কিনে বেশি করে ভাংগে তেল তৈরি করে নেন। আর কেউবা সেই সব কারখানা থেকে খুচরা কিনে থাকেন। আবার অনেকেই পাইকারি দরে তেল কিনে সেখানে থেকে কাস্টমার পর্যন্ত বিক্রি করে মুনাফা লাভ করে ব্যবসা হিসাবে নিয়ে। স্থানীয়ভাবে মেশিনে তেল ভাঙানোর যেমন স্থায়ী কেন্দ্র আছে আবার তেমনি ভ্রাম্যমাণ মেশিনও আছে। স্থানীয়ভাবে মেশিনে ভাঙানো তেল বর্তমানে বিক্রি হচ্ছে প্রতি কেজি ৩২০ থেকে ৩৪০ টাকায়। আর ঘানি ভাঙানো তেল মিলছে ৩১০ থেকে ৩২০ টাকায়। বছর খানেক আগেও সরিষার তেলের (মেশিনে ভাঙা) দাম ছিল প্রতি কেজি ১৮০ টাকা। সেই তেল বেড়ে এখন বিক্রি হচ্ছে ৩০০-৩৪০ টাকায়।

Bornali Akter Borno

Bornali Akter Borno is a passionate food enthusiast and entrepreneur. From an early age, her love for culinary exploration led her to experiment with flavors and ingredients, ultimately inspiring her to work with Binni Food, an e-commerce brand dedicated to offering premium quality Organic Food and delectable treats to food enthusiasts in Bangladesh. Bornali's relentless pursuit of flavor and commitment to excellence have earned her recognition in the culinary world. Her journey is a testament to the power of passion and perseverance, showcasing how dedication to one's craft can lead to entrepreneurial success and culinary innovation.