ঘি কে তার মধ্যে থাকা পুষ্টিগুণের উপর ভিত্তি করে সুপারফুড বলা হয়। দেহের বিভিন্ন প্রকারের উপকার করার পাশাপাশি এটি খেতে অনেক সুস্বাদু। এই কারণে অনেক আগে থেকেই একে রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয়। তেলের পরিবর্তে ঘিয়ে রান্না করা খাবার বেশি সুস্বাদু ও পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ হয়।
আমাদের আজকের লেখায় ঘি খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। এখানে আরও কোন কোন সময় খাঁটি ঘি খাওয়া উপকারী ও অতিরিক্ত খেলে কি কি স্বাস্থ্যঝুঁকি আছে সে সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
ঘি কখন খাওয়া ভালো?
ঘি একটি অতি উচ্চমানের সুপারফুড। দুধ থেকে তৈরি হওয়া যত ধরনের খাবার রয়েছে তাদের মধ্যে ঘি পুষ্টিগুণে অনন্য। সভ্যতার শুরুর সময় থেকেই মানুষ তাদের খাদ্যাভ্যাস নিয়ে গবেষণা শুরু করে। এই ধরনের নানা গবেষণা পরিচালনার মাধ্যমেই পরবর্তীতে দুধ দিয়ে নানা রকম মুখরোচক খাদ্য উপাদান তৈরি করা সম্ভব হয়।
শুরুর দিকে খাওয়ার পাশাপাশি ঘি ওষুধ তৈরির কাজে ব্যবহার করা হত। ভারতীয় উপমহাদেশে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসা শাস্ত্রে বলা হয় চিকিৎসা ক্ষেত্রে অনেক আগে থেকেই ঘি এর ব্যবহার প্রচলিত ছিল। পরবর্তীতে চিকিৎসা শাস্ত্র বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে গবেষণার মাধ্যমে ঘি এর পুষ্টিগুণ ও উপকারিতা নিশ্চিত করেছে।
ঘি এর পুষ্টিগুণের উপর নির্ভর করে পুষ্টিবিদগণ এটি কখন খাওয়া সব থেকে বেশি উপকারী তা বর্ণনা করেছেন। সাধারণত মধু এবং ঘি খাওয়ার সব থেকে উৎকৃষ্ট সময় হচ্ছে খালি পেটে খাওয়া। তো আমরা একদম ফ্রেশ খালি পেট পাই একদম সকালে ঘুম থেকে ওঠার পর। এই সময় আমাদের পাকস্থলী পরিষ্কার থাকে।
এই সময় ঘি খেলে তা খুব দ্রুততার সাথে হজম প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পুষ্টি উপাদান বিকিরিত করতে থাকে যা দেহ অতি দ্রুত কোন ধরনের বাঁধা ছাড়াই গ্রহণ করে। আরও সহজভাবে বলতে গেলে বলতে হয় যে খালি পেটে ঘি এর কার্যকারিতা সব থেকে বেশি থাকে এবং তা দ্রুত শরীরে ছড়িয়ে পরে।
বিভিন্ন গবেষণায় বলা হয়েছে যে আমাদের দেহ সকালে খালি পেটে এই ধরনের বেশি পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকে। তাছাড়া খাঁটি ঘি এর মধ্যে দেহের জন্য প্রয়োজনীয় সকল ধরনের পুষ্টি উপাদান বিদ্যমান। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি জার্নালের তথ্যমতে দেশি ঘি এর মধ্যে ৩২ টির মত আলাদা আলাদা উপাদান পাওয়া গেছে। যেগুলো দেহের বিভিন্ন কাজে লাগে।
এই কারণে উপমহাদেশে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ঘি খাওয়ার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়। অবস্থাভেদে অনেকেই আবার সকালের পাশাপাশি রাতে খালি পেটে ঘি খায়। তাছাড়া অনেকেই গরম ভাতের পাশাপাশি অন্যান্য অনেক খাবারের সাথে ঘি খেতে পছন্দ করে। তবে সকালে খালি পেটে ঘি খাওয়ার উপযুক্ত সময়।
প্রতিদিন কি পরিমাণ ঘি খাওয়া উচিত?
ঘি একটি অতি উচ্চমাত্রার ফ্যাট জাতীয় খাবার। তাই মজা লাগলেই ইচ্ছে মত খাওয়ার কোন রাস্তা নেই। আসলে ঘি সব সময় পরিমাণ মত খেতে হয় না হলে অনেক ধরনের স্বাস্থ্য সমস্যা দেখা দেয় যাদের মধ্যে উচ্চরক্ত চাপ এবং স্থূলতা অন্যতম।
তবে নিয়মিত ঘি খাওয়ার ব্যাপারটা অনেক বিষয়ের উপর নির্ভর করে। এর মধ্যে বয়স ও স্বাস্থ্য অবস্থা অন্যতম। কারণ ঘি অনেক পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাদ্য। বেশি পরিমাণে গ্রহণ করলে এটি দেহের পুষ্টির তারতম্য ঘটাতে পারে যা স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে।
যাইহোক, পুষ্টিবিজ্ঞানীদের মতে প্রতিদিন সকালে খালি পেটে ঘি গ্রহণ করলে সব থেকে বেশি উপকার পাওয়া যায়। অন্যদিকে প্রায় সকল বয়সের মানুষের জন্য ঘি খাওয়া উপকারী। বিশেষ করে যৌবন বয়সে নিয়মিত ঘি গ্রহণ করলে তা বয়সের ছাপ লুকাতে সাহায্য করে। পুষ্টি বিজ্ঞানীদের মতে কোন বয়সের মানুষের কি পরিমাণে ঘি খাওয়া উপকারী তা নিচে বর্ণনা করা হলো।
- প্রাপ্ত বয়স্ক পুরুষ ও মহিলা = প্রতিদিন ২ টেবিল চা চামচ পরিমাণে।
- গর্ভবতী ও স্তন্যদানকারী মহিলা = প্রতিদিন ৩ টেবিল চা চামচ পরিমাণে।
- ৭-২৪ মাসের শিশু = প্রতিদিন ২-৩ টেবিল চা চামচ পরিমাণে।
- ৩-৯ বছরের বাচ্চা = প্রতিদিন ২-৩ টেবিল চা চামচ পরিমাণে।
- ১০-১৭ বছরের কিশোর-কিশোরী = প্রতিদিন ৩ টেবিল চা চামচ পরিমাণে।
এখানে বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে একজন মানুষের বিভিন্ন বয়সে কি পরিমাণ গাওয়া ঘি খাওয়া জরুরি তা বর্ণনা করা হয়েছে। এর বাইরে চিকিৎসা হিসেবে ঘি এর নানামুখী ব্যবহার রয়েছে। অনেকের মতে ঘি সাইনোসাইটিস সমস্যা দূর করতে সাহায্য করে। অন্যদিকে আয়ুর্বেদিক চিকিৎসার পাশাপাশি হোমিও ও অ্যালোপ্যাথি চিকিৎসায় ঘি এর ব্যবহার রয়েছে।
পরিমাণ মত ঘি খেলে তা যেমন আমাদের স্বাস্থ্যের জন্য উপকারী হিসেবে কাজ করে তেমনি পরিমাণের অধিক তা শরীরের ক্ষতি করে। এই জন্য উপরে বর্ণিত উপায়ে আমাদের নিয়মিত ঘি খাওয়া উচিত।
ঘি খেলে কি মোটা হয়ে যায়?
এখানে উত্তর হ্যাঁ এবং না উভয় প্রযোজ্য। আমরা জানি ঘি একটি দুগ্ধজাত খাদ্য। এতে রয়েছে একটি সুপারফুডের সমপরিমাণ পুষ্টিগুণ। এই ধরনের বেশি পুষ্টি উপাদান সমৃদ্ধ খাবার অতিরিক্ত খেলে তা উপকারের চেয়ে ক্ষতি বেশি করে। যাইহোক, ঘি একটি উচ্চ চর্বি যুক্ত খাবার। যদিও এতে থাকা চর্বিকে উপকারী ফ্যাট বলা হয়। কারণ ঘি তে থাকা চর্বি দেহের জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাট সরবরাহ করে।
বিশেষ করে মস্তিষ্কের জন্য প্রয়োজনীয় ফ্যাটি অ্যাসিড অথবা ওমেগা-৩ ব্রেইন সেল সুস্থ ও কর্মক্ষম রাখে। এতে দেহের ত্বকের বিভিন্ন স্থানের সেল যেমন কর্মক্ষম থাকে এমনি মস্তিষ্ক সচল থাকে। তবে যখন বেশি পরিমাণে ঘি গ্রহণ করা হয় তখন তা দেহে কোলেস্টেরলের মাত্রা বাড়ানোর সাথে সাথে ক্ষতিকর চর্বি বৃদ্ধি করে।
অর্থাৎ যখন পরিমাণের অধিক ঘি খাওয়া হয় তখন তা অজন বৃদ্ধি করার সকল ধরনের কার্যক্রম সচল রাখে। যা দেহে চর্বি যোগ করার সাথে সাথে ওজন বৃদ্ধি করে। তবে বিভিন্ন গবেষণা তথ্যে দেখা গেছে ওজন বৃদ্ধি করার জন্য কোন একটি নির্দিষ্ট কারণ কাজ করে না। এই কারণে শুধু ঘি খাওয়াকে ওজন বৃদ্ধি হওয়ার কারণ হিসেবে ধরা ঠিক হবে না।
তবে এটা সত্যি যে বেশি পরিমাণে দুগ্ধজাত খাবার গ্রহণ করলে তা স্থূলতা সমস্যার সৃষ্টি করে। এই দিক থেকে যেহেতু অন্যান্য দুগ্ধজাত পণ্যগুলোর মধ্যে ঘি অনেকভাবে খাওয়া যায় তাই একে ওজন বৃদ্ধি হওয়ার কারণ হিসেবে দেখা হয়। অন্যদিকে, প্রয়োজন মোতাবেক ঘি যদি ডায়েটে যোগ করা যায় তবে অনেক কম খাবার খেয়েও দেহের জন্য প্রয়োজনীয় পুষ্টি ও সক্তি সরবরাহ করা সম্ভব।
মোটকথা, ঘি একাধারে আমাদের দেহের ওজন কমাতে সাহায্য করলেও অতিরিক্ত পরিমাণে খেলে তা ওজন বৃদ্ধির কারণ হিসেবে আবির্ভূত হয়। এই কারণে বিশেষজ্ঞ পুষ্টিবিদগণ সব সময় নিয়মিত ঘি খাওয়ার পাশাপাশি ব্যায়াম করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। কারণ ব্যায়াম করলে দেহের ক্যালরি খরচ হয় যা ঘি থেকে পাওয়া পুষ্টিগুণ দেহের মাত্রার সাথে অ্যাডজাস্ট করে। তো বলা যায় ঘি ওজন বৃদ্ধিও করে আবার নিয়ন্ত্রণও করে।
ঘি বেশি খেলে কি ক্ষতি হয়?
যেহেতু ঘি একটি উচ্চ স্যাচুরেটেড ফ্যাট সমৃদ্ধ খাবার সেহেতু এটি কিছু স্বাস্থ্য ঝুঁকির সম্ভাবনা সৃষ্টি করে। আয়ুর্বেদিক চিকিৎসক ডক্টর রেখা রাধামনি বলেন যে “ঘি একটি স্বাস্থ্যকর খাবার জন্যই যে সবার জন্য উপযোগী এমন নয়।” তারমতে, ঘি একটি উচ্চ পুষ্টিগুণ সমৃদ্ধ খাবার। তবে অসুস্থ অবস্থায় এই খাবার গ্রহণ করলে অথবা যার শরীরে এমনিতেই তেমন কোন সমস্যা নেই সে যদি অতিরিক্ত ঘি গ্রহণ করে তাহলে স্বাস্থ্য ঝুঁকি তৈরি করে।
সাধারণত ঘি একটি ফ্যাট যুক্ত খাবার যা অতিরিক্ত গ্রহণের ফলে দেহের চর্বির মাত্রা বেড়ে যাবে। যা ক্ষতিকর LDL কোলেস্টেরল মাত্রা বৃদ্ধি করে। এই কোলেস্টরেল হৃৎপিণ্ডের অনেক ক্ষতি করে। অন্যদিকে দেহের পুষ্টি উপাদানের তারতম্য ঘটিয়ে ইমিউনিটি সিস্টেমে ঝামেলা তৈরি করতে পারে।
ডক্টর রেখা রাধামনির মতে যাদের দীর্ঘস্থায়ী পেটের অসুখ যেমন IBS-D আছে তাদের ঘি খাওয়া উচিত নয়। এছাড়া পেটের অন্যান্য সমস্যায় এবং গর্ভাবস্থায় অতিরিক্ত ওজন থাকলে ঘি খেতে মানা করেছেন। এবং বিশেষ করে সিজনাল সমস্যা যেমন সর্দি এবং জ্বরের সময় ঘি খাওয়া উচিত নয়। মোটকথা, ঘি বেশি খেলে নিম্নে বর্ণিত সমস্যা তৈরি হয়।
- দেহের ওজন বৃদ্ধি পায়
- রক্তে ক্ষতিকর কোলেস্টরেল বৃদ্ধি পায়
- পেটের সমস্যা তৈরি হয়
- পেটের পূর্বের সমস্যা পুনরায় জেগে ওঠে
- স্যাচুরেটেড ফ্যাট বৃদ্ধি করে
- দেহের চর্বির মাত্রা তারতম্য করে
উপরিউক্ত আলোচনায় ঘি আমাদের কীভাবে উপকার এবং অপকার করে সে সম্পর্কে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করা হয়েছে। সাধারণত ঘি আমাদের দৈনন্দিন অনেক কাজে লাগে। এটি খেতে যেমন অনেক স্বাদের তেমনি ঔষধি গুণের দিক দিয়ে গাওয়া ঘি অথবা খাঁটি ঘি অপ্রতিদ্বন্দ্বী।
রান্নার স্বাদ বৃদ্ধিতে, গরম ভাতে কিংবা মজার আইটেম তৈরিতে, রুপচর্চা সহ অনেক কাজে ব্যবহার করা হয় প্রতিদিনের গুরুত্বপূর্ন খাবার ঘি। অনেকি দুধ খেতে পারে তাদের জন্য হতে পারে অন্যতম দুধের বিকল্পের পুষ্টির মাধ্যম। ঘি এর আরো পুষ্টিগুন ও স্বাস্থ্য উপকারিতা এই আর্টিকেল থেকে জেনে নিতে পারেন।